৩ জানুয়ারি, ১৯৭১ সালের এই দিনে নির্বাচিত গণপ্রতিধিরা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।। আইয়ুব খানের একক কর্তৃত্বমূলক সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রবর্তন ইতিহাস
রুহুল কুদ্দুস টিটো
আইয়ুব খানের একক কর্তৃত্বমূলক সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রবর্তন ইতিহাস
জোরপূর্বক নিজের একাধিপত্য বিস্তার করে আইয়ুব খান দেশের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান,প্রগতিশীল রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেশে একক কর্তৃত্বমূলক সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রবর্তন করেছিলেন ।রাজনীতিবিদদের অনেকে নিজেদের স্বার্থে সামরিক শাসনকে সমর্থন করেন। তাছাড়া মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমেও এক ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী সৃষ্টি হয়।
কালাকানুন দিয়ে বিরোধী নেতৃবৃন্দের দমন-পীড়ন, বিনা বিচারে আটক,সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক শূন্যতা
১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে হটিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ এবং সামরিক শাসন জারি করেন। শাসনতন্ত্র বাতিল, মৌলিক অধিকার
স্থগিত, রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তির মাধ্যমে জেনারেল আইয়ুব খান ঘোষণা দেন পাকিস্তানের শাসন ও রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন সাধন করা হবে। এভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটে এবং শুরু হয় দীর্ঘ এক দশক
ব্যাপী (২৫ মার্চ ১৯৬৯) আইয়ুবীয় বঞ্চনা ও উন্নয়ন মিথ-এর সামরিক শাসন।
আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল : ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাত ১০: ৩০ মিনিটে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় মালিক ফিরোজ খান নূন সংসদীয় সরকারকে উৎখাত করে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন। তিনি উক্ত ৭ অক্টোবরের ফরমানবলে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। প্রেসিডেন্ট মির্জা আইয়ুবের উচ্চাভিলাষ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তথাপিও প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের কাঁধে বন্দুক রেখে দেশ শাসন করতে চেয়েছিলেন। কাজেই প্রেসিডেন্ট ২৭ অক্টোবর, ১৯৫৮ সালে আইয়ুবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কিন্তু যে বন্দুকের বলে মির্জা সামরিক আইন জারি করেন, সে বন্দুকের দখল বা অধিকার তার নিজস্ব ছিল না। কাজেই সেনাপ্রধান আইয়ুব খান ২৭ অক্টোবর এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সামরিক আইন জারি করেন। এতে প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করে নিজে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার নেন। ৪জন জেনারেলকে সশস্ত্র অবস্থায় পাঠিয়ে. ইস্কান্দার মির্জার পদত্যাগ পত্র আদায় করেন এবং তাকে সস্ত্রীক গ্রেফতার করে বিমানযোগে লন্ডন পাঠিয়ে দেন।
চীনের সঙ্গেও আইয়ুব সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন, ১৯৬২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক চরম বৈরিতার দিকে যায় যে বছরে ভারত চীনের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলো। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব সরকার ভারতের সঙ্গে একটি বড় ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পরিকল্পনা করেছিলো যেটি ঐতিহাসিকভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ১৯৬৫ নামে পরিচিতি পেয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির একজন গোঁড়া সমর্থক আইয়ুব পাকিস্তানেও যুক্তরাষ্ট্রর মত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন।
আইয়ুব খানের শাসনের বৈশিষ্ট্যসমূহ :
অভিনবত্ব ও স্বেচ্ছাচারিতা: প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল অভিনবত্ব। তিনি কৃত্রিমভাবে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক করাসহ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, ব্যাপক ধরপাকড় ও প্রশাসনে বেশকিছু রদবদল করেন। কিন্তু এক বছরের মাথায় শুরু হয় আইয়ুবীয় স্বেচ্ছাচারিতা। ফুটে উঠে গণতন্ত্র, রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতা এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানের প্রতি তার অপরিসীম ঘৃণা।
বিরোধীদের দমন-পীড়ন : প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিরোধীদের জব্দ ও হয়রানির জন্য দুটি (PODO ও
EBDO) বিবর্তনমূলক আইন জারি করেন। কেবল এবডো আইনের মাধ্যমেই ৮৭৭ জন রাজনীতিবিদ অযোগ্য ঘোষিত
হয়। এছাড়া সরকার সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বিরোধী রাজনীতিবিদদের অত্যাচার করে স্বেচ্ছা নির্বাসন’
বা ‘অবসর’-এর ঘোষণা আদায় করতো। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সোহরাওয়ার্দী, যিনি রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে
স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান।
সামরিক একনায়কত্ব : আইয়ুব শাসনামলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো সামরিক একনায়কত্ব।
এতে সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক দলের স্থান দখল করে ও সেনাধ্যক্ষরা রাজনৈতিক নেতাদের বিকল্প হয়ে উঠে। তাছাড়া
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তার নিজ মন্ত্রিবর্গসহ সমগ্র দেশে একমাত্র নির্বাহী ও আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ হয়ে উঠেন। বস্তুত,
তার শাসনামলে এমন এক নিরঙ্কুশ এককেন্দ্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক শাসন কায়েম হয় যা উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক
শাসনকেও হার মানায়।
আইয়ুবের শাসনামল ছিল এক মহাশূন্যতায় ভরা। কারণ গণতন্ত্র, সংসদীয় পদ্ধতি, দলীয় ব্যবস্থা ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের
অনুপস্থিতি উপরন্তু এবডো, পোডো ইত্যাদি কালাকানুন দিয়ে বিরোধী নেতৃবৃন্দের দমন-পীড়ন, বিনা বিচারে আটক,
সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক শূন্যতা।
মৌলিক গণতন্ত্র : সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো মৌলিক
গণতন্ত্র। মৌলিক গণতন্ত্র হচ্ছে এক অদ্ভুত ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যার অধীনে জাতীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে সর্বজনীন ভোটাধিকার
অস্বীকৃত হয়। অর্থাৎ জনগণের সরাসরি প্রেসিডেন্ট কিংবা আইন পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করার ক্ষমতা রহিত করা হয়।
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার : সামরিক শাসক আইয়ুব খান ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেন। তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ৯০ ভাগই ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
কাজেই তিনি তার শাসনকার্যে ইসলামি সেন্টিমেন্টকে গুরুত্বের সাথে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন।
উৎপীড়নমূলক শাসন : আইয়ুব খানের শাসন ছিল উৎপীড়নমূলক শাসন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত
আইয়ুবের কুখ্যাত দশকে দেশবাসী গুমরে মরেছে বহুবিধ পীড়নের জাঁতাকলে। দুর্নীতি দমনের নামে দেশের অনেক
জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
আমলাতন্ত্রের প্রাণহীন শাসনব্যবস্থা: আইয়ুবের সামরিক শাসনামলে সামরিক বাহিনীর সাথে আঘাত
করে আমলাতন্ত্রের বিরাট অংশ জাগতিক সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেন এবং প্রাণহীন এক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। রাজনৈতিক
সুবিধাভোগী সৃষ্টি: রাজনীতিবিদদের অনেকে নিজেদের স্বার্থে সামরিক শাসনকে সমর্থন করেন। তাছাড়া মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমেও এক ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী সৃষ্টি হয়।
সামরিক কর্তৃপক্ষের ভণ্ডনীতি : আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে দেশছাড়া করেন। তাছাড়া সামরিক বাহিনীর ১৩ জন জেনারেলকেও বরখাস্ত করেন।
প্রেসিডেন্সিয়াল শাসনব্যবস্থা: সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে মোহাম্মদ আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের সংবিধান জারি করেন। এই সংবিধানের লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল শাসনব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টের প্রভাবের চিরস্থায়িত্ব। প্রেসিডেন্টের পদই ছিল এ সংবিধানের কেন্দ্রবিন্দু, তাকে ঘিরেই সমগ্র শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতো।
অত্যন্ত সুকৌশলে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল আইয়ুব খান। জোরপূর্বক নিজের একাধিপত্য বিস্তার করে আইয়ুব খান দেশের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান,প্রগতিশীল রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেশে একক কর্তৃত্বমূলক সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রবর্তন করেন। যার ফলে অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইয়ুবের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ফাতেমা জিন্নাহ দাঁড়িয়েছিলেন, যদিও আইয়ুব খান পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানে শুধু পাকিস্তান) জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে এবং পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে অনেক বিক্ষোভ এবং মিছিল হয় এবং ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানে এক বড় ধরনের আন্দোলন হয়েছিলো। তার নির্দেশে বহু মানুষকে গ্রেফতারও করা হয়েছিলো।পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ১৯৬৯ সালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংঘটিত হয়৷ ইতিহাসে এটি গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত৷ এটি বিপ্লবাত্মক রূপ পরিগ্রহ করে৷ সকল গণতান্ত্রিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও মানুষ যার যার অবস্থান থেকে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়৷
৩ জানুয়ারি, ১৯৭১ সালের এই দিনে নির্বাচিত গণপ্রতিধিরা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো শপথ দিবস। ৩ জানুয়ারি, ১৯৭১। আড়ম্বরপূর্ণ সমাবেশের আয়োজন ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে। উদ্দেশ্য- জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় ৪১৯ জন সদস্য শপথ গ্রহণ করবেন।ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক আড়ম্বরপূর্ণ সমাবেশে ‘৭০এর নির্বাচনে জয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত আওয়ামী লীগদলীয় ৪১৯ জন সদস্য শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সমাবেশে তাঁর নীতিনির্ধারণী বক্তব্য প্রদান করেন।
অনুষ্ঠান শুরুর একপর্যায়ে ধীর স্থির পায়ে আসলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরিচালনা করলেন শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। সমাবেশে নব নির্বাচিত পরিষদ সদস্যগণ দেশে শোষণ, অবিচার ও বৈষম্যমুক্ত এক নয়া সমাজ গড়ার জন্য ১১ দফা ও ৬ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের শপথ গ্রহণ করেন তারা। পরে সমাবেশে উপস্থিত হাজার হাজার জনতার সামনে নির্বাচিত গণপ্রতিধিরা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। সেদিন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান রমান রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় বক্তৃতাকালে সাবধান করে বলেন, ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। জনতাকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, চরম ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকবেন।বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু সাজাপ্রাপ্ত ও বিনাবিচারে আটক সকল রাজনৈতিক নেতা কর্মী ছাত্র ও শ্রমিকদের মুক্তি ও সাজা মওকুফের দাবি জানান।