আজ শনিবার বেলা ১১টা ৪১ মিনিটে নগরের পতেঙ্গা প্রান্তে সুইচ টিপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।এর মধ্য দিয়ে টানেলযুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রচিত হলো ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়।
আজ শনিবার বেলা ১১টা ৪১ মিনিটে নগরের পতেঙ্গা প্রান্তে সুইচ টিপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। টানেলের প্রবেশমুখের ডান পাশে এই নামফলক স্থাপন করা হয়। একই ধরনের নামফলক স্থাপন করা হয়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার টানেলের টোল প্লাজা এলাকায়।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছান। পরে টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে যান। সেখানে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে টানেলের উদ্বোধন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী গাড়িবহর টানেলের ভেতরে প্রবেশ করেন। টানেল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারা টোল প্লাজায় যান। সেখানে টোল প্রদান করেন। আর টোল প্লাজা কমপ্লেক্স ও টানেলের স্মার্ট মনিটরিং রুম পরিদর্শন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের খননকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। নির্মাণকাজ শুরুর প্রায় সাড়ে চার বছর পর টানেলের উদ্বোধন করা হলো। আজ উদ্বোধন হলেও গাড়ি চলাচল শুরু হবে কাল রোববার সকাল ৬টা থেকে। ফলক উন্মোচনের পর মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোশাররফ হোসেন, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
টানেল উদ্বোধনের পর আতশবাজি পুড়িয়ে উদ্যাপন করা হয়। এ সময় উপস্থিত অতিথিরা করতালি দিয়ে স্বাগত জানান।
১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের পতেঙ্গাপ্রান্তে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর সকাল ১০টায় কোরিয়ান ইপিজেড আনোয়ারাপ্রান্তে টানেল উদ্বোধন উপলক্ষ্যে এক জনসভায় ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সভাপতিত্ব করবেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এদিন টানেল ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী ১৯টি প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। উদ্বোধনের পরদিন যান চলাচলের জন্য টানেলটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। চট্টগ্রাম জেলাজুড়ে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।
টানেল উদ্বোধন উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এ অঞ্চলে নতুন মাত্রার উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সূচনা করে স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রা পথে আমাদের আরও একধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত সর্বস্তরের দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, পরামর্শক, বিশেষজ্ঞ প্যানেল, সেতু বিভাগ ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিরাপত্তা তদারকিতে নিয়োজিত বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং নির্মাণ শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে তাদের অবদান ও অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য অভিবাদন জানান তিনি।
টানেলে থ্রি হুইলার ও মোটরসাইকেল চলবে না। হেঁটেও পার হওয়া যাবে না। টানেলের ভেতরে সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলবে। টানেলটি পার হতে সময় লাগবে মাত্র তিন মিনিট। টানেল পথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমে আসবে। সময়ও লাগবে এক ঘণ্টা কম।
তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে টানেলটি শুধু বাংলাদেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নদীর তলদেশে নির্মিত প্রথম টানেল। যা চট্টগ্রাম অঞ্চলে খুলে দেবে স্বপ্ন ও সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। চট্টগ্রাম নগরী ও সারা দেশের সঙ্গে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল এবং কক্সবাজারকে এক করবে এই টানেল।
বাস্তবায়ন হবে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি-টু টাউন’ কনসেপ্ট। টানেলের একপ্রান্তে রয়েছে চট্টগ্রাম নগরী, অন্যপ্রান্তে আনোয়ারা এলাকায় গড়ে উঠবে নতুন শহর। যাতায়াত সহজতর হওয়ায় কমবে সময় ও পরিবহণ ব্যয়। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে শিল্পায়ন হবে দ্রুতগতিতে। সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি।
দুই টিউব, চার লেন : তথ্য মতে, টানেলে রয়েছে দুটি টিউব। একটির সঙ্গে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মতো। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন তৈরি করা হয়েছে। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিমপ্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ওভারব্রিজ রয়েছে আনোয়ারাপ্রান্তে। নগরীর পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে এই টানেল কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্বে আনোয়ারায় সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে স্থলপথে বের হয়েছে। ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে দুটি টিউব দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। টানেলের উত্তরে নগরীর দিকে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাটগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা বিচ সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হারে সুদে পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বাকি অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার। টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
টোল হার : টানেল দিয়ে চলাচলকারী গাড়ির টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। টোলের হার-কার, জিপ, পিকআপ ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ২৫০ টাকা, বাস (৩১ সিট পর্যন্ত) ৩০০ টাকা, ৩১ সিটের বেশি ৪০০ টাকা, বাস থ্রি এক্সেল ৫০০ টাকা, ট্রাক ৫ টন পর্যন্ত ৪০০ টাকা, ট্রাক ৫ থেকে ৮ টন পর্যন্ত ৫০০ টাকা, ৮ টন থেকে ১১ টন পর্যন্ত ৬০০ টাকা, ট্রাক থ্রি এক্সেল ৮০০ টাকা, টেইলার ফোর এক্সেল এক হাজার টাকা, ফোর এক্সেল থেকে বেশি এক হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি স্কেল ২০০ টাকা হারে যোগ হবে।
উল্লেখ্য আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের উত্তর টিউবের (পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারামুখী) খননকাজ (বোরিং) উদ্বোধন করেন। এর কাজ শেষ হয় ২০২০ সালের ২ আগস্ট। এরপর দ্বিতীয় টিউবের (আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গামুখী) খননকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর।
উদ্বোধন করেছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। খননকাজ সম্পন্ন হয় ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর। গত বছরের ২৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি ঘোষণা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন।
তথ্য সূত্র: প্রথমআলো, যুগান্তর