ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিঙ্গুইসড প্রফেসর। ‘দ্য ডিপ্লোম্যাটে’ প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ থেকে
যদিও বাংলাদেশে ঘোষিত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের এক মাসের মতো বাকি আছে, তবে কোনো সংশয় নেই যে, নির্বাচন কেমন হবে। কোনো অনিশ্চয়তা নেই যে, নির্বাচনের ফল কী হবে।
মনোনয়নপত্র জমার সীমা পেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২৯টি রাজনৈতিক দল। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিসহ সরকারিভাবে নিবন্ধিত অন্য ১৫টি দল নির্বাচন বর্জন করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে ২৯টি দল নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার কোনো উপায় তাদের নেই। প্রকৃতপক্ষে এসব দল ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জ জানাতে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তারা নির্বাচনকে বৈধতার সিলমোহর দিতে অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি দল তাদের ইচ্ছায় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে কিনা তা নিয়ে বৈধ প্রশ্ন আছে। ঘোষিত শিডিউল অনুযায়ী যদি নির্বাচন হয় তাহলে তাতে বিজয় পাবে ক্ষমতাসীনরা, যেমনটা তারা এর আগে দু’টি নির্বাচনে-২০১৪ ও ২০১৮ সালে পেয়েছিল।
এসব পদক্ষেপের বাস্তবায়নের ফলে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিণত হয়েছে এখন ‘শো’ বা লোকদেখানো। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বাদ দিয়ে নির্বাচন হওয়ার কোনো উপায় নেই। এখন প্রশ্ন হলো- অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগের মেকানিজম কি তাদেরকে বোকা বানিয়ে ফেলবে এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো গণতন্ত্রকে পেছনে ফেলে রাখবে।
ইকোনমিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘এশিয়ার আয়রন লেডি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তিনি টানা চতুর্থ মেয়াদে সেটাই হয়ে উঠবেন। এটা এ কারণে নয় যে, জনমত জরিপ ইঙ্গিত দিয়েছে, ক্ষমতাসীন দলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে, বা দেশে শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতির কারণে নয়, বরং এর কারণ হচ্ছে এটা এসব কারণে হচ্ছে, যা নির্বাচন ছাড়া অন্যকিছু। পূর্ববর্তী দু’টি জালিয়াতির নির্বাচনের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে, বিশেষত যেসব বিষয় নৈতিক বৈধতাকে খর্ব করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে, সেই অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দল দৃশ্যত তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা সাজিয়েছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তা বর্জন করেছিল সব বিরোধী দল, জাতীয় সংসদের অর্ধেকের বেশি আসনের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ঐতিহাসিকভাবে ওই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। এসব ডাটা এটাই প্রদর্শন করে যে, ওই নির্বাচন না ছিল অংশগ্রহণমূলক, না ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার।
২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিরোধী দলগুলো। কিন্তু তখন নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদেরকে আইন এবং আইনবহির্ভূত বিভিন্ন ব্যবস্থায় নিপীড়ন করার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। উপরন্তু নির্বাচনের আগের রাতে সরকারি কর্মচারীরা ব্যালট দিয়ে বাক্স ভর্তি করার রিপোর্ট আছে। এ সময় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্র দখল করেন। তারা ভোটারদের জোরপূর্বক সরিয়ে ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখে। একটি বৈধ নির্বাচনের জন্য যে নৈতিকতা দাবি করে ক্ষমতাসীন দল, তাদের এসব কর্মকাণ্ড সেই দাবিকে ম্লান করে দিয়েছে।
২০২২ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, সবার অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। তার প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির একটি কৌশল নিয়েছে। এমনকি তারা প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে দুর্বল করার, যদি সম্ভব হয় তাহলে তাদেরকে ভেঙে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। যদিও দলটিকে ভাঙার জন্য চেষ্টা অনেক বছর ধরে চলমান। কিন্তু এক্ষেত্রে সফলতা মিলেছে খুবই সামান্য। তবু তারা চেষ্টা বৃদ্ধি করেছে।
তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানগণ সাক্ষাৎ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে। এটা ছিল একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। সেখানে কি আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এজেন্সিগুলো জড়িত হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। কিন্তু তাদেরকে ব্যবহার করে মানুষকে এভাবে চাপাচাপি ও জবরদস্তি করতে দেখা যায়নি সাম্প্রতিক সময়ে।
বিএনপি’র সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহজাহান ওমরের (বীরউত্তম) ঘটনা এসব পদক্ষেপের পক্ষে তথ্যপ্রমাণ হয়ে উঠেছে। অগ্নিসংযোগের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৪ঠা নভেম্বর। কিন্তু বিস্ময়করভাবে জামিন নিশ্চিত করে তিনি ২৯শে নভেম্বর জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। পরের দিনই তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে এবং দলটির পক্ষে সংসদীয় একটি আসনে মনোনয়ন পেয়ে যান। অন্য অনেক দল, এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠরাও নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় ছিল। জানা গেছে, তারাও নির্বাচনে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে এবং অব্যাহত নজরদারির মধ্যে আছে। নির্বাচনে প্রার্থী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগ দলের আগ্রহী সদস্যদেরকে, যারা দলীয় মনোনয়ন পাননি, তাদেরকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে উৎসাহিত করছে। যদিও তাদেরকে ‘ডামি প্রার্থী’ বলা হচ্ছে, তবুও তাদেরকে যাচাই করছে দল। তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে যুক্ত আছে রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলো। প্রকৃতপক্ষে এতে এটা নিশ্চিত হবে যে, বাছাই করা ব্যক্তিদের মধ্যেই হবে প্রতিযোগিতা।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের বাইরেও আরও ব্যবস্থা আছে যা সমাজে ভীতি সৃষ্টি করবে, বিরোধী নেতাকর্মীদের আতঙ্কিত করবে। সারা দেশে হামলা চালানো হয়েছে বিএনপি নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং পেশাগত অফিসে। মুখোশ পরা ব্যক্তিরা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন বিএনপি’র নেতাকর্মীদের। মুক্তি দেয়ার আগে কয়েকদিন ধরে তাদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে। এর মধ্যদিয়ে তাদের মধ্যে যথেষ্ট ভীতি সঞ্চার করা হচ্ছে, যাতে তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকেন। কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়েছে।
এসব পদক্ষেপের বাস্তবায়নের ফলে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিণত হয়েছে এখন ‘শো’ বা লোকদেখানো। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বাদ দিয়ে নির্বাচন হওয়ার কোনো উপায় নেই। এখন প্রশ্ন হলো- অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগের মেকানিজম কি তাদেরকে বোকা বানিয়ে ফেলবে এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো গণতন্ত্রকে পেছনে ফেলে রাখবে।
তথ্যসূত্র: মানবজমিন নির্বাচিত কলাম সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ