আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করবে নাকি আগের মতোই জোটবদ্ধ থাকবে ?
জোট ভেঙে দিয়ে আওয়ামী লীগ কি একলাই নির্বাচনে লড়তে চাইছ?- এ শিরোনামে বিবিসি নিউজ বাংলা এক সংবাদ প্রতিবেদনে বলছে,বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সংসদের তিনশো আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে দলটি এককভাবে নির্বাচনে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে বিভিন্ন মহলে জোর আলোচনা চলছে।
যদিও আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করবে নাকি আগের মতোই জোটবদ্ধ থাকবে, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। জোটের বিষয়টি নিয়ে দলের উচ্চমহলে এখন আলাপ-আলোচনা চলছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, জোটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এখনও তাদের হাতে আছে।
জোট নিয়ে এক প্রশ্নের জাবাবে গত শনিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের প্রতিপক্ষরা যদি একটা বড় জোট করে, সেটার বিপরীতে আমাদের জোট হবে। তাছাড়া আমরা কেন অহেতুক জোট করতে যাবো? প্রয়োজন না থাকলে তো জোট করবো না।”
মি. কাদের এই বক্তব্য দেওয়ার পরই আসলে আওয়ামী লীগের এককভাবে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা এবং জোট ভাঙার গুঞ্জন শুরু হয়।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জোটের বিষয়টি নিয়ে আমরা এখনও দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছি। আমাদের হাতে যেহেতু এখনও সময় আছে, কাজেই প্রতীক বরাদ্দের আগ পর্যন্ত এটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে না।”
একই কথা বলেছেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের হাতে এখনও সময় আছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা এখনও চিন্তা-ভাবনা করছি। সবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া শেষ হোক, তারপর এটা নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবো।”
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় মহাজোট গঠিত হয় এবং নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তারা ক্ষমতায়ও আসে।পুরনো সেই জোটকে ধরে রেখেই টানা তিন মেয়াদে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ, যদিও গত দু’টি জাতীয় নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে, নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করতে থাকা বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় আরেকটি ‘একতরফা নির্বাচন’ হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিএনপি অংশ না নিলেও এবার জাতীয় নির্বাচনটি ২০১৪ সালের চেয়ে আলাদা দেখাতে চাইছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ভোটার উপস্থিতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট করতে এবার নানা কৌশলেরও আশ্রয় নিচ্ছে দলটি। এক্ষেত্রে বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলো বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিপক্ষে থাকলেও যথাসময়ে নির্বাচন শেষ করা এবং নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখানোটাই এখন আওয়ামী লীগের বড় লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্য অর্জনেই নির্বাচনী কৌশল ঠিক করছে দলটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে যাবে কি-না, এটি নির্ভর করছে তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি’র ওপর।
“আওয়ামী লীগ চাচ্ছে এবারে নির্বাচনটি যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। একই সাথে সাধারণ ভোটাররাও যেন ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহ পায়, সেটিও তারা নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে আওয়ামী লীগ আগের মতোই জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবে। আর যদি বিএনপি শেষ পর্যন্ত না আসে, সেক্ষেত্রে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলার জন্য আওয়ামী লীগ হয়তো জোট ভেঙে দিবে”, বলছিলেন তিনি।
তবে পরিস্থিতি যা-ই হোক, আওয়ামী লীগ তাদের জোট টিঁকিয়ে রাখবে বলেই মনে করছেন আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
“জোট থাকা-না থাকায় আওয়ামী লীগের তেমন কিছু যায় আসেনা। কারণ জোটের জন্য তাদের খুব বেশি আসন ছাড়তে হচ্ছে না। তারপরও আওয়ামী লীগের নেতারা এসব কথা বলছেন যেন জোটের শরিক দলগুলো এক ধরনের চাপে থাকে। এতে আসন ভাগাভাগিতে তাদের সুবিধা হবে। কেউ কোন অভিযোগ করবে না।”
আওয়ামী লীগের নেত্বত্বাধীন জোটে শরিক দলগুলো সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে মোট ৩৩টি আসনে জয়লাভ করেছিল। এর মধ্যে প্রয়াত এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির (জাপা) জ্যেষ্ঠ নেতা রওশন এরশাদ-সহ ২৩ জন, রাশেদ খান মেননসহ ওয়ার্কার্স পার্টির ৩ জন, হাসানুল হক ইনু-সহ জাসদের ৩ জন, মাহি বি চৌধুরীসহ বিকল্পধারার ২ জন সংসদ সদস্য হন।
এ ছাড়া বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও সংসদ সদস্য হন।
জোটের শরিকরা কী বলছে?
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা না হলেও গত দুই নির্বাচনের মতো আগামী জাতীয় নির্বাচনেও শেখ হাসিনারা নেতৃত্বে ভোট করার আশা করছে ১৪ দলের শরিক দলগুলো।
“আমাদের এই জোট গঠন করেছেন শেখ হাসিনা। উনিই আমাদের জোট নেত্রী। তিনি ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত জোট থাকবে এবং আমরা জোটবদ্ধ হয়েই নির্বাচন করবো”, বলছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী।
তিনি আরও বলেন, “আসন চেয়ে আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের ১৩ জনের একটি তালিকা নেত্রীর কাছে পাঠিয়েছি। কতজনকে দিবেন, উনি বিবেচনা করবেন।”
“কাদের সাহেব যেটা বলেছেন, সেটা উনার ব্যক্তিগত মতামত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সর্বশেষ যে মিটিং হয়েছে, সেখানে আমাদের বলা হয়েছে যে, বিএনপি নির্বাচনে আসলেও আমরা জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবো, না আসলেও জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবো। কাজেই প্রধানমন্ত্রী নিজে না বলা পর্যন্ত বলা যাবে না যে জোট নেই।”
২০১৪ সালের নির্বাচনের উদাহরণ টেনে এনে তরিকত ফেডারেশনের এই নেতা আরও বলেন, “২০১৪ সালে প্রতীক বরাদ্দের আগের দিন আমাদেরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কাজেই সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। আমরা আলোচনা চালাচ্ছি। নৌকা মার্কা নিয়েই নির্বাচন করতে পারবো বলে আশা করি।”
প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “কাদের সাহেব তার কথায় আসলে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, আমরা বুঝিনি। জোটের সর্বশেষ মিটিংয়ে আমাদের বলা হয়েছে যে, বিএনপি নির্বাচনে আসুক কিংবা না আসুক, আমাদের জোট থাকবে।”
তবে আওয়ামী লীগ যদি সত্যিই এককভাবে নির্বাচন যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়, সেক্ষেত্রে ভিন্ন একটি নির্বাচনী কৌশল নেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করছেন মিস্টার ইনু।
“এবারে দুই ধরনের নির্বাচনী কৌশল নেওয়া হতে পারে বলে আমার ধারণা। প্রথমটি হচ্ছে, আগের মতই জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করা, যেখানে আমরা সবাই নৌকার প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবো। আরেকটি হচ্ছে, কিছু আসন উন্মুক্ত রাখা যেখানে জোটভুক্ত দল তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করবে। কৌশল যেটাই নেওয়া হোক, আমরা প্রস্তুত আছি।”-বলেন মিস্টার ইনু।
তবে মিস্টার কাদেরের বক্তব্যকে হালকা করে দেখতে রাজি নন ১৪ দলের আরেক শরিক দল জাতীয় পার্টি’র (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন,
“ইটস টু আর্লি টু কমেন্ট। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যেহেতু একটি বক্তব্য দিয়েছেন, এটিকে হালকা করে দেখা ঠিক হবে না।”
“জোট গঠন করেছেন শেখ হাসিনা। এটি থাকা-না-থাকার ব্যাপারে তিনিই সিদ্ধান্ত নিবেন। জোট থাকলে আমরা আছি, না থাকলে নাই। জোট বিলুপ্ত হলে আমরা আমাদের দলীয় মার্কায় নির্বাচন করবো।”
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় মহাজোট গঠিত হয় এবং তারা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। পুরনো সেই জোটকে ধরে রেখেই টানা তিন মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
১৪-দলীয় জোটের মধ্যে রয়েছে প্রয়াত এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা), রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, হাসানুল হক ইনুর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা, সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর তরীকত ফেডারেশন এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (জেপি)।
গত কয়েকটি নির্বাচনের মতো এবারেও জোটবদ্ধভাবেই নির্বাচনে যাওয়ার কথা নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছিল জোটভুক্ত দলগুলো।এরই মধ্যে রোববার নারায়ণগঞ্জ ও কুষ্টিয়ার দু’টি আসন বাদ রেখে ২৯৮টি আসনে দলীয় মনোনয়নের তালিকা প্রকাশ করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
এই তালিকায় গত দুটি সংসদ নির্বাচনে দলটির জোটসঙ্গী ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র দল—কারও জন্যই কোনও আসন খালি রাখা হয়নি।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা