আহমদ ছফা ছিলেন একজন লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী
রুহুল কুদ্দুস টিটো
আহমদ ছফা দীপ্তিময় এ লেখক কে নিয়ে লেখা আমার দু:সাহস নেই এ লেখাটি কালেকক্টিভ লেখা তাঁর জীবন কর্ম কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র । তিনি কখনোই নিজেকে কেবল সাহিত্যের মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের মতামত নির্ভর বুদ্ধিজীবী রূপেও আবদ্ধ করেননি নিজেকে। তিনি তুলে এনেছেন বাস্তবতার কঠিন চিত্র। এ প্রজন্মের অধিকাংশই জানেন না আহমেদ ছফা কে। শাসক, সমাজের মোড়ল, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদ কিংবা ক্ষমতাশালী নেতা-উপনেতা বা প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিঃসঙ্কোচে কঠিন সত্য বলতে পারেন—এমন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা আমাদের দেশে বরাবরই কম। এই নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করার মতো সাহসী বুদ্ধিজীবীদের একজন ছিলেন আহমদ ছফা।
আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দীপ্তিময়ভাবে। গল্প,গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে তিরিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন।তাঁর জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। তাঁর রচনাবলি ৯ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন।
আহমদ ছফা ছিলেন একজন বাংলাদেশি লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খান সহ আরো অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা।
আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। তিনি মৃত্যবরণ করেন ২৮ জুলাই ২০০১ সাল। তাঁর পিতা ছিলেন হেদায়েত আলী এবং মাতা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান।
শাসক, সমাজের মোড়ল, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদ কিংবা ক্ষমতাশালী নেতা-উপনেতা বা প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিঃসঙ্কোচে কঠিন সত্য বলতে পারেন—এমন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা আমাদের দেশে বরাবরই কম। এই নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করার মতো সাহসী বুদ্ধিজীবীদের একজন ছিলেন আহমদ ছফা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রচিতবুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২) প্রবন্ধগ্রন্থে আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেন এবং বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার নগ্ন রূপ উন্মোচন করেন তথা বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনা বর্ণনাপূর্বক তাদের সতর্ক করে দিতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক গণকণ্ঠ-এ ধারাবাহিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনা প্রকাশ করেন। ‘বিতর্ক বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী’এই প্রবন্ধের কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাকে। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বইয়ে আহমদ ছফা বাঙালি চিন্তকদের সম্পর্কে যুক্তিসহ রূঢ় সব মন্তব্য করেছেন। সেই সময় দেশের প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা প্রতি সপ্তাহের কিস্তির দিকে তাকিয়ে থাকতেন আগ্রহ এবং আতঙ্ক নিয়ে।আহমদ ছফার সর্বাধিক আলোচিত সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—দীর্ঘ এ কালখণ্ডে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে আত্মবিক্রির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন, কীভাবে পুরস্কার, পদক-পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তা তথ্য উপাত্তসহ উপস্থাপন করেছেন। ছফার ভাষায়:
“আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়—প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন—সেও ঠেলায় পড়ে।”
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান প্রশস্তি, স্বৈরশাসকের জীবনী অনুবাদ—এসব বিষয়কে ছফা দেখেছেন লেখকদের মেরুদণ্ডহীনতার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ মুহূর্তে লেখকসমাজের নিষ্ক্রিয়তা, যুদ্ধের সময় দ্বিধান্বিত ভূমিকা, ভারতে পালিয়ে বেড়ানো, ভোগবিলাসে মত্ত থাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ছফা তুলে ধরেছেন, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশের লেখকসমাজ কতটা অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী ছিলেন। ছফা বলেন, সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা ‘প্রয়োজনে-ঠেলায়’ পড়ে বিশেষ বিশেষ ঘটনার আগে যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দেন, ঘটনার পরে লেখেন তার উল্টো কাসুন্দি। ফলে তাঁদের কোনো চিন্তা-কর্ম-উপদেশ সমাজের বিশেষ কোনো কাজে আসে না। তাই ছফা বলেন, বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।
“খড়গ্ হস্তে নৃত্য কর জল্লাদ সময়
তোমার সুস্থির হওয়া বড় প্রয়োজন
সকলে বিশদ জানে তবু হয় অন্ধকারে খুন
অস্ত্রহীন তাই কেউ বিনা খুনে দায়ভাগী হয়।
কেন্দ্রহীন হে সময় ছিন্ন ডানা রাক্ষসীর মত
শরীরে গড়িয়ে চল একটানা নীতিহীন বলে
তোমার রথের চাকা ঠেকে দেখ কোন্ রসাতলে।
মূল্যের বৃক্ষের মূলে অহরহ হানছ আঘাত।
সময়ের জানু চিরে বেরিয়েছ জারজ সময়
টাট্কা মনুষ্য প্রাণ মনে কর খেলার পুতুল
ইচ্ছেমত ভাঙ্গ তুমি মর্জিমত বসাও মাশুল
তোমার গর্ভের পাপে বঙ্গদেশে জেগেছ প্রলয়।
দাঁতাল জন্তুর মত গর্জমান নির্দয় সময়
তোমার আশ্রয়ে বাড়ে পুষ্ট হয় শূয়রের দল
যা পারে তছনছ করে দুঃখিনীর অন্তিম সম্বল
শোন না প্রজ্ঞার বাণী অনাচারে কর না সংশয়।
সূর্যালোকে পিঠ দেয়া আততায়ী লজ্জিত সময়
যা কিছু প্রকাশ্য তুমি বামহস্তে করছ গোপন
সমূহ ধ্বংসের বীজ গর্ভাশয়ে করেছ রোপণ
কিছু কিছু সত্য আছে কোনদিন লুকোবার নয়।”— “জল্লাদ সময়”, আহমদ ছফা
‘নিহত নক্ষত্র’গল্পে তিনি বলেছেন, ‘নিজের কথা বলি। আমি পূর্ব বাঙলার অরাজক যুগের যুবক। চটুল আমার স্বভাব। গাম্ভীর্যকে ভয় করি, সহজ হওয়া আমার পক্ষে আত্মহত্যা করার চাইতেও অসম্ভব। অন্য কোথাও সুযোগ না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলাতে ভর্তি হয়েছি। বলতে আমার সঙ্কোচ নেই। বিভাগীয় বন্ধুদের শতকরা নব্বই জনের অবস্থাও আমার মতো।’
তৎকালীন সময়ে অর্থাৎ আইয়ুব খানের আমলের যে চিত্র ছফা উপস্থাপন করেছিলেন, তা আজও আমরা দেখতে পাই আমরা আমাদের শিক্ষাঙ্গনে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছফা লিখেছিলেন ‘পাকিস্তানের শিক্ষানীতি’প্রবন্ধ, যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘রক্তাক্ত বাংলা’সংকলনে। যেখানে ছফা লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশেও ভূতপূর্ব পাকিস্তানের কর্তারা শাসন-শোষণ কায়েম রাখার জন্য স্থানীয় অধিবাসীদের যতটুকু সহযোগিতা অপরিহার্য, তার বাইরে কোনো রকম প্রসার হতে দেয়নি। এটা বাঙালি জনসাধারণকে শিক্ষার দিক থেকে খাটো করে রাখার সরকারি ষড়যন্ত্র। এই দুরভিসন্ধি পুরোপুরি কার্যকর করার জন্য সরকার সম্ভাব্য সব পন্থাই গ্রহণ করেছে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রচিতবুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২) প্রবন্ধগ্রন্থে আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেন এবং বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার নগ্ন রূপ উন্মোচন করেন তথা বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনা বর্ণনাপূর্বক তাদের সতর্ক করে দিতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
আহমদ ছফা তার বিখ্যাত “বাঙালি মুসলমানের মন” (১৯৭৬) প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের হাজার বছরের বিবর্তন বিশ্লেষণপূর্বক তাদের পশ্চাদগামিতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন।আনিসুজ্জামান ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকে ছফার বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১) প্রবন্ধসংকলনটিকে বাংলা ভাষায় রচিত গত শতাব্দীর ‘সেরা দশ চিন্তার বইয়ের’ একটি বলে মনে করেন।
‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসের’ এক পর্বে ছফা লিখেছেন, ‘আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। চারদিকে এত অন্যায়, অবিচার, এত মূঢ়তা ও কাপুরুষতা ওঁৎ পেতে আছে যে, এ ধরনের পরিবেশে নিতান্ত সহজে বোঝা যায় এমন সহজ কথাও চেঁচিয়ে না বললে কেউ কানে তোলে না।’
ছফা রচিত প্রতিটি উপন্যাসই ভাষিক সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গসহ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনিকথনের পারঙ্গমতা অসামান্য। আবুল ফজল ও আরো অনেকের মতে ছফার ওঙ্কার (১৯৭৫) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোত্তম সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রচিত গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসগুলোর একটি।পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ-এ (১৯৯৬) ছফা ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে ফুল, পাখি, বৃক্ষ তথা বৃহৎ প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের এক নিজস্ব বয়ান হাজির করেন।
জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আহমদ শরীফ বলেছিলেন, ‘সুবিধাবাদীর ”Life is a compromise” তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমন স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরও কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়তর পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।
আহমদ ছফা ও তার রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার ও বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছে; তাঁদের মাঝে অন্যতম ফরহাদ মজহার,সলিমুল্লাহ খান, হুমায়ূন আহমেদ,মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবংতারেক মাসুদ। বর্তমানে ছফা স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বলে বিবেচিত।
জীবিতকালে আহমদ ছফা তার প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন।তাঁর জনপ্রিয় একটি লেখা হলো অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে লেখা “যদ্যপি আমার গুরু”। ছফা চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। ছফা জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটের ফাউস্ট অনুবাদ শুরু করেন ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে। মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হয় ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গে রচিত স্মৃতিচারণ গ্রন্থ যদ্যপি আমার গুরু প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে।
জীবদ্দশায় অনেকে তাকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেছেন।
বাংলা একাডেমি থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে।গ্রন্থের নাম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে মাসিক সমকালে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত প্রবন্ধ “বাঙালি মুসলমানের মন।”
“বাঙালি মুসলমানের মন” প্রবন্ধে ছফা বাঙালি মুসলমানদের হীনম্মন্যতার ব্যাপক সমালোচনা করেছেন এবং পাশাপাশি এর বাস্তব ও যৌক্তিক কারণগুলো তুলে ধরেছেন।ছফার মতে, হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিতম উৎস। তাঁর মতে, বাঙালি মুসলমানের হীনম্মন্যতার শিকড়ও বর্ণাশ্রম প্রথাতে প্রোথিত আছে। আর শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতির কারণে বাঙালি মুসলমান আজ পর্যন্ত তাদের জাতিগত হীনম্মন্যতা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে নি।
আর তাই ‘বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে।’ প্রবন্ধটির পটভূমি ব্যাখ্যা করে সলিমুল্লাহ খান মন্তব্য করেছেন, বাঙালি মুসলমান আসলে কোনও জাতিগোষ্ঠী নয়। এটি একটি বিশেষ শ্রেণির নাম, যারা মুসলমান ও বাংলায় কথা বলেন এবং এ নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। ‘বাঙালি ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর শোষিত শ্রেণির একটি বিশেষ অংশ, যাদের হীনম্মন্যতার অবসান হয়নি, তারাই এই বাঙালি মুসলমান। সময় বদলালেও এই হীনম্মন্যতার সংকটের অবসান হয়নি। এর কারণেই সব স্তরে বাংলা ভাষার দুরবস্থা এখনও কাটেনি।’
আমি জাতি হিসেবে বাঙালি মুসলমানের অপূর্ণতা, অক্ষমতা এবং অসহায়তার দিকটাই তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। বাঙালি মুসলমানরা এ দেশের মাটির আসল সন্তান। তারা প্রভুত্বকামী আর্যদের সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত নয়, তেমনি আগ্রাসী তুর্কি, তাতার, ইরানী, তুরানীদেরও কেউ নয়। শুরু থেকেই বাঙালি মুসলমান একটা নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী।—আহমদ ছফা, ১৯৯৪
ছফা কখনোই নিজেকে কেবল সাহিত্যের মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের মতামত নির্ভর বুদ্ধিজীবী রূপেও আবদ্ধ করেননি নিজেকে। তিনি তুলে এনেছেন বাস্তবতার কঠিন চিত্র।
আহমদ ছফার উল্লেখযোগ্য রচনাবলি
- বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২)
- বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১)
- ওঙ্কার (১৯৭৫)
- একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮)
- অলাতচক্র (১৯৯৩)
- গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫)
- অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬)
- পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬)
- যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮)
- ফাউস্ট (১৯৮৬)
প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, দ্যা ডেইলি স্টার