ছবি:লালন শাহ’র জীবদ্দশায় তৈরি করা একমাত্র চিত্র, ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা : দেবোরা জান্নাত কিউকারম্যানের লালনচর্চা ‘মানুষের কোনো দেশ নেই, সবাই আমরা এক ধরিত্রী মায়ের সন্তান’
ভূমিকা ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ : আবদুল্লাহ আল আমিন
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের মনস্বী শিক্ষার্থী,
শিল্প-চলচ্চিত্র বোদ্ধা দেবোরা কিউকারম্যানের জন্ম ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের এক অভিজাত পরিবারে। পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে। ছেঁউড়িয়ায় লালন আখড়ায় সাধুসঙ্গ দেখতে এসে মজে গেলেন লালনের ভাবরসে। ফকিরিমতে দীক্ষাগ্রহণ করে বাংলাদেশে স্থিত হয়েছেন। তিনি এখন দেবোরা জান্নাত নামে সমধিক পরিচিত। এক অনুসন্ধিৎসু পরিব্রাজকের ‘লালন সাঁইজির ঘরে’ দীক্ষাগ্রহণের গল্পটা বেশ ব্যতিক্রম।
ভারতীয় দর্শন ও স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে অ্যাংলো-আইরিশ বংশোদ্ভূত মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল (১৮৬৭-১৯১১) একদিন ব্রহ্মাচর্য গ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয়দের কাছে তিনি এখন ভগিনী নিবেদিতা। দেবোরা জান্নাত যেন একুশ শতকের আরেক ভগিনী নিবেদিতা, যিনি লালনের অধ্যাত্মবাদ, জীবনাদর্শ, গান এবং দীক্ষিত ফকিরদের সাধন-ভজন ও সাধুসঙ্গের আভায়-ঝলকে এতটাই অভিভূত ও আকুল যে, বাংলাদেশের এক নিভৃতপল্লিকে বেছে নেন তাঁর অধ্যাত্মচর্চার তীর্থভূমি হিসেবে। আমার জানামতে, মার্কিন গবেষক ক্যারল সলোমানের পর দেবোরা জান্নাতই প্রথম পাশ্চাত্য নারী যিনি লালনপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ফকিরি ধর্ম গ্রহণ করেছেন। ক্যারল দীক্ষাগ্রহণ করেন বীরভূমের সনাতন দাসের কাছে আর দেবোরা দীক্ষা নেন কুষ্টিয়ার ফকির নহির শাহর কাছে। দেবোরো জান্নাতের কর্মস্থল ও সাধনক্ষেত্র এখন কুষ্টিয়া শহর থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরে দৌলতপুর উপজেলার প্রাগপুর গ্রামের হেমাশ্রমে। ২০১৬ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশে বসবাস করছেন।
বৈচিত্র্যপ্রয়াসী দেবোরা প্রথম-যৌবন থেকে বেছে নেন পরিব্রাজকের জীবন। শিক্ষকতা-চলচ্চিত্র-সংগীতচর্চা-বন্ধুত্ব-আত্মীয়তা ও ভ্রমণসূত্রে বিশে^র নানা দেশের অজস্র গুণী বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে দেবোরার আলাপ-আলোচনা ও সম্পর্ক রচিত হয়। কিন্তু কোনো বন্ধন, কোনো সম্পর্কসূত্রই তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি নির্দিষ্ট কোনো ভৌগোলিক-দার্শনিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসীমায়। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার নেশা তাঁকে পাগল করে তোলে। থিতু মানুষের আটপৌরে জীবনের পরিবর্তে ভ্রমণ হয়ে ওঠে তাঁর নিয়তিনির্ধারিত, তাঁর রক্তে ছিল ‘ন্যাটাভিজম’, বাংলায় যাকে বলে ‘পূর্বপুরুষের স্বভাবের প্রতিধ্বনি’। স্বভাবে, আচার-আচরণে পূর্বপুরুষের একজন হয়ে ভ্রমণ করেন দেশ থেকে দেশান্তরে আপন ঠিকানা খুঁজে পেতে। ইউরোপ-এশিয়া-আমেরিকার নানা জায়গায় ঘুরেছেন, কিন্তু শান্তি-স্বস্তি খুঁজে পাননি। বারবার তাঁকে ঠিকানা বদল করতে হয়েছে নিজের প্রকৃত ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশায়। বিশে^র পঞ্চাশটির মতো দেশ পরিভ্রমণ করে সবশেষে লালনের দেশ বাংলাদেশে থিতু হয়েছেন। প্রাগপুরের ফকির নহির শাহের হেমাশ্রমের পাশে পেতেছেন ‘আপন নীড়’, নিজেকে গভীরভাবে যুক্ত করেছেন বাংলার ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে। এখানেই তিনি নতুন করে শুরু করেছেন তাঁর জীবনের পরিচয় অনুসন্ধানের যাত্রা। হেমাশ্রমের বটবৃক্ষের ছায়ার নিচে খুঁজে পেয়েছেন দুর্লভ মানবজীবনকে অর্থময় করে তোলার সঞ্জীবনী সুধা। এখানে মানুষ ও প্রকৃতি, সমাজ ও সংসার, মাটি ও অসীম আকাশের নীলিমা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে কৃষিসভ্যতার নিবিড় কোলে। গুরুজির আদেশমতে তিনি এখানে ঘর বেঁধেছেন, সংসার পেতেছেন, পেয়েছেন একটি সমাজ। সাধনসঙ্গীর কাছে শিখে নিয়েছেন কীভাবে পতিত জমিনে আবাদ করে সোনা ফলাতে হয়। শিখে নিয়েছেন মানুষ, মানবিকতা ও মানবগুরুর কাছে কীভাবে নতজানু হতে হয়। এই বিদেশিনীর বিনয়, গুরুভক্তি, নিষ্ঠা, অতিথিপরায়ণতা, অনুসন্ধিৎসা, মানবিকতা সত্যিই বিস্ময়কর। ভেবে কূল-কিনারা হারিয়ে ফেলি, কেন এই প্রিয়দর্শিনী সব ত্যাগ করে লালনের চরণদাসী হলেন? সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশ ও লালনের প্রতি প্রবল প্রেম, আবেগ-আচ্ছন্নতা তাঁর চিন্তাজগৎ, আভিজাত্য, পাশ্চাত্যের জীবনবোধকে কেমন যেন এলোমেলো করে দেয়। তাঁর চেতনার গভীরে লালনের আরশিনগর ও বারামখানার পরিধিটা
দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে বাড়তে থাকে দিনের পর দিন। তাই জাতকুলমান সব ত্যাগ করে এখানেই চলে এসেছেন, আমৃত্যু এখানেই থাকবেন বলে মনস্থির করেছেন। ভগিনী নিবেদিতা, অ্যানি বেসান্ত কিংবা ক্যারল সলোমানরা একজন গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন, তবে এদেশীয় কোনো নাগরিককে বিয়ে করেননি। কিন্তু দেবোরা কিউকারম্যান বাউল সাধক ফকির নহির শাহর কাছে দীক্ষা নিয়ে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাজন ফকিরকে ২০১৭ সালে বিয়ে করেছেন। বাউলদের জীবনাচারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন অপার শান্তি। তিনি মনে করেন, বাংলার মাটি-জল-হাওয়া, শ্যামল ছায়ার কোলে প্রতিদিন তাঁর নবজন্ম হয়, অসীম আকাশের নীলিমার দিকে তাকিয়ে খুঁজে পান বেঁচে থাকার অফুরন্ত প্রাণশক্তি। স্পষ্ট উচ্চারণে ও সাবলীলভাবে বাংলা বলতে পারেন তিনি, কমবেশি লিখতেও জানেন। কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুরের নিভৃতপল্লি প্রাগপুরের দীঘিরপাড়ে বসবাসের সুবাদে ইতোমধ্যেই তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের বাউল-ফকিরদের একটি মধুর ও হার্দিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। লালন ঘরানার বাউলরা তাঁকে আপনজন বলে মনে করেন। লালনতত্ত্ব ও বাউল দর্শন বোঝার জন্য দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সাধনসঙ্গী রাজন ফকিরকে নিয়ে হাজির হন সাধুসঙ্গে কিংবা তত্ত্ব আলোচনার আসরে। জগৎ-জীবনের রহস্য উন্মোচন, গভীরতম উপলব্ধির জন্য বিভিন্ন সাধুসঙ্গে তিনি হাজির হন, নিঃসংকোচে সেখানে রাত্রিযাপনও করেন সাধক-মহাজনদের সঙ্গে তত্ত্ব আলাপের জন্য। দেবোরা কিউকারম্যানের পারিবারিক কৌলীন্য-আভিজাত্যের প্রাচীর তাঁর সহজিয়া সাধনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ব্যবসায়ী বাবা ফ্রান্সিস কিউকারম্যান ও চিকিৎসক মা লিন্তা কিউকারম্যান তাঁর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বহুভাষা বিশারদ দেবোরা পড়াশোনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো স্টেট বিশ^বিদ্যালয়ে, ফ্রান্সের সরবোন বিশ^বিদ্যালয়সহ বিশে^র নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। স্নাতক ডিগ্রি ফিল্ম স্টাডিজে এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কালচারাল সোশিওলজি ও কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন নিয়ে।
দেবোরা জান্নাত কিউকারম্যানের প্রতি আমার আগ্রহ জাগে মূলত তাঁর লালনচর্চার কারণে। ফোনে অনেক আগেই তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। ২০২৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার প্রাগপুরের হেমাশ্রমে তাঁর মুখোমুখি হই। একনাগাড়ে প্রায় তিন ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় লালনের মানবিক দর্শন নিয়ে। তাঁর ব্যক্তি ও শিক্ষাজীবন, দীক্ষাগ্রহণ, কীভাবে লালনচর্চায় আগ্রহী হলেন, বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে অন্তরঙ্গ আলাপ হয় দেবোরার সঙ্গে। মেহেরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাসিরউদ্দীন সাক্ষাৎকার গ্রহণে আন্তরিক সহযোগিতা করেন, মাঝে মাঝে দেবোরার কথার খেই ধরিয়ে দিয়ে আলাপ-আলোচনার সময়টি গতিশীল রাখেন। সাক্ষাৎকারের মধ্যেই দেবোরা জান্নাত ও শুভ্র শেখর লালনের গান গেয়ে আসরটি প্রাণবন্ত করে তোলেন। সাক্ষাৎকার রেকর্ডিংয়ে সহায়তা করেন আঙ্গুর হোসেন ও আরিফুজ্জামান। দেবোরা জান্নাত কিউকারম্যানের দেওয়া সাক্ষাৎকারটি প্রকাশযোগ্য করে তোলার জন্য সামান্য সম্পাদনার প্রয়োজন হয়েছে, তবে কোনোভাবেই তাঁর মূল বক্তব্য পরিবর্তন করা হয়নি। লালন ফকির কীভাবে দেবোরার যাপিত জীবনকে ওলট-পালট করে দিলো, লালন তাঁর অন্তর, মস্তিষ্ক ও চেতনাজগতের কতটুকু জায়গা দখল করে আছেন, সেটিই ধরা পড়েছে এই আলাপচারিতায়। এবার আমরা মূল আলোচনায় প্রবেশ করি।
আবদুল্লাহ আল আমিন : বাংলাদেশে কবে এবং কেন এসেছিলেন?
দেবোরা জান্নাত : প্রাচ্যবাদ ও ভারতীয় ধর্মগুলি সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই আমার আগ্রহ ছিল। ২০১৬ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসি লালন অনুসারীদের সাধুসঙ্গ দেখতে। আমার মনে হলো, সাঁইজির ঘরের যাঁরা বর্তমানে সাধু বা সাধক তাঁদের আধ্যাত্মিকতা জানা দরকার। অন্য ‘ঘরে’ গেলে দেখা যাবে যে, সেখানে রাজনীতি বা অর্থনীতি ঢুকেছে হয়তো। কিন্তু বাংলাদেশে যাঁরা লালন সাঁইজিকে অনুসরণ করেন তাঁদের চর্চা এদেশে জীবন্ত। সাধুসঙ্গ পেতেই মূলত বাংলাদেশে আসা। তারপর মনটা একেবারে বসেই পড়ল। আর উঠতে চায়নি। এভাবেই দিন পার হচ্ছে।
আবদুল্লাহ আল আমিন : আপনি তো পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরছেন, কেন ঘুরছেন?
দেবোরা জান্নাত : ‘আমি কে’ এই প্রশ্ন নিয়ে ঘুরছি। কারণ নিজের পরিচয় সবাই দেখাতে পারে, কিন্তু কোনটা সত্য সেটা বেছে নিতে হয়। প্যারিসে ছেলেবেলা কাটিয়েছি, লন্ডন-আমেরিকাতে থেকেছি। আমি একসময় সিনেমাতে কাজ করতাম। আর সব সময় ইয়োগার মধ্যে একটা সাধনা ছিল। সাধনা এতই বেশি হয়ে যায় যে, চাকরি ছেড়ে ইয়োগাতে মনোযোগী হয়ে পড়ি। ওই সময়টাতে আরো বেশি করে মনে প্রশ্ন জাগে ‘কে আমি’। আসলে প্রশ্নের শেষ নেই, শেখারও শেষ নেই। তখন ফ্রান্স ছেড়ে চলে আসি ভারতে। তারপর খুঁজতে খুঁজতে বাংলাদেশে, ঢাকা এরপর প্রাগপুরের এই দীঘিরপাড়ে।
আবদুল্লাহ আল আমিন : বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আপনার আগ্রহ সৃষ্টি হলো কী করে?
দেবোরা জান্নাত : প্রথমে আমি দক্ষিণ ভারতে আসি, ভারতীয় দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে জানতে। বাংলাদেশে আসার আগে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিল না, রবীন্দ্রনাথকেও সেইভাবে জানা হয়নি। লালনকে জানার পরই রবীন্দ্রনাথকে জেনেছি। এখানে সাঁইজির আখড়ায় এসে লালনের গান শুনে, সাধুদের সৎ জীবনাচার দেখে ভালো লেগে যায়। এরপর এদেশ, এদেশের মানুষ ও তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ জন্মায়।
আবদুল্লাহ আল আমিন : লালন ও বাউলদের সম্পর্কে কীভাবে জানাশোনা হলো?
দেবোরা জান্নাত : যখন আমি ঢাকায় আসি, বাংলাদেশের বন্ধুদের অনুরোধে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় সাঁইজির মাজার ও আশ্রম দেখতে আসি। সেখানে লালনের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যাই। পরে আরো জানাশোনা চলতে থাকে। বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের লেখা পড়ে দুদ্দু শাহ সম্পর্কে জানতে পারি। আমার গুরুজি ফকির নহির শাহ, আমার স্বামী রাজন ফকিরের কাছ থেকে লালন ও অন্যান্য মহাজনের ভাবাদর্শ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি। তাদের কাছে এখনো শিখছি। বইপত্র পড়ে তেমন কিছু শিখতে পারিনি।
আবদুল্লাহ আল আমিন : বাংলা ভাষা কীভাবে ও কার কাছে শিখেছেন?
দেবোরা জান্নাত : বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারি যে, বাংলার আধ্যাত্মিকতা ও লালনকে জানতে হলে, বুঝতে হলে বাংলা ভাষাটা রপ্ত করা দরকার। বাংলা ভাষা শিখেছি প্রাগপুরের হেমাশ্রম থেকে। আমার গুরুজি, আমার স্বামী ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের সাহায্য নিয়ে বাংলায় কথোপকথন রপ্ত করে নিই, পরে নিজে নিজে চেষ্টা করেছি। লেখা শিখেছি আমাদের আশ্রমের আশেপাশে যেসব স্কুলগামী ছেলেমেয়ে আছে, তাদের কাছে। তারা আমাকে বাংলা হরফ কীভাবে লিখতে তা ধরে ধরে শিখিয়েছে। এক্ষেত্রে তারাই আমার শিক্ষক।
আবদুল্লাহ আল আমিন : বাংলা ভাষা, বাঙালিত্ব, বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি সর্বোপরি লালনপ্রেমে মজে বাংলাদেশের এক অখ্যাত গ্রামে সারাজীবনের জন্য থিতু হয়েছেন, আপনি কী নিজেকে বাঙালি ভাবেন?
দেবোরা জান্নাত : একটি ঘটনা না বলে পারছি না, আমার বাবা মাঝেমধ্যে ভারতে আসেন কাজের জন্যে। গতবছর বাবা মুম্বাইতে এলে আমি দেখা করতে যাই। সারাদিন বাবা অফিসে ছিলেন, তাই আমি ঘুরতে গেলাম। আজব লাগলেও ভালো লাগছে ভেবে যে, কী এমন দেখে এখানকার মানুষ আমাকে বাঙালি বলতে পেরেছে? ফ্রান্সে থাকতে শ্যামলা চামড়া, লম্বা নাক, কোঁকড়া চুল, অদ্ভুত নাম আমাকে অভিবাসীর নাতনি চিহ্নিত করত। লন্ডনে থাকতে আমার চলাফেরা ও রুচি আমাকে ফরাসি চিহ্নিত করত। ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকতে আমার ইংরেজি উচ্চারণ আমাকে ব্রিটিশ হিসেবে চিহ্নিত করত। আবার সুইজারল্যান্ডে থাকতে আমার উচ্চারণ আমাকে ফরাসি চিহ্নিত করত। বাংলাদেশে আমি বিদেশিনী হয়েই থাকলাম, মুম্বাইয়ে তবু বাঙালি হতে পেরেছি, এই আমার আনন্দ। আমি সর্বকালে সর্বস্থানে বিদেশি, এই বোধটা আমার অস্তিত্বের শিকড়, আত্মানুসন্ধানের মূল্যবান প্রেরণা। এই মুহূর্তে লালন সাঁইজির একটি পদ মনে পড়ছে : ‘কোথা হতে আসিলাম হেথায়,/ আবার আমি যাই যেন কোথায়।/ তুমি মনোরথের সারথী হয়ে/ স্বদেশে লও মনেরই।।/ এসো হে অপারের কাণ্ডারী।’
আবদুল্লাহ আল আমিন : বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাউলদের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য দেখতে পেয়েছেন?
দেবোরা জান্নাত : বাংলাদশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাউলদের মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাউলরা বেশ অবস্থাসম্পন্ন, বাংলাদেশের বাউলরা তত অবস্থাসম্পন্ন নন। পশ্চিমবঙ্গের বাউলদের মধ্যে বিনয়-ভক্তিটা আছে যেটা তারা সনাতন ধর্ম থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন, তবে লালনদর্শনের নিগূঢ় ভাবরসটা তেমন বোঝেন না। তাঁরা মূলত বাউলগানের গায়ক হয়ে নিজেদের জাতে তুলতে চান। কিন্তু বাংলাদেশের সাধকরা লালনের তত্ত্ব, দর্শন ও আধ্যাত্মিক দিকগুলি বেশ শুদ্ধভাবেই বোঝেন।
আবদুল্লাহ আল আমিন : যতটুকু জানি, সাধন-ভজনের ফাঁকে অনুবাদ করে চলেছেন আপনি। এ পর্যন্ত কটি গান অনুবাদ করেছেন?
দেবোরা জান্নাত : লালন নিয়ে গবেষণা করতেই এখানে এসেছিলাম, তবে এখন আর আমি লালন-গবেষক নই, আমি একজন দীক্ষিত ফকির, ফকিরিমতে সাধন-ভজন করি। অনুবাদ করা আমার কাজ নয়, তবে লালনের বেশ কিছু গান আমি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছি। লালনের গান যখন অনুবাদ করতে বসি, তখন খেয়াল করি যে, সাঁইজির সব গান আসলে অনুবাদ করা সম্ভব নয়। সাঁইজি তাঁর অন্তরের উপলব্ধি থেকে যে কথাগুলি বলেছেন সেগুলি অন্য ভাষায় পড়তে গেলে মূলভাবটা উপলব্ধি করা যায় না। যেমন, ‘মায়েরে ভজিলে হয় সে বাপের ঠিকানা/ নিগূঢ় বিচারে সত্য গেল তাই জানা।।’ কিংবা ‘তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।/ তিন পাগলে হলো মেলা নদে, এসে।।’ … গানগুলির ইংরেজি বা ফরাসিতে রূপান্তর পড়লে বা শুনলে মূলভাবের কাছে পৌঁছানো যায় না। আরো অনেক গান আছে যেগুলি খুব সহজ-সরল ভাষায় রচিত, কিন্তু অনুবাদ করা খুব কঠিন।
আবদুল্লাহ আল আমিন : আপনি কার কণ্ঠে লালনের গান শুনতে ভালোবাসেন? আখড়ার সাধকদের কণ্ঠে লালনের গান কেমন লাগে?
দেবোরা জান্নাত : আমাদের আশ্রমে কোনো
রেডিও-টেলিভিশন থাকে না, কোনো পেশাদার শিল্পীর গান শোনা হয় না। বিভিন্ন সাধুসঙ্গে ও আমাদের আশ্রমে বসে মরমি ও রসিকজনদের কণ্ঠে কেবল সাঁইজি ও অন্য মহৎদের গান শুনে থাকি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কিংবা গানের মাহফিলের পেশাদার শিল্পীদের গান শুনে লালনের আধ্যাত্মিক ভাবতত্ত্বটা বোঝা যায় না। সাঁইজির গান আসলে কোনো মাহফিল বা মিডিয়ার গান নয়, সস্তা বিনোদন বা লোকরঞ্জনের জন্য এই গান রচিত হয়নি। এ গান আসলে নির্জন পথের যাত্রীর একান্ত আধ্যাত্মিক উপলব্ধির গান, নিজেকে জানাবোঝা ও উপলব্ধির জন্য এটা গাইতে হয়, শুনতে হয়। তাই প্রথাগত ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কণ্ঠে গান শুনে তেমন ভালো লাগে না, তবে টুনটুন বাউল, কিরণচন্দ্র রায়ের গান শুনতে ভালোবাসি। আমার গুরুভাই ও বোনেরাও আমাকে গান শোনান। আমার গুরু নহির শাহও ভালো গাইতে পারেন, অসংখ্য গান তিনি জানেন এবং সেগুলির ব্যাখ্যা করতে পারেন। আমি যতটুকু জানি, লালনের গান ও দর্শনের অনেক বড়মাপের ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক তিনি।
আবদুল্লাহ আল আমিন : লালনের গানের বাণী ও আদি আখড়ার সুর সংরক্ষণ করার উপায় কী?
দেবোরা জান্নাত : পেশাদার শিল্পীদের দিয়ে এ-গানের বিকৃতি রোধ করা যাবে না। সাধু-গুরু, মরমি-মর্মজ্ঞ রসিকজনরা থাকলে এ-গান থাকবে, না-থাকলে থাকবে না। তবে খোদা বকসো সাঁইজি, আবদুল করিম শাহদের মতো সাধক-গায়কদের দিয়ে যদি ছেঁউড়িয়ায় একটি সংগীত বিদ্যালয় খোলা যায়, তাহলে এ-গানের আদি সুর ও ভাব সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
আবদুল্লাহ আল আমিন : লালন আপনার জীবনে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন। লালনের কোন গানগুলি আপনাকে সবচেয়ে বেশি স্পন্দিত করে, ভালো লাগে?
দেবোরা জান্নাত : আমার অন্তর-বাহিরজুড়ে যিনি সদাসর্বদা বিরাজ করেন তিনি লালন। লালনের সব গান এখনো শোনা হয়নি, যেগুলি শুনেছি তার মধ্যে কয়েকটি গান আমার খুব ভালো লাগে। যেমন, ‘ভেদ পরিচয় দেয় না আমায়/ চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি’, ‘মিলন হবে কতদিনে আমার মনের মানুষের সনে’, ‘তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে’, ‘ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে’, ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’, ‘আমার মন চোরা রে কোথা পাই’ – এই গানগুলি আমার খুব ভালো লাগে।
আবদুল্লাহ আল আমিন : আপনি কি মনে করেন, লালনের গানে আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা ও বিশ^মানব মৈত্রীর ইঙ্গিত রয়েছে?
দেবোরা জান্নাত : লালন সারাজীবন মানুষের ভজনা করেছেন। ধর্ম সম্পর্কে তাঁর বেশ জানাশোনা ছিল, কিন্তু ধর্মের চলতি ব্যাখ্যাটা তিনি মানতেন না, তাঁর ব্যাখ্যা আলাদা রকমের ব্যাখ্যা। ধর্মের নামে, জাতির নামে যে দলাদলি ও ভেদাভেদ রয়েছে সেটা সমর্থন করতেন না। মানুষ ভজনিয়া হিসেবে তিনি সর্বজনীন মানবধর্মে বিশ^াস করতেন, বেদ-বেদান্ত, শাস্ত্র-কেতাব নিয়ে তিনি অত ঘাঁটাঘাঁটি করে সমস্যা সৃষ্টি করতে চাননি। লালনের ভাবতত্ত্ব বুঝতে হলে ধর্ম ও শাস্ত্রকারদের বানানো ধর্মতত্ত্বের মধ্যকার ফারাকটা বুঝতে হবে। তিনি ধর্মের মূলভাবকে ধর্মতাত্ত্বিকতা, শাস্ত্রাচার ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে নিয়ে এসে তাকে আরো উপযোগী ও পরিপুষ্ট করতে চেয়েছেন। তিনি ধর্মের আচার-কারবার নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, কিন্তু ধর্মকে অস্বীকার করেননি। ধর্মের নিগূঢ় ভাব আকণ্ঠ পান করে সারাজীবন ধর্মধ্বজী এবং প্রাতিষ্ঠানিক সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নিরাপস লড়াই চালিয়ে গেছেন। তথাকথিত সেক্যুলারপন্থীরা যখন ধর্মীয় মৌলবাদ, হানাহানি, জাতপাতকে মোকাবিলা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তখন লালনের গান ও জীবনাদর্শ মানবিকতা ও মানবমৈত্রীর বার্তা দিয়ে আমাদের সাহস জুগিয়ে চলেছে। ফ্রান্স বা ইউরোপের সেক্যুলারিজম মানুষের নিরাপত্তা-সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না, কারণ আধ্যাত্মিকতাকে অস্বীকার করে মহৎ সমাজ নির্মাণ করা যায় না।
আবদুল্লাহ আল আমিন : লালনের জাতধর্ম, পরিচয় ও জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে আপনর মতামত কী?
দেবোরা জান্নাত : জাতকুল, জন্মস্থান, গাত্রবর্ণ মানুষের জন্য কী খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়? আসলে মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই, মানুষের কোনো দেশ নেই, সবাই আমরা এক ধরিত্রী মায়ের সন্তান। আপনি ‘আল্লাহ’ কিংবা ‘ভগবান’ বলেন, আমি ‘মুর্শিদ’ বলি। আমরা সবাই কিছুদিনের জন্য দুনিয়ায় আসি, তারপর শূন্য হাতে বিদায় নিই। লালন নিজেকে এক অখণ্ড মানবসত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করতেন; জাতকুল, ধর্মপরিচয় নিয়ে অযথা তর্ক করতে চাননি। নিজের বংশগত পরিচয় ও জাতপরিচয় ইচ্ছে করেই গোপন করেছিলেন, কেবল মানুষ পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার জন্য নিজ পরিচয় গোপন রেখেছিলেন। তাহলে এ নিয়ে বিতর্ক করার কী-ই বা আছে? আমরা যারা লালনের ঘরের লোক তারা সাদা-কালোর, পূর্ব-পশ্চিমের ভেদ মানি না।
আবদুল্লাহ আল আমিন : লালনকে আমরা নানাভাবে চিনি, নানাভাবে তাঁর দর্শনকে আমরা ব্যাখ্যা করি। লালন মরমি সাধক, লালন সুফি সাধক, লালন গীতরচয়িতা, লালন জাতপাত-সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে দৃপ্ত কণ্ঠস্বর, লালন মানবতাবাদী। এর মধ্যে তাঁর কোন পরিচয় আপনার মনকে বেশি নাড়া দেয়?
দেবোরা জান্নাত : লালন এক মহাভাবসমুদ্রের নাম। তিনি গুরু, দাতা ও মানবের মুক্তিপিয়াসী ত্রাতা। তাঁকে নানাভাবেই আমরা চিনি, একজন সমাজচিন্তাবিদের কাছে তিনি জাতপাতবিরোধী সংগ্রামের অগ্রসৈনিক, একজন সাহিত্য-সমালোচকের কাছে তিনি গীতরচয়িতা, তরিকাপন্থীদের কাছে সুফি সাধক এবং কারো কারো কাছে তিনি মরমি সাধক। আমাদের কাছে তিনি সাঁইজি – মহামান্য মহাজন।
আবদুল্লাহ আল আমিন : আপনি কী মনে করেন, লালনের আধ্যাত্মিক চিন্তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক চেতনার বীজ নিহিত আছে। এটা একুশ শতকীয় বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকেও প্রভাবিত করে।
দেবোরা জান্নাত : লালন একজন যুক্তিবাদী ভাবুক ছিলেন। তিনি সবকিছু নিয়ে তর্ক করেছেন, প্রশ্ন করেছেন, অন্ধভাবে কোনোকিছু মেনে নেননি। লালনের গান ও সাধন-ভজন প্রক্রিয়ার মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা আছে কি না জানি না, তবে তাঁর আধ্যাত্মিক ভাবনার মধ্যে যুক্তিবাদিতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছাপ অবশ্যই আছে।
আবদুল্লাহ আল আমিন : উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, মনসুরউদ্দীন প্রমুখ লালন নিয়ে গবেষণা করেছেন। এঁদের কাজ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
দেবোরা জান্নাত : শুনেছি, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য অনেক বড়মাপের গবেষক ও সংগ্রাহক ছিলেন আর মনসুরউদ্দিনের হারামণি এক অমূল্য গ্রন্থ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রশংসা করেছেন। তবে সুধীর চক্রবর্তীর গভীর নির্জন পথে বইটি আমি বারবার পড়ি, খুব সহজ করে তিনি বাংলার সাধকদের ভাবতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। শক্তিনাথ ঝাঁর লেখাও আমার ভালো লাগে।
আবদুল্লাহ আল আমিন : ফরাসি ভাষায় লালনের গান অনুবাদ করেছেন মাহমুদ শাহ কোরেশী। তাঁর অনুবাদ কী আপনি পড়েছেন? ফ্রান্সে বা ইউরোপে লালন নিয়ে কারা গবেষণা করছেন, এ-সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
দেবোরা জান্নাত : মাহমুদ কোরেশীর ফরাসি অনুবাদ পড়া হয়নি, তবে অনেকগুলি ইংরেজি অনুবাদ পড়েছি।
ইউরোপ-আমেরিকায় অনেকেই লালন নিয়ে কাজ করছেন। ব্রাদার জেমস, এডওয়ার্ড ডিমক, ক্যারল সলমন, ফাদার রিগনের নাম স্মরণ করা যায়। অনুবাদক হিসেবে তৃপ্তি ব্রহ্মের নাম খুব শুনেছি। মুচকুন্দে দুবে ও দেবযানী চালিহার নামও শুনেছি।
আবদুল্লাহ আল আমিন : লালনের গান আপনার প্রাত্যহিক-প্রার্থনার অঙ্গ হয়ে উঠেছে। জানতে ইচ্ছে করে, আপনার শাস্ত্র বা ধর্মমতের সঙ্গে লালনের গানের মিলটা কোথায়?
দেবোরা জান্নাত : বিষয়টি এভাবে বোধ হয় বলা যায় না, খ্রিষ্টীয় রীতিতে উপাসনা বলতে আক্ষরিক অর্থে যা বোঝায় সেরকম কিছু আমি করি না বা তার সঙ্গে অভ্যস্তও নই। আমার বাবা-মা, এমনকি গ্র্যান্ডফাদার কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারী ছিলেন না, তাঁরা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আচার পালন করতেন না। আমাদের ফ্রান্সে অধিকাংশ মানুষের কাছে ধর্ম পালন বা অধ্যাত্মচর্চা তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বরং কোনো মানুষকে তার ধর্মপরিচয় জিজ্ঞাসা করা এক ধরনের অভব্যতা, এক ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ। ওখানে কারো ধর্মপরিচয় জিজ্ঞাসা করা হয় না। আমি বাবা-মা কিংবা ভাইবোনদের সঙ্গে ক্রিসমাস ডে উপলক্ষে
দু-একবার চার্চে গেছি, নিয়মিত যাওয়া হয়নি। আমি মনে করি, লালনসংগীত কোনো প্রার্থনাসংগীত নয়, এটা সাধকের আত্মোপলব্ধির গান। এই গানে বাণী দিয়ে আমার ‘আমি’কে চিনে নিতে হয়।
আবদুল্লাহ আল আমিন : বাউল সম্প্রদায় এখন ক্ষয়িষ্ণু, আখড়া-আশ্রমগুলি ভেঙে পড়েছে। আপনি কী মনে করেন, এই সম্প্রদায়ের আইনগত সুরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন? কীভাবে এটা নিশ্চিত করা সম্ভব?
দেবোরা জান্নাত : এটা সত্য যে, বাউল গান তথা লালনের গান বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও অধ্যাত্মভাবনাকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সম্প্রদায়ের জীবনাচার, দর্শন ও গান নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই এরা টিকে আছেন। তবে আখড়া-আশ্রম ও সাধু-দরবেশদের রক্ষার জন্য আইনগত সুরক্ষা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে আমার হয় না। সরকারি সহযোগিতা দিয়ে একটি সম্প্রদায় বা কাল্টকে টিকিয়ে রাখতে হবে, এমন চিন্তার পক্ষপাতী আমি নই। ফ্রান্সেও তো মানুষকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান করা হয়, ধর্মচর্চার স্বাধীনতা আছে, সেখানে কী ধর্মীয় সহিংসতা, খুনোখুনি কমেছে? ইউরোপেও ধর্মের নামে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সমাজটা অনেক মহৎ, অনেক মানবিক, এখানে মানুষে মানুষে আত্মীয়তা, সৌহার্দ্য-সহবত আছে।
আবদুল্লাহ আল আমিন : লালন ফকির ছাড়া আর কোন কোন সাধক সম্পর্কে আপনার আগ্রহ রয়েছে?
দেবোরা জান্নাত : লালন ফকির ছাড়া দুদ্দু শাহ সম্পর্কে আমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। দুদ্দু শাহ ছিলেন লালনতত্ত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক। লালনকে বুঝতে হলে দুদ্দু শাহের গান বোঝা দরকার।
আবদুল্লাহ আল আমিন : দিদি, লালন আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে জমিদার-নিয়ন্ত্রিত এক অনগ্রসর সমাজে জন্মগ্রহণ করেন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। কিন্তু তাঁর গানের ভাষা বিশ্লেষণ করলে তাঁকে কী অনগ্রসর নিরক্ষর মনে হয়? বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দাঁড়িয়ে কী করে সম্ভব হলো তাঁর এই অর্জন?
দেবোরা জান্নাত : সাঁইজি বিদ্যাবুদ্ধিহীন নিরক্ষর ছিলেন – এ-মতের সঙ্গে আমি একমত নই। স্কুল-কলেজে হয়তো তিনি পড়েননি, তারপরও তিনি লেখাপড়া জানতেন। তাঁর গানের বাণীবৈচিত্র্য, প্রকাশভঙ্গি, ধ্বনিমাধুর্য, ভাষাশৈলী বিশ্লেষণ করলে তাঁকে উচ্চস্তরের ভাবুক বলে মনে হয়। আধ্যাত্মিকতা ও মনের জোর ছিল বলেই তাঁর পক্ষে এমন উচ্চ ভাবসমৃদ্ধ গান বাঁধা সম্ভব হয়েছে। আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে, তিনি যে সুন্দর মানবিক সমাজের কথা চিন্তা করেছিলেন এবং ভেদহীন সমাজ রচনার জন্য লড়েছিলেন, তা সত্যিই ভাবার বিষয়। তিনি চেয়েছিলেন মানুষে মানুষে হানাহানি বন্ধ হোক, ভেদাভেদ দূর হোক, ঝগড়াঝাঁটি বন্ধ হোক। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার সবটা পূরণ হয়নি, দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ বিদ্বেষ-হানাহানির পথেই রয়েছে।
আবদুল্লাহ আল আমিন : লালন শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্দরেও ঢুকে পড়েছেন। শিক্ষিতরাও লালনের গানের পাঠগ্রহণ করে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। আপনি কী মনে করেন, মুক্তবুদ্ধির মানবিক সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রামে লালন আজো প্রাসঙ্গিক?
দেবোরা জান্নাত : লালনের গানের শিল্পসৌকর্যে এখন বাঙালি মধ্যবিত্ত মুগ্ধ। বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়ারাও তাঁর গান শোনে এবং গায়, কুষ্টিয়ার এক খ্যাতিমান ডাক্তারের চেম্বারেও লালনের পোর্ট্রটে ও একতারার রেপ্লিকা দেখেছি। আখড়ার গান এখন নাগরিক মধ্যবিত্তের অন্দর থেকেও ভেসে আসছে। বাংলা গানের খ্যাতিমান শিল্পীরাও এ-গানে কণ্ঠ দিচ্ছেন। ইউনেস্কো লালন তথা বাউলগানকে ‘a Masterpiece of the Oral and Intangible Heritage of Humanity’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে অনেকেই উচ্ছ্বসিত হয়েছেন, উৎসাহ পেয়েছেন। কিন্তু এই মাতামাতিটা আমি সমর্থন করি না। দোলপূর্ণিমা কিংবা সাঁইজির তিরোধান দিবসে রথী-মহারথীরা যে মাতামাতি ও বাড়াবাড়িটা করছেন, সেটা আমি জোর গলায় সমর্থন করতে পারছি না। এতে করে আমাদের সাধন-ভজনে ব্যাঘাত ঘটছে, অনেক উটকো লোক যশ-খ্যাতির লোভে এই সমাজে ঢুকে পড়ছে।
আবদুল্লাহ আল আমিন : নানা কাজে আপনাকে দুই বাংলার বহু গ্রাম ঘুরতে হয়েছে। গ্রামবাংলার মানুষ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
দেবোরা জান্নাত : বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার বহু গ্রাম আমি ঘুরেছি, ঢাকা-কলকাতাতেও থেকেছি। নবদ্বীপে গেছি, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের অনেক আখড়া-আশ্রমে গেছি, সেখানে সাধু-দরবেশদের সান্নিধ্য পেয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ অসাধারণ, তারা খুব সরল-সহজ ও অতিথিপরায়ণ। তাদের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ, এখানে একটি সমাজ আছে, আত্মীয়তা আছে, মানুষে মানুষে সম্পর্ক আছে। আর প্রাগপুরের মানুষ খুব সহজ-সরল, এখানে বিনোদনের তেমন সুযোগ নেই, তবুও বেশ কেটে যাচ্ছে সময়। তবে ইদানীং গ্রামবাংলার হালচাল বদলে যাচ্ছে, তারা এখন মারাত্মকভাবে আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী হয়ে উঠছে। ইউরোপীয় পুঁজিবাদী ভোগবাদী
সংস্কৃতির ধাক্কায় এদেশের গ্রামগুলি হয়তো বদলে যেতে পারে।
আবদুল্লাহ আল আমিন : আমরা এখন আলোচনার শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। এবারে আপনার প্রিয় একটি লালনের গান প্রথমে বাংলায় পরে ফরাসি রূপান্তরে আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।
দেবোরা জান্নাত : আমি মানুষকে ভালোবেসেছি, মানুষও আমাকে ভালোবাসা দিয়েছে। বিশ^াস করেছি, আবার ঠকেছিও। তবু মানুষকে ভালোবাসতে হবে, তবু বিশ^াস করতে হবে। মানুষকে ভালোবেসে আমি সব ত্যাগ করেছি। তাই ‘কুল-মান সব গেলো রে’ গানটি আমার খুব ভালো লাগে।
কুল-মান সব গেলো রে,
তবু না পেলাম তারে।
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে,
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে
তাই গগন ভেবে মরে –
মরি হায় রে হায় রে…
আবদুল্লাহ আল আমিন : এ তো হলো বাংলায়, গানটি কি ফরাসি রূপান্তরে গেয়ে শোনাবেন।
দেবোরা জান্নাত : ফরাসি রূপান্তরে এ মুহূর্তে গাইতে পারছি না, তবে ইংরেজিতে গাইছি
Lost the race, lost the class
Yet didn’t find anything
Not a drop of love within,
No way to see
Where to search, how to know,
And so Gogon dies thinking.
আবদুল্লাহ আল আমিন : দিদি, ব্যস্ততার মধ্যেও আজকের সারাদিনটাই আপনি আমাদের সঙ্গে কাটালেন, আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা, ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। খুব ভালো থাকবেন।
দেবোরা জান্নাত : আপনাকে ধন্যবাদ। আপনিও ভালো
থাকবেন। জয় গুরু।