সময়ের কথন 🇧🇩 আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নিষিদ্ধের ইতিহাস
সরকারের নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাস দমন আইনের ১৮ ধারায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ জামায়াতের সব ধরনের সহযোগী সংগঠনকে।
১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর পাকিস্তানভিত্তিক এই রাজনৈতিক দলটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় গণহত্যায় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
১৯৭৫ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এবং কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের পালাবদলে ১৯৭৭ সালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে দলটির নেতা-কর্মীরা দেশে ফিরে আসার অনুমতি পান এবং ১৯৭৯ সালের মে মাসে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেয়া হয়। মূলত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর একটি শাখা।
পাকিস্তান আমলে জামায়াত দুই বার নিষিদ্ধ
উনিশশো আটচল্লিশ সালে ইসলামি সংবিধানের দাবিতে প্রচারণা শুরু করলে পাকিস্তান সরকার জননিরাপত্তা আইনে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীকে গ্রেফতার করে। তবে ওই বছর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও জামায়াতের কার্যক্রম শুরু হয়। দু’বছর পর মি. মওদুদী জেল থেকে ছাড়া পান।
এর মধ্যেই নেতা হিসেবে উঠে আসেন গোলাম আজম এবং উনিশশো সাতান্ন সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত হন।
রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ১৯৫৮ সালে অন্য সব দলের সাথে জামায়াতের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করেন তখনকার সেনা শাসক আইয়ুব খান।
এরপর মুসলিম পারিবারিক আইন ও শিক্ষা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেয় দলটি। বিশেষ করে মুসলিম পারিবারিক আইন নিয়ে তুমুল সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতাও তৈরি হয় তখন এবং সেজন্য জামায়াতকেও দায়ী করেন অনেকে।
উনিশশো চৌষট্টি সালের জানুয়ারিতে জামায়াতকে আবার নিষিদ্ধ করা হয়। মওদুদী ও গোলাম আজমসহ অনেককে আটক করা হয়। সে বছরের শেষ দিকে দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ১৫১টি আসনে প্রার্থী দিয়ে চারটি আসন পায় দলটি।
মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা ও স্বাধীন দেশে নিষিদ্ধ
জামায়াতে ইসলামী দল হিসেবে এবং এর নেতারাও সক্রিয়ভাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেন। তখন পাকিস্তানি শাসকদের সহযোগিতায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।
এই দলটির নেতৃত্বেই রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী হয়েছিলো যারা ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডসহ যুদ্ধকালীন গণহত্যায় সহযোগিতার জন্য তীব্রভাবে সমালোচিত। ১৯৭২ সালে লন্ডনে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধার কমিটি গঠন করেছিলেন গোলাম আজম।
বাংলাদেশের বিরোধিতা ও গণহত্যায় সহায়তার জন্য ১৯৭৩ সালে যে ৩৮ জনের নাগরিকত্ব সরকার বাতিল করেছিলো গোলাম আজমও ছিলেন তার একজন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের বাইরে থাকা জামায়াত নেতারা আবার দেশে ফিরতে শুরু করেন।
উনিশশো ছিয়াত্তর সালে গোলাম আজম নাগরিকত্ব ফেরতের জন্য আবেদন করলেও সে আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে তিনি ঢাকায় আসেন। এরপর আর ফিরে যাননি।
উনিশশো উনআশি সালে ঢাকায় এক সম্মেলনের মাধ্যমে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ গঠিত হয়। সেখানে গোলাম আজমকে অনেকটা গোপনে আমির করে প্রকাশ্যে আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমির ঘোষণা করা হয়।
জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়েছে ২০২৪ এ
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাস-সহিংসতার সঙ্গে সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। সরকার বিশ্বাস করে, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর অঙ্গসংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত নয়।
তাই সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ১৮ (১) ধারার ক্ষমতাবলে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণাসংক্রান্ত ১ আগস্টের প্রজ্ঞাপন বাতিল করল।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১ আগস্ট জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত।
১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটির যাত্রা শুরু হয়। সেই আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো ২০২৫
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচারকার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল রাতে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠনের অবস্থান কর্মসূচি চলার মধ্যেই সরকারের তরফে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার অদূরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের কয়েক হাজার নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছিলেন। সর্বশেষ তারা মার্চ টু যমুনা ঘোষণা দেন। এমন অবস্থায় যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক বসে। বৈঠক শেষে রাত এগারোটায় সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এ ছাড়াও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণা প্রস্তুতেরও সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান আইন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিপত্র পরবর্তী কর্মদিবসে জারি করা হবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত থেকে গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ব্যানারে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করছিল ছাত্র-জনতা। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফরমগুলো অংশ নেয়। শনিবার আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে চলা অবস্থানে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটির যাত্রা শুরু হয়।
দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৫ সালে দলটির নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও দলটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
সে সময়কার কর্মকাণ্ডের জন্য ’৭১-এর ২৬শে মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও স্বাধীনতা পরবর্তী নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত হয় দলটি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার।
তার মেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সর্বশেষ টানা ১৬ বছরের শাসনামল দেশের ইতিহাসে গুম, খুন আর লুটপাটের রেকর্ড গড়ে। ক্ষমতায় থাকতে বিনা ভোট, রাতের ভোটের নির্বাচন করে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়েও ঘৃণ্য ইতিহাস তৈরি করে দলটি। প্রবল গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। দেশ ছেড়ে পালান দলের প্রায় সব শীর্ষ নেতা। যারা দেশে আছেন তারাও রয়েছেন আত্মগোপনে।
এরপর থেকেই ছাত্র-জনতা গণহত্যার অপরাধে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি তুলে আসছে। ২৩শে অক্টোবর সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা হয়েছে। এসব মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত করতে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে।
ওদিকে গতকাল রাতে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা উল্লাস প্রকাশ করে। শাহবাগে আন্দোলনকারীদেরও উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা যায়।
আইন যা বলে
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন যদি আইন লঙ্ঘন করে, তাহলে সরকার সেটি নিষিদ্ধ করতে পারে। এমনকি তাদের সম্পদ ও তহবিল বাজেয়াপ্ত করারও সুযোগ রয়েছে।
এই আইনের ‘ধ্বংসাত্মক সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ’ অধ্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোও অন্তর্ভুক্ত।
১৯৭৮ সালের রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা বা নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর কোনো মতাদর্শ প্রচার বা কার্যকলাপের উদ্দেশ্যে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না।’
এতে আরও বলা হয়, কোনো রাজনৈতিক দল ‘গোপন সংগঠন (আন্ডারগ্রাউন্ড অর্গানাইজেশন), গ্রুপ বা সংস্থাকে সহযোগী সংগঠন হিসেবে রাখতে পারবে না; বা কোনো ‘সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী’, ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ বা অন্য কোনো ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী’ গঠন বা পরিচালনা করতে পারবে না।’
এছাড়া, ২০০৯ সালে প্রণীত সন্ত্রাসবিরোধী আইনেও সন্ত্রাস সংশ্লিষ্ট অপরাধ ও শাস্তির বিধান রয়েছে। এই আইনের আওতায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের লক্ষ্যে গঠিত হয় এন্টি-টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)।
এই আইনগুলো ব্যবহার করেই বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আগেও যেভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ হয়েছিল
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি ও হেফাজতে ইসলাম যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ আবারও এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।
গতকাল (৯ মে) অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে আইনের কোনো সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ কয়েকটি আইন রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে উপদেষ্টাদের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। তবে পদ্ধতি নিয়ে ব্যক্তিগত মত থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে, চাইলে আমরা কয়েক দিনের মধ্যেই আইসিটি আইন সংশোধন করতে পারি। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনসহ আরও কিছু আইন রয়েছে। কাজেই আইনের কোনো সমস্যা নেই।’
তবে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আইনের ভিত্তিতেই একাধিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ হয়েছে।
আইন যা বলে
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন যদি আইন লঙ্ঘন করে, তাহলে সরকার সেটি নিষিদ্ধ করতে পারে। এমনকি তাদের সম্পদ ও তহবিল বাজেয়াপ্ত করারও সুযোগ রয়েছে।
এই আইনের ‘ধ্বংসাত্মক সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ’ অধ্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোও অন্তর্ভুক্ত।
১৯৭৮ সালের রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা বা নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর কোনো মতাদর্শ প্রচার বা কার্যকলাপের উদ্দেশ্যে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না।’
এতে আরও বলা হয়, কোনো রাজনৈতিক দল ‘গোপন সংগঠন (আন্ডারগ্রাউন্ড অর্গানাইজেশন), গ্রুপ বা সংস্থাকে সহযোগী সংগঠন হিসেবে রাখতে পারবে না; বা কোনো ‘সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী’, ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ বা অন্য কোনো ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনী’ গঠন বা পরিচালনা করতে পারবে না।’
এছাড়া, ২০০৯ সালে প্রণীত সন্ত্রাসবিরোধী আইনেও সন্ত্রাস সংশ্লিষ্ট অপরাধ ও শাস্তির বিধান রয়েছে। এই আইনের আওতায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের লক্ষ্যে গঠিত হয় এন্টি-টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)।
এই আইনগুলো ব্যবহার করেই বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নিষিদ্ধের ইতিহাস
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সকল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে। এতে জামায়াতে ইসলামি-সহ অন্যান্য দলও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি সায়েমের শাসনামলে ১৯৭৬ সালে জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে দলটি পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করে।
তবে ২০১৩ সালে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামির নিবন্ধন বাতিল করে। কারণ হিসেবে দলটির গঠনতন্ত্র দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়। ফলে দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারায়।
২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দেশব্যাপী আন্দোলনের সময় সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগে জামায়াতকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় নিষিদ্ধ করে। তবে গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার প্রমাণের অভাবে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে।
একই বছর জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরও নিষিদ্ধ হয় এবং অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
তবে জামায়াত আবার বৈধতা পেলেও পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (পিবিএসপি) এবং পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (পিবিসিপি) এখনো নিষিদ্ধ। এই দুটি চরম বামপন্থি মাওবাদী সংগঠন সশস্ত্র বিদ্রোহ ও চরমপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে এখনও নিষিদ্ধ রয়েছে।
সবশেষ ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ১৮(১) ধারায় ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতার কারণে নিষিদ্ধ করা হয়।
তবে রাজনৈতিক দলের বাইরেও একাধিক সংগঠনও নানা সময়ে নিষিদ্ধ হয়েছে।
সম্প্রতি, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে সক্রিয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট আলোচনায় আসে। জাতিগত এই সশস্ত্র সংগঠনটি একাধিক ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ‘রাষ্ট্রের শত্রু’ আখ্যা দিয়ে দমন অভিযান চালায়। যদিও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক গেজেট প্রকাশ হয়নি।
এর আগে, ২০০৫ সালে দেশব্যাপী একযোগে বোমা হামলার পর জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশকে (জেএমবি) সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০০৯ সালে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ উসকে দেওয়া ও খেলাফত কায়েমের প্রচেষ্টার অভিযোগে হিজবুত তাহরিরের বাংলাদেশ শাখাকেও নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এ নিষেধাজ্ঞা এখনো বলবৎ থাকলেও দলটি এখনও দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।