আল্লাহু আকবার! আল্লাহ মহান! যিনি পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তেই তার বড়ত্ব ও মানুষের কল্যাণের ঘোষণা অব্যাহত রেখেছেন ।।পৃথিবীজুড়ে কোথাও মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকে না আযানের ধ্বনি
রুহুল কুদ্দুস টিটো
আযান শব্দের মূল অর্থ দাড়ায় أَذِنَ ডাকা, আহবান করা। যার মূল উদ্দেশ্য হলো অবগত করানো। এই শব্দের আরেকটি ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ʾআজুন। (أُذُن), যার অর্থ হলো “শোনা”।
কুরআনে মোট পাঁচ স্থানে আজুন শব্দটি এসেছে। পারিভাষিক অর্থে, শরিয়ত নির্ধারিত আরবি বাক্যসমূহের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে উচ্চকণ্ঠে সালাতের আহবান করাকে আযান বলা হয়। ১ম হিজরি সনে আযানের প্রচলন হয়।
আযান মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ের জন্য ইসলামি আহ্বান বা ডাকধ্বনি
মুসলমানদের জন্য প্রতিদিন অবশ্যকরণীয় একটি ধর্মীয় কাজ। তবে প্রতিদিন আবশ্যকরণীয় বা ফরজ ছাড়াও বিবিধ নামাজ রয়েছে যা সময়ভিত্তিক বা বিষয়ভিত্তিক। ইসলামে ইচ্ছাকৃত ফরজ নামাজ না পড়া কবিরা গুনাহ বা বড় পাপ।
ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী মুহাম্মাদ (সাঃ) ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন এবং অব্যবহিত পরে আল্লাহর পক্ষ থেকে সকাল ও সন্ধ্যায় দৈনিক দুই ওয়াক্ত নামাজ মুসলিমদের জন্য ফরজ (আবশ্যিক) হওয়ার নির্দেশনা লাভ করেন। তিনি ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে সকাল, সন্ধ্যা ও দুপুরে দৈনিক তিন ওয়াক্ত নামাজের আদেশ লাভ করেন।
৬১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে রজব তারিখে মিরাজের সময় পাঁচওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, এ সময় যোহর, আসর ও ইশা ২ রাকাত পড়ার বিধান ছিল। ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে আল্লাহর তরফ থেকে ২ রাকাত বিশিষ্ট যুহর, আসর ও ইশাকে ৪ রাকাতে উন্নীত করার আদেশ দেয়া হয়।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘সেই সব মুমিন সফলকাম, যারা তাদের নামাজে বিনয়াবনত থাকে।’ —(সুরা মুমিনুন, আয়াত :১-২)
বিলাল ইবনে রাবাহ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আযান দেন। মুহাম্মদের নির্দেশে তিনিই প্রথম মদিনার মসজিদে নববীতে আযান প্রদান করেন। উল্লেখ্য মুহাম্মাদ স. মক্কায় আযান ও ইকামত ছাড়া নামাজ পড়েছেন।
আযান ঐতিহ্যগতভাবে মুসলমানদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য দৈনিক পাঁচবার মিনার থেকে উচ্চস্বরে আযান দেওয়া হয়। ফরজ নামাজের উদ্দেশ্য মসজিদে প্রবেশের জন্য এটি মুসলিমদের প্রথম ডাকধ্বনি। ইকামত নামে পরিচিত দ্বিতীয় ডাকধ্বনিতে মসজিদে উপস্থিত থাকা লোকেদের নামাজের শুরুর জন্য লাইনে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়। প্রতিটি মসজিদে একাধিক উচ্চস্বরে আযানের মূল উদ্দেশ্য হলো সকলের কাছে ইসলামি বিশ্বাসের সহজে বোধগম্য সারসংক্ষেপ উপলব্ধ করানো। কেবলমাত্র তুরস্কে, আজানকে বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি ভিন্ন শৈলীতে দেওয়া হয়; সাবা, উশাক, হিকাজ, রাস্ত, সেগাহ।
প্রতি দিন-রাতে বিভিন্ন সময়ে পাঁচ বার আযান দেওয়া হয়। আর আযান তখনই দেওয়া হয় যখন নামাযের সময় হয়।
ফজর:সবহে সাদিক উদিত হলে। সূর্য পূর্ব আকাশে উদিত হওয়ার আগ মুহূর্তে ।
যোহর: সূর্য পশ্চিম আকাশে একটু ঢলে গেলে ।
আছর:সূর্যের প্রখরতা থাকতে ।
মাগরিব:সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে ।
এশা: সূর্য অস্ত যাওয়ার পর রাতের এক তৃতীয়াংশে ।
সপ্তাহে একদিন শুক্রবার একটি অতিরিক্ত আজান হয় জুমআর খুতবার পূর্বে।
বিশ্বের যে প্রান্ত থেকে শুরু হয় আজান
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে- পৃথিবীজুড়ে মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয় না আজানের ধ্বনি। ভৌগলিক অবস্থান থেকে বিচার করলে ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু হয় আজানের ধ্বনি। আর তা শেষ হয় পৃথিবীর শেষ প্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকায়। সময়ের তালে তালে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে নামাজের জন্য এ আহ্বান- ‘আজান’। এটি ইসলামের প্রথম ও প্রধান ইবাদত নামাজের জন্য আহ্বান।
মুমিন মুসলমানের উপর প্রতিদিন নির্ধারিত ৫ সময়ে নামাজ আদায় করা ফরজ। এ নামাজের জন্য মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে নির্ধারিত সময়ে উচ্চারিত হয় সুমধুর আজানের ধ্বনি। দেশব্যাপী সময়ের ব্যবধানে পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে এ আজান। ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী পাপুয়া নিউগিনি ও ইন্দোনেশিয়ায় যখন ফজরের সময় হয় তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ধ্যা নামে। যেখানে সময়ের ব্যবধান প্রায় ৯ ঘণ্টা।
ভৌগলিক অবস্থান ও সময়ের ব্যবধানের কারণে পৃথিবীজুড়ে কোথাও মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকে না আজানের ধ্বনি। ইন্দোনেশিয়া-পাপুয়া নিউগিনি থেকে ফজরের আজান শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে যেসব দেশ অতিক্রম করে অব্যাহতভাবে ফজরের আজানের ধ্বনি চলতে চলতে তা আমেরিকায় গিয়ে শেষ হয়। সেসব দেশগুলো হলো-
– ইন্দোনেশিয়া, পিলিপাইন, কোরিয়া, জাপান
– সুমাত্রা, চায়না, মঙ্গলিয়া, রাশিয়া
– মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মায়ানমার
– বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা
– ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান
– তুর্কমিনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখাস্তান
– ওমান, ইরান
– সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, ইয়েমেন, ইরাক, সোমালিয়া, মোজাম্বিক, আজারবাইজান, তুরস্ক
– জর্দান, সিরিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইসরাইল
– মিসর, সুদান, উগান্ডা, রোমানিয়া, ইউক্রেন, কঙ্গো
– লিবিয়িা, চাঁদ, বুলগেরিয়া, গ্রীস, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, কোস্টারিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, পোল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন
– নাইজার, নাইজেরিয়া, ইতালি, তিউনেশিয়া
– আলজেরিয়া, ফ্রান্স, বুর্কিনাফাসো, মালি, ঘানা, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড
– মরক্কো, স্পেন, পুর্তগাল, মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, গাম্বিয়া
– ব্রাজিল, প্যারগুয়ে, ভেনিজুয়েলা, উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা, চিলি, কলম্বিয়া, পেরু, ইকুয়েডোর
– নিকারাগুয়া, গুয়েতেমালা, ম্যাক্সিকো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা আমেরিকা।
এভাবেই এক দেশের পর আরেক দেশে ফজর থেকে জোহর, আসর, মাগরিব ও ইশা হয়ে আবার ফজরের আজান শুরু হয়। পৃথিবীজুড়ে বিরামহীনভাবে চলতে থাকে এ আজানের ধ্বনি।
সাধারণত বাংলাদেশের একটি জেলা থেকে অন্য জেলায় মৌসুমভেদে ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ৩ থেকে ৫-৭ ও ১১ মিনিট পর্যন্ত আজানের সময়ের ব্যবধান হয়ে থাকে। এভাবেই এক দেশ থেকে আরেক দেশ, মহাদেশ চলতে থাকে আজানের ধ্বনি। যা মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয় না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা আমেরিকায় যখন ফজরের আজান শুরু বা শেষ হয়, তখন ইন্দোনেশিয়া জোহরের আজান শুরু হয়। এভাবেই সময়ের ব্যবধানে চলতে থাকে আজান। আল্লাহু আকবার! আল্লাহ মহান! যিনি পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তেই তার বড়ত্ব ও মানুষের কল্যাণের ঘোষণা অব্যাহত রেখেছেন। যা চলবে কেয়ামত পর্যন্ত।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া