আল–আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণটি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান- তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ।।মসজিদটি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়।। ইতিহাসের পাতা থেকে
রুহুল কুদ্দুস টিটো
আল–আকসা মসজিদ মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস নামেও পরিচিত মসজিদটি জেরুসালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত ইসলামের ৩য় পবিত্রতম মসজিদএবং এর সাথে একই প্রাঙ্গণে কুব্বাত আসসাখরা, কুব্বাত আসসিলসিলা ও কুব্বাত আন নবী নামক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। স্থাপনাগুলো সহ এই পুরো স্থানটিকে হারাম আল শরিফ বলা হয়। এছাড়াও স্থানটি “টেম্পল মাউন্ট” বলে পরিচত এবং ইহুদি ধর্মে পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন।ইতিহাসবিদ পণ্ডিত ইবনে তাহমিয়ার মতে, আসলে সুলায়মান এর তৈরি সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটির নামই হল মসজিদুল আল-আকসা।
সহীহ আল বোখারীর আবু যর গিফারী বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায় এটি সর্ব প্রথম আদম(আলাইহিস সালাম) তৈরি করেছিলেন এবং এটি ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় মসজিদ। রাসূল (সাঃ)কে হাদিসে জিজ্ঞেস করা হয়েছে এটি বায়তুল্লাহ নির্মাণের কত দিন পর নির্মাণ করা হয়েছিল? তিনি বলেন,চল্লিশ বছর পর।
মুসলমানরা বিশ্বাস করে, নির্মাণের পর থেকে এটি ঈসা (আঃ) (খ্রিস্টধর্মে যিশু) সহ অনেক নবীর দ্বারা এক আল্লাহকে উপাসনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।এই স্থান মুসলিমদের প্রথম কিবলা (প্রার্থনার দিক)। হিজরতের পর কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণে কাবা নতুন কিবলা হয়।
বর্তমানে “আল-আকসা” মসজিদ বলতে বোঝাায় কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ (৩টির) এর সমন্বয় যা “হারাম আল শরীফ” এর চার দেয়াল এর মধ্যেই অবস্থিত।
আল-আকসা মসজিদ মুসলিমদের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ?
মক্কা ও মদিনার পর জেরুসালেমের আল-আকসা মসজিদকে ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতি বছর ফিলিস্তিন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মুসলিম আসেন এই মসজিদ প্রাঙ্গণে। মসজিদটি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়।
ছবি: এই ডোম অব দ্য রকের ভেতরেই রয়েছে সেই পাথরের ভিত্তি – যেখান থেকে ইসলামের নবী মোহাম্মদ মিরাজে গিয়েছিলেন বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন।
গত কয়েক বছর ধরে আল আকসা প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি বাহিনী ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
কিন্তু এই এলাকাটি এত স্পর্শকাতর কেন? এর জন্য ফিরে তাকাতে হবে এর ইতিহাসের দিকে।
আল আকসা চত্বরে রয়েছে বেশ কয়েকটি স্থাপনা। যার কোনটি মুসলমানের জন্য, কোনটি ইহুদিদের জন্য আবার কোনটি খ্রিস্টানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর সবগুলো্ স্থাপনার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তিনটি ধর্মের ইতিহাস।
আল আকসা কোথায় অবস্থিত?
১৪ হেক্টর এলাকাজুড়ে অবস্থিত আল -আকসা প্রাঙ্গণে রয়েছে আল-আকসা মসজিদ, যা কিবলি মসজিদ নামেও পরিচিত। এছাড়াও আছে সোনালী গম্বুজবিশিষ্ট ‘ডোম অফ দ্য রক’, যা জেরুসালেমের সবচেয়ে স্বীকৃত একটি ল্যান্ডমার্ক এবং এই দুটিই পবিত্র হিসেবে বিবেচিত।
পূর্ব জেরুসালেমের পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত আল-আকসা মুসলিমদের কাছে ‘হারাম আল-শরীফ’ নামে পরিচিত এবং ইহুদিদের কাছে পরিচিত ‘টেম্পল মাউন্ট’ হিসেবে।
এখানে ১৫টি গেট ছিল, যেদিক দিয়ে ময়দানে প্রবেশ করতো জেরুজালেমের ওল্ড সিটি থেকে আসা ধর্মানুরাগীরা ।
যদিও এই গেটের মাত্র ১০টি এখন ব্যবহৃত হয় এবং সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েলি সেনা ও পুলিশ।
আল-আকসায় প্রথম ছোট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর, পরে ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে এখানে প্রথম বড় আকারে মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
দু’দফা ভুমিকম্পে দুবার ধ্বংস হয়ে গেলে তা পরে পুন:নির্মাণ করা হয়। কয়েকবার সংস্কার কাজও করা হয়। জেরুসালেমের ওল্ড সিটির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত আল-আকসার ‘ডোম অফ দ্য রক’ শহর জুড়ে দৃশ্যমান।
বাইরের দেয়ালসহ এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার বর্গমিটারের এই সীমানায় রয়েছে মসজিদ, নামাজের ঘর, উঠান ও ধর্মীয় বিভিন্ন স্থাপনা।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES যুগ যুগ ধরে এই এলাকা ঘিরেই চলছে বিবাদ
আল আকসা অর্থ কী?
আরবি ভাষায়, আল-আকসার দুটি অর্থ রয়েছে: ‘সবচেয়ে দূর’, যা মক্কা থেকে এর দূরত্বকে বোঝায়। ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ‘সর্বোচ্চ’ হিসেবেও মুসলিমদের কাছে এর মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
আল আকসা মসজিদটি ‘মসজিদুল আকসা’ বা ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ নামে পরিচিত মুসলিমদের কাছে।
মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, নবী মুহাম্মদ মিরাজের রাতে কাবা শরিফ থেকে প্রথমে আল আকসায় এসেছিলেন এবং মিরাজে গমনের আগে এখানে সব নবীদের সঙ্গে নামাজের সময় ইমাম হিসেবে নামাজ আদায় করেন।
আল আকসা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
এই প্রাঙ্গণের যেমন ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে এর পাশাপাশি ফিলিস্তিনি জনগণের সংস্কৃতি ও জাতীয়তার প্রতীকও এটি।
সোনালী গম্বুজের ‘ডোম অফ দ্য রক’ সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে স্বীকৃত এবং এই স্থানে প্রার্থনা করতে আসতে পারা একটি বড় সুযোগ বলে মনে করেন মুসলিমরা।
বর্তমান সীমানাগুলো তৈরি হবার আগের বছরগুলোতে, সেই পুরনো আমলে মুসল্লিরা পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেও সেই সফরে জেরুসালেমকেও অন্তর্ভুক্ত করতেন ।
আল-আকসার বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ এখনও হাজার হাজার ধর্মানুরাগীকে আকৃষ্ট করে, যারা প্রতি শুক্রবার জামাতে নামাজের জন্য জড়ো হন।
আল-আকসা প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি। মিরাজের রাতে এই মসজিদেই নামাজ আদায় করেছিলেন নবী মুহাম্মদ (সা:)। মক্কায় হজ ও ওমরা পালনের আগে আল আকসা ছিল মুসলিমদের কাছে প্রধান ধর্মীয় স্থান।
ইহুদিরা বিশ্বাস করে, ‘টেম্পল মাউন্টেই’ তাদের পয়গম্বর আব্রাহাম তার পুত্র ইসমাইলকে উৎসর্গ করার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য ইহুদিদের পয়গম্বর আব্রাহাম ইসলাম ধর্মে নবী ইব্রাহিম হিসেবে পরিচিত।
ইহুদিরা বিশ্বাস করে, এখানেই ছিল ইহুদিদের প্রথম ও দ্বিতীয় পবিত্র উপাসনালয়। তারা মনে করে, তিন হাজার বছর আগে রাজা সোলেমান এখানে প্রথম উপাসনালয় নির্মাণ করেছিল। যেটি ধ্বংস করেছিল ব্যাবিলনীয়রা।
আর দ্বিতীয় উপাসনালয়টি ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান বাহিনী ধ্বংস করে দেয়। এখানে একটি খ্রিস্টান ব্যাসিলিকাও ছিল যা একই সাথে ধ্বংস হয়।
সেই উপাসনালয়ের শুধুমাত্র পশ্চিম দিকের দেয়ালটিই এখনো টিকে আছে এবং এটিই ইহুদিদের প্রার্থনার স্থান।
ইহুদিদের মতে, আল আকসায় ‘ফাউন্ডেশন স্টোন’ বা বিশ্বের ‘ভিত্তি পাথর’ এর অবস্থান। যেখান থেকে বিশ্বের সৃষ্টি শুরু হয়েছিল বলে তারা বিশ্বাস করে।
অন্যদিকে খ্রিস্টানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এটাই সেই জায়গা যেখানে যীশু খ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন আর এখানকার গুহাতেই তার দেহ রাখা হয়েছিল।
ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে জেরুজালেম ও পশ্চিমতীর দখল করে নেবার আগে এটি নিয়ন্ত্রণ করতো জর্ডান। এখন পূর্ব জেরুজালেম ইসরায়েল অধিকৃত হলেও আল-আকসা বা টেম্পল মাউন্ট এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করে জর্ডান-ফিলিস্তিনের একটি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES আল আকসা প্রাঙ্গণটি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান- তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র।
‘ডোম অফ দ্য রক’
জেরুজালেমের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডমার্ক রয়েছে আল আকসায় এবং ইসলামিক যুগের প্রারম্ভিক পর্যায়ের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে এই প্রাঙ্গণে।
ধর্মীয় ভবন, বিভিন্ন ধরনের গম্বুজ, মিনার, স্তম্ভের ঐতিহাসিক কাঠামো ছাড়াও রয়েছে ৩০টি পানির উৎস, যার মধ্যে অজু করার জন্য ব্যবহৃত কূপও রয়েছে।
ইসলামি স্থাপত্যের প্রাচীন নমুনার দেখা মেলে আল আকসায়। আল আকসার দেয়ালের অভ্যন্তরে রয়েছে মিম্বার। এবং মামলুক ও আইয়ুবী যুগের ঐতিহাসিক বিদ্যালয়ের নিদর্শনও আছে এখানে।
আরবি ভাষায়, ‘ডোম অফ দ্য রক’কে ‘কুব্বাত আল-সাখরা’ বলা হয় যেটি ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
মক্কার আগে মুসলিমরা এই স্থানকে কিবলা হিসেবে ব্যবহার করতেন অর্থাৎ এর দিকে ফিরেই নামাজ পড়তেন তারা।
উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের নির্দেশে ৬৯২ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় অষ্টকোণ বিশিষ্ট এই স্থাপনা ‘ডোম অফ দ্য রক’।
‘হারাম আল শরীফ’ বা ‘টেম্পল মাউন্টের’ উপর অবস্থিত সোনালী গম্বুজটি ইসলামী স্থাপত্যের অন্যতম একটি নিদর্শন।
এর মধ্যখানে রয়েছে একটি পাথর, যাকে কেন্দ্র করেই এই স্থাপনা নির্মিত। এজন্যই একে বলে ‘কুব্বাত আল-সাখরা’ বা ডোম অফ দ্য রক (পাথরের গম্বুজ)।
ইহুদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই পাথর হলো ফাউন্ডেশন স্টোন যা মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। আর ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী ‘ডোম অফ দ্য রকের’ ভেতরে রয়েছে সেই পাথর- যেখান থেকে ইসলামের নবী মুহাম্মদ মিরাজে গিয়েছিলেন (ঊর্ধ্বাকাশে গিয়েছিলেন) বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES চুনাপাথর দিয়ে বানানো প্রাচীন এই দেয়ালটি প্লেস অফ উইপিং বা কান্নার জায়গা নামেও পরিচিত।
ওয়েস্টার্ন ওয়াল
আল-আকসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ওয়েস্টার্ন ওয়াল, যা আল-বুরাক প্রাচীর নামেও পরিচিত।
মরোক্কোন গেট ও প্রফেট গেট বা বাব আল নাবি গেটের মাঝখানে রয়েছে প্রাচীরটি এবং এই এলাকায় একটি ছোট মসজিদও রয়েছে যা বুরাক মসজিদ নামে পরিচিত, যেটা ১৩০৭ থেকে ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল।
প্রায় ২০ মিটার লম্বা ও ৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের প্রাচীরটি নিয়ে মুসলিমদের বিশ্বাস হলো -নবী মুহাম্মদ মিরাজে যাবার আগে আল-বুরাক নামে পরিচিত একটি ডানাওয়ালা ঘোড়ার মতো প্রাণীকে বেঁধে রেখেছিলেন এখানে।
অন্যদিকে টেম্পল মাউন্টকে ঘিরে থাকা ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’ ইহুদিদের কাছে ‘পৃথিবীর ভিত্তিপ্রস্তর’ হিসেবে স্বীকৃত ও পবিত্র স্থান। চুনাপাথর দিয়ে বানানো প্রাচীন এই দেয়ালটি ‘প্লেস অফ উইপিং’ বা ‘কান্নার জায়গা’ নামেও পরিচিত।
ইহুদিরা বিশ্বাস করে যে এটি হেরোডিয়ান উপাসনালয়ের শেষ অবশিষ্ট কাঠামো, যা রাজা হেরোড দ্য গ্রেটের সময় ২০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্প্রসারিত হয়। রোমানরা ৭০ খ্রিস্টাব্দে ধ্বংস করেছিল এটা।
প্রতি বছর, কয়েক হাজার ইহুদি ওয়েস্টার্ন ওয়ালে জড়ো হন এবং এই দেয়ালটি ধরে প্রার্থনা করেন ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা। দেয়ালের ফাঁক ফোকরে দেখা যাবে অসংখ্য টুকরো টুকরো কাগজ গুঁজে রাখা। সেগুলোর মধ্যে লেখা থাকে এখানে আসা মানুষজনের প্রার্থনা। তারা বিশ্বাস করে এই প্রাচীর হলো সেই জায়গা যেখানে ঈশ্বর সবসময় উপস্থিত থাকেন।
আল কিবলি মসজিদ
আল আকসা মসজিদ কোনও একক মসজিদ নয়। আল আকসা মসজিদ মানে- কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ (কুব্বাত-আল-সাখরা) ও বুরাক মসজিদের সমন্বয়।
রূপালি-গম্বুজ বিশিষ্ট আল কিবলি মসজিদটি আল-আকসার দক্ষিণ প্রাচীরের দিকে রয়েছে এবং এটি এই প্রাঙ্গণে মুসলমানদের নির্মিত প্রথম ভবন। এটা এখানকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপনাগুলোর মধ্যে একটি এবং এখানে মুসল্লিরা নামাজ পড়েন একজন ইমামের নেতৃত্বে।
মুসলমানরা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে যখন জেরুজালেমে প্রবেশ করে, তখন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন আল-খাত্তাব এবং তার সঙ্গীরা মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। তখন কিন্তু এলাকাটি অবহেলিত ছিল।
এটা প্রথমে একটা সাধারণ ভবন ছিল, কাঠের গুঁড়ির ওপর ভিত্তি করে যেটার কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে মসজিটির যে কাঠামো দেখা যায় তা প্রথম নির্মিত হয়েছিল উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের আমলে অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে।
বেশ কয়েকবার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মসজিদটি, যা পরে পুনঃনির্মাণ করা হয়। কয়েকবার সংস্কার কাজও করা হয়।
এর শেষ সংস্কার কাজটি হয়েছিল অটোমান আমলে, সে সময়ে সুলতান সুলেমান মসজিদ প্রাঙ্গণের বেশ কয়েকটি সাইট পুনরুদ্ধার করেছিলেন এবং সেখানে কার্পেট ও নানা ধরনের লণ্ঠন স্থাপন করেছিলেন।
বর্তমানে আল-কিবলি মসজিদের নয়টি প্রবেশপথ রয়েছে। পাথর ও মার্বেলযুক্ত স্তম্ভের কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। পাথরের স্তম্ভগুলো প্রাচীন, বিশ শতকের গোড়ার দিকে যে সংস্কার কাজ হয়েছিল তখন মার্বেলগুলো যুক্ত করা হয়।
আশি মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫৫ মিটার প্রস্থের এই মসজিদটিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

ছবির উৎস,GETTY IMAGES জেরুজালেমের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ল্যান্ডমার্ক রয়েছে আল আকসায় এবং ইসলামিক যুগের প্রারম্ভিক পর্যায়ের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে এই প্রাঙ্গণে।
ফিলিস্তিনিদের কাছে গুরুত্ব
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের চেয়েও আল আকসাকে সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র মনে করেন ফিলিস্তিনিরা। যেখানে তারা জমায়েত হয়ে আনন্দ উদযাপন করতে পারেন বা শোক করতে পারেন।
অনেক ফিলিস্তিনি ছোটবেলা থেকে মসজিদে নিয়মিত আসেন এবং তাদের কাছে আল আকসা দেশের সবচেয়ে স্বীকৃত প্রতীক।
রমজান মাসে অনেকেই মসজিদে আসেন রোজা ভাঙার জন্য এবং শুক্রবার এখানে নামাজ আদায় করেন। যদিও ইসরায়েলি বাহিনীর বিধিনিষেধের ওপর নির্ভর করে ফিলিস্তিনিদের আসা যাওয়া।
মসজিদটির প্রতি ফিলিস্তিনিদের যে ভক্তি ও আনুগত্য সেটাকে হুমকি হিসেবে মনে করে ইহুদি কট্টরপন্থীরা যারা এই জায়গায় থার্ড টেম্পল বা ইহুদিদের তৃতীয় উপাসনালয় তৈরি করতে চায়।
ফিলিস্তিনিদের প্রথম জাদুঘর, ‘ইসলামিক মিউজিয়াম’ এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে, যেখানে বিরল প্রত্নতাত্ত্বিক ও শৈল্পিক নিদর্শন রয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে কুরআনের পাণ্ডুলিপিও।
সহিংসতার কেন্দ্র আল আকসা কেন?
আল আকসা প্রাঙ্গণটি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান- তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র স্থান। যুগ যুগ ধরে এই এলাকা ঘিরেই চলছে বিবাদ। বলা যায় ঐতিহাসিকভাবে এটি বিবাদের ইস্যু।
ইসরায়েলি সরকারের সাথে সমঝোতা অনুযায়ী নানা বিধিনিষেধ ও শর্তপূরণের মাধ্যমে – শুধুমাত্র মুসলিমরাই আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢুকে প্রার্থনা করতে পারেন।
অন্যদিকে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা আল আকসায় শুধু পর্যটক হিসেবে প্রবেশ করতে পারবেন। সপ্তাহে পাঁচ দিন তাদের জন্য আল আকসা খোলা এবং দিনে চার ঘণ্টা সময় পাবেন ওই এলাকা ঘুরে দেখার জন্য।
জেরুসালেমে ধর্ম ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আল আকসা প্রাঙ্গণ সংঘর্ষ- সহিংসতার একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
ইহুদি দর্শনার্থীরা নিয়ম অমান্য করে আল আকসায় প্রার্থনা করেছে, কেউ প্রকাশ্যে কেউবা মুসলিমের বেশে। নানান সময়ে ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞায় বিক্ষোভ সংঘর্ষ সহিংসতায় রূপ নিয়েছে।
আল-আকসায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের এক বিতর্কিত সফরকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ‘ইন্তিফাদা’ বা গণঅভ্যুত্থান – যাতে ৪ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
সম্প্রতি আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি পুলিশের সাথে ফিলিস্তিনিদের আবারও সংঘর্ষ হয়েছে। ফিলিস্তিনে সর্বশেষ এই সহিংসতার ঘটনা এমন সময়ে ঘটে যখন মুসলিমরা রমজান মাস এবং ইহুদিরা পাসওভার হলিডে পালন করছিল।
ইহুদি চরমপন্থীরা তাদের পাসওভার দিবস উপলক্ষে সেখানে একটি ছাগল জবাই করতে পারে – এমন একটি খবর ছড়িয়ে পড়লে মুসল্লিরা রমজানের নামাজের পর সেখানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে।
খ্রিস্ট ধর্মের শুরুর দিকে এবং রোমানরা ওই স্থানে ইহুদিদের টেম্পল ধ্বংস করে দেওয়ার আগে ইহুদিরা সেখানে ছাগল জবাই করতো।
৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে তার উত্তরসুরি আল মাহদি এর পুনর্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলি আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।
বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙ্গিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্রুসেডাররা জেরুসালেম দখল করার পর তারা মসজিদটিকে একটি প্রাসাদ এবং একই প্রাঙ্গণে অবস্থিত কুব্বাত আস সাখরাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করত। সুলতান সালাহউদ্দিন জেরুসালেম পুনরায় জয় করার পর মসজিদ হিসেবে এর ব্যবহার পুনরায় শুরু হয়। আইয়ুবী, মামলুক, উসমানীয়, সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল ও জর্ডানের তত্ত্বাবধানে এর নানাবিধ সংস্কার করা হয়। বর্তমানে পুরনো শহর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তবে মসজিদটি জর্ডানি/ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ইসলামি ওয়াকফের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা, উইকিপিডিয়া