পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খেজুর আজওয়া খেজুরের বিস্ময়কর ইতিহাস
রুহুল কুদ্দুস টিটো
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে: সূরা মারইয়াম:(২৫-২৬) – আর তুমি নিজের দিকে খেজুর গাছের কান্ডে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার উপর সুপক্ক খেজুর পতিত হবে। যখন আহার কর, পান কর এবং চক্ষু শীতল কর।
আজওয়া খেজুরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বিস্ময়কর ইতিহাস। রাসুলুল্লাহ (স.) একজন ইহুদির হাত থেকে সালমান ফারসি (রা.)-কে মুক্ত করার জন্য এই গাছ রোপনে অংশ নিয়েছিলেন। ইহুদির দুটি কঠিন শর্ত ছিল। শর্ত দুটি পূরণ করতে পারলে সালমান ফারসি (রা.)-কে মুক্তি দেওয়া হবে। তার উদ্দেশ্য ছিলো— অসম্ভব শর্তে তাকে আটকে রাখা। শর্ত দুটি হলো- (১) অল্প কয়েক দিনের মধ্যে নগদ ৬০০ দিনার ইহুদিকে দিতে হবে এবং (২) অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ৩০০টি খেজুর গাছ রোপন করে তাতে খেজুর ধরে পাকতে হবে। তবেই সালমান ফারসি (রা.)-কে মুক্তি দেওয়া হবে।
যা পূর্ণ করা ছিলো সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার। বিষয়টি নবীজি (স.) অবগত হলে তিনি প্রথমে ৬০০ দিনারের ব্যবস্থা করলেন। তারপর হজরত আলী (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে ইহুদির কাছে গেলেন। ইহুদি এক কাঁদি খেজুর দিয়ে বলল, এই খেজুর থেকে চারা উৎপন্ন করে তাতে ফল ফলাতে হবে। রাসুল (স.) দেখলেন যে, ইতোমধ্যে খেজুরগুলো আগুনে পুড়িয়ে কয়লা করে ফেলেছে সে, যাতে চারা না গজায়।
রাসুল (স.) খেজুরের কাঁদি হাতে নিয়ে আলী (রা.)-কে গর্ত করতে বললেন আর সালমান ফারসিকে বললেন পানি আনতে। আলী (রা.) গর্ত করলে রাসুল (স.) নিজ হাতে প্রতিটি গর্তে সেই পোড়া খেজুর রোপন করলেন।
বাগানের একদিক থেকে পোড়া কালো দানা রোপণ করতে করতে বাগানের শেষ পর্যন্ত গেলেন। রাসুল (স.) সালমান ফারসিকে এ নির্দেশ দিলেন যে, বাগানের শেষ প্রান্তে না যাওয়া পর্যন্ত তুমি পেছন ফিরে তাকাবে না। সালমান ফারসি পেছনে না তাকিয়ে পানি দিতে লাগলেন। বাগানের শেষ প্রান্তে যাওয়ার পর তিনি তাকিয়ে দেখলেন যে প্রতিটি গাছ খেজুরে পরিপূর্ণ। আল্লাহর অশেষ মহিমায় সেই পোড়া খেজুর থেকে চারা গজালো। আর খেজুরগুলো পেকে কালো বর্ণ হয়ে গেল। কারণ এই খেজুরের দানাগুলো ছিলো আগুনে পোড়া কয়লার মতো কালো। তাই এর স্বাদও অনেকটা পোড়া পোড়া। গন্ধও তাই। এই খেজুর পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খেজুর। আর স্বাদের দিক দিয়েও সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু। হাদিস শরিফে খেজুরটির গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে এবং জান্নাতের ফল হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন, ‘আজওয়া জান্নাতের, এতে বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক রয়েছে..।’ (তিরমিজি: ২০৬৬)
আপর এক বর্ননায় পাওয়া যায়,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, হে সালমান! তুমি (তোমার মালিকের সাথে দাসত্বমুক্তির ব্যাপারে) চুক্তি কর। আমি তার সাথে তিনশত ছোট খেজুর গাছের চারা ফলদায়ক হওয়া পর্যন্ত গর্তে পানি দেওয়া এবং চল্লিশ উকিয়া আদায় করার উপর চুক্তি করলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীদেরকে বলেন, তোমরা তোমাদের ভাইকে সাহায্য করো। তারা আমাকে খেজুর গাছ (চারা) দিয়ে সাহায্য করল। এক ব্যক্তি ত্রিশটি চারা দিলেন, আরেকজন বিশটি। অপরজন পনেরটি, আরেকজন দশটি চারা দিলেন। অর্থাৎ প্রত্যেকেই তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী আমাকে সাহায্য করলেন। এক পর্যায়ে আমার তিন’শ চারা হয়ে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, হে সালমান! তুমি যাও এবং এগুলো রোপণ করার জন্য গর্ত খনন কর। যখন শেষ করবে তখন আমার নিকট আসবে। আমি নিজ হাতে তা রোপণ করব। অতঃপর আমি গর্ত খনন করলাম। আর একাজে তাঁর ছাহাবীগণ আমাকে সাহায্য করলেন। যখন আমি কাজ শেষ করলাম তখন তাঁর নিকট গিয়ে তাঁকে সংবাদ দিলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার সাথে বাগানের দিকে চললেন। আমরা তাঁকে গাছের চারা দেয়া শুরু করলাম আর তিনি নিজ হাতে তা রোপণ করতে লাগলেন। ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে সালমানের প্রাণ! ঐ চারাগুলোর একটিও মারা যায়নি। আমি গাছের চুক্তি আদায় করেছি। এখন আমার উকিয়ার অর্থের চুক্তিটি বাকী ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট কোন যুদ্ধের গণীমত হতে মুরগীর ডিমের ন্যায় স্বর্ণের এক টুকরা আসলে তিনি বলেন, সালমান তার মুকাতাবের (মনিবের) ব্যাপারে কি করেছে? (অর্থাৎ সে মাল আদায় করেছে, না করেনি?) তিনি বলেন, আমাকে ডাকা হ’ল। অতঃপর তিনি বললেন, সালমান এটি নাও এবং তোমার যে ঋণ আছে তা আদায় কর।
অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার উপর যে ঋণ আছে এটা কিভাবে তার বরাবর হবে? তিনি বললেন, এটা নাও। কারণ আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারাই তোমার ঋণ আদায় করে দিবেন। তিনি বলেন, আমি তা নিলাম এবং তাদের জন্য ওযন করলাম। ঐ সত্তার শপথ যাঁর হাতে সালমানের প্রাণ! তা চল্লিশ উকিয়া হ’ল। আমি তাদের হক্ব পূর্ণভাবে আদায় করলাম এবং মুক্তি লাভ করলাম। অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে খন্দক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলাম। তারপর তাঁর সাথে আর কোন যুদ্ধেই আমি অনুপস্থিত থাকিনি (আহমাদ হা/২৩৭৮৮, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮৯৪)।
সালমান আল ফারিসী (আরবি: سلمان الفارسي) নবী মুহম্মদ স. একজন বিখ্যাত সাহাবী। মুহাম্মাদ স. তাকে সালমান আল খায়র নাম প্রদান করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পূর্বে তার নাম ছিল মাবিহ ইবনে বুজখ্শান। তিনি বর্তমান ইরানের ইস্পাহান নামক স্থানে জায়্য নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার জন্মস্থান কোথায় তা নিয়ে মতভেদ আছে। তার পিতা ছিলেন একজন জরাথ্রুস্টবাদী। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সালমান খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। খন্দকের যুদ্ধকালীন সময়ে তার পরামর্শে মুসলমান গণ পরিখা খনন করেন। ধর্মীয় জ্ঞানে তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। তিনি এ ব্যাপারে গভীর রাত পর্যন্ত মুহাম্মাদ স. সাথে আলোচনায় মগ্ন থাকতেন। তার নিকট হতে ৬০ টি এর মতো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তার সন্তানদের মধ্যে এক পুত্র এবং তিনজন কন্যা সন্তানের কথা জানা যায়।
আজওয়া খেজুর যা রয়েছে
আজওয়া অন্যান্য সাধারণ খেঁজুরের মত নয়, এটা মদিনার সবচে’ উন্নতমানের খেঁজুর এবং অনেক বেশি মিষ্টি। খেঁজুরে রয়েছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি, সিলিনিয়াম, কপার, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং খেঁজুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে কার্বহাইড্রেট যা আমাদের তাৎক্ষণিক শক্তি জোগায়।
হজরত আলি (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সাতটি আজওয়া খেজুর প্রতিদিন আহার করে, তার পাকস্থলীর প্রতিটি রোগ নির্মূল হয়ে যায়।’ (কানজুল উম্মাল: ২৮৪৭২)
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘মদিনার উঁচু ভূমির আজওয়া খেজুরে আরোগ্য রয়েছে।’ অথবা তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে এই খেজুর আহার করা বিষনাশক (প্রতিষেধক)।’ (মুসলিম: ৫১৬৮)
হজরত সাদ (রা.) বর্ণনা করেন, একবার আমি অসুস্থ হলে রাসুল (সা.) আমাকে দেখতে আসেন। এ সময় তিনি তাঁর হাত আমার বুকের ওপর রাখেন। আমি তাঁর শীতলতা আমার হৃদয়ে অনুভব করি। এরপর তিনি বলেন, ‘তুমি হৃদ্রোগে আক্রান্ত। কাজেই তুমি সাকিফ গোত্রের অধিবাসী হারিসা ইবনে কালদার কাছে যাও। কেননা, সে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। আর সে যেন মদিনার আজওয়া খেজুরের সাতটা খেজুর নিয়ে বিচিসহ চূর্ণ করে তা দিয়ে তোমার জন্য সাতটি বড়ি তৈরি করে দেয়।’ (আবু দাউদ: ৩৮৩৫)
আয়েশা( রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, আজওয়া খেঁজুর রোগ নিরাময়কারী এবং প্রাতঃকালীন প্রতিষেধক। (সহীহ মুসলিম) উপরিক্তো হাদিস দ্বারা বিষ ক্ষতি করতে পারবে না কথাটি বোঝানো গিয়ে রসূল (ﷺ) খেঁজুরের রোগ নিরাময়কারী গুণাগুণ বুঝিয়েছেন।
হাদিসে প্রতিদিন এবং সকালে খেঁজুর দিয়ে নাস্তা করার কথা কথা বলা হয়েছে। এবং তা আপনার শরীরে টক্সিনে বিরুদ্ধে কাজ করার শক্তি জোগাবে এবং রসূল ﷺ এর বক্তব্য অনুযায়ী এটা সকালে খেলে সবচে’ ভালো কাজ করে। এখানে যে বিষপানে প্রাণীর জীবন যায় বিষ বোঝানো হয় নি, বরং শরীরে যে টক্সিন তৈরী করে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে তার কথা বলা হয়েছে।
আজওয়া খেজুর হচ্ছে আরবদের ট্যাডিশনাল হার্বাল চিকিৎসা। তৎকালীন আরবরা আজওয়া খেঁজুরের গুণাগুণ জানত, তারা জানত শরীরে *বিষ উৎপত্তি হয় Toxin যা শরীরে উৎপত্তি হয়ে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করে। এবং রসূল ﷺ সেটাই বলেছেন।
Antioxidant Activity আজওয়া খেজুরের যে টক্সিনের প্রতি নিবারক ভূমিকা পালন করে থাকে মেডিক্যল জার্নালে রিসার্চ পেপার প্রকাশিত হয়েছে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হল একটি মলিকিউল যা অক্সিডাইজেশনে বাধা প্রদান করে। অক্সিডাইজেশন হল এক প্রকার রাসায়নিক বিক্রিয়া যা ফ্রি রেডিক্যাল তৈরী করে সেল ড্যামেজ করে। অক্সিডেন্ট stress এর কারণে toxic effect সৃষ্টি হতে পারে। হাদিসে বক্তব্যের সাথে মিলে যায়। কারণ খেজুরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন C,A,E আছে। ডিএনএ তে অক্সিডেটিভ ড্যামেজের কারণে ক্যান্সার, হার্ট ফেইলারসহ নানা রোগ হতে পারে। এবং রিসার্চে খেঁজুরের এন্টিক্যান্সার কার্যক্রমও লক্ষ্য করা গেছে।
পবিত্র নগরী মদিনায় উৎপন্ন হওয়া বিশেষ প্রজাতির খেজুর ‘আজওয়া’। রাসুলুল্লাহ (স.) সর্বপ্রথম নিজ হাতে এ খেজুর গাছ রোপণ করেছিলেন। যার ফলে এ খেজুরের রয়েছে বিশেষ বরকত ও ফজিলত। হাদিস শরিফে এই ফলটিকে জান্নাতের ফল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহানবী (স.) বলেন, ‘আজওয়া জান্নাতের ফল, এতে বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক রয়েছে..।’ (তিরমিজি: ২০৬৬)