১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনায় মেহেরপুরের মুজিবনগর সূতিকাগারের ইতিহাস গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রথম সরকারে শপথ গ্রহণের পর মেহেরপুর কার্যত হানাদার বাহিনীর লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়।
ছবি: মেহেরপুর ১৯৭১ এপি ডকুমেন্ট্রি থেকে সংগৃহিত
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল দুুপুরে প্রথম পাকিস্থানী বাহিনী অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মেহেরপুরে প্রবেশ করে। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীরা সড়কপথে চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরে আসার পথে আমঝুপিতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে হত্যা করে ৮ জন গ্রামবাসীকে। পরবর্তীতে তারা মেহেরপুর প্রবেশ করে একের পর এক হামলা চালায় কাঁচাবাজার পট্টিতে , মহাকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে ও বড় বাজারের ।
১৮ এপ্রিল পাকবাহিনী কোন প্রতিরোধের সম্মুখিন না হওয়ায় তারা তাদের অকুন্ঠ বিজয় ভেবে ক্যাপ্টেন মোঃ আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে শহরের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাড়িতে লুটপাট চালায়।
২০ এপ্রিল থেকে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর সৈন্যেরা মেহেরপুরের থানা কাউন্সিলে স্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলে । স্থায়ী ক্যাম্প করার কিছুদিনের মধ্যেই সৈন্যের সংখ্যা আরো বাড়িয়ে মেহেরপুরের ভকেশনাল ট্রেনিং ইনষ্টিটিউট ,কালাচাঁদপুর , কামদেবপুর ও সীমান্ত এলাকায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই পাকবাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা বিরামহীন আক্রমন চালাতে থাকে।
জেনারেল নিয়াজির মেহেরপুর সফরঃ পাকহানাদারদের সর্দার তথা পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি ২৩ জুলাই ১৯৭১ মেহেরপুর শহরে এক সফরে আসে। এই সফরকালে সে মানসিক ও শারীরিকভাবে পর্যদস্ত তার দস্যুবাহিনীর মনোবল চাঙ্গা করার জন্য তাদের সাথে এক সভায় মিলিত হয়।
দৈনিক সংগ্রাম ,২৪ জুলাই‘১৯৭১খ্রি. প্রকাশিত খবরে পাওয়া যায় ২৩ জুলাই পূর্বা্ঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর পরিদর্শন করেন দিনটি ছিল শুক্রবার।একই তারিখে দৈনিক পাকিস্তানেও ভৈরবতীরের ছবিসহ প্রকাশ হয়। -তথ্য ও ছবি প্রদান করেছেন মাসুদ রেজা
মেহেরপুরে উপ-নির্বাচনের প্রহসনঃ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় সারা দেশের মত মেহেরপুরেও জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ আসন শূন্য হয়ে যায়। অক্টোবর মাসে এই শূন্য আসনে উপ-নির্বাচন হয়। এই উপ-নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের আসনে অ্যাডভোকেট মতিন এবং প্রাদেশিক পরিষদ আসনে অ্যাডভোকেট খালেদ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়।
মেহেরপুর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উলেখযোগ্য ঘটনাবলী
ছবি: মেহেরপুর ১৯৭১ এপি ডকুমেন্ট্রি থেকে সংগৃহীত
যাদবপুর গ্রামে পাকহানাদারদের অগ্নি সংযোগঃ পাক হানাদারবাহিনী মেহেরপুরে শিবির স্থাপন করেই জনমনে ত্রাস সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করতে থাকে। তাদের পরিকল্পিত আক্রমণের প্রথম শিকার হয় যাদবপুর গ্রাম। ৩০শে এপ্রিল হানাদাররা যাদবপুর গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। গ্রামের সমস্ত কাঁচা খড়ের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
মেহেরপুরে হানাদারদের দোসরদের নিয়ে শান্তি কমিটি (পিস কমিটি)গঠনঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পীঠস্থান মেহেরপুরের আবালবৃদ্ধবণিতা যখন স্বাধীন বাংলাদেশের রাহুমুক্তির জন্য কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে আর যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বান্তঃকরণে সাহায্য সহযোগিতা করছে তখন হানাদারদের দালাল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তথাকথিত শান্তি কমিটি বা পিস কমিটি গঠন করে।
ছবি: মেহেরপুর ১৯৭১ এপি ডকুমেন্ট্রি থেকে সংগৃহীত
১৯৭১-এর মে মাসের শেষের দিকে হানাদার বাহিনীর মেহেরপুর শিবিরের প্রধান ক্যাপ্টেন আব্দুল লতিফের তত্ত্বাবধানে মেহেরপুর মহকুমা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এর চেয়ারম্যান হয় দালাল সাবদার আলী বিশ্বাস আর সেক্রেটারি হয় আব্দুল মতিন এ্যডভোকেট। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে ভারত সৃষ্ট একটা গণ্ডগোল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কুতকারী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং তাদের মতো দালালদের সংগঠিত করে রাজাকার বাহিনী তৈরী করা যারা মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলা করবে ।
শান্তিকমিটির দালাল আর রাজাকাররা মেহেরপুরের অসংখ্য নিরীহ নাগরিককে হত্যা করেছে। এরা মেহেরপুর মহকুমা প্রশাসকের দপ্তরের আমতলায় ট্রেজারির কাছে এবং মেহেরপুর কলেজের পিছনে দুটি বধ্যভূমি সৃষ্টি করেছিল। নভেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত রাজাকারদের সহায়তায় হানাদাররা শত শত বাঙালীকে হত্যা করে ঐ দুই বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। মেহেরপুর হানাদারমুক্ত হবার পরপরই মেহেরপুর কলেজের পিছন থেকে মহীদদের দেহাবশেষ ও কংকাল উদ্ধার করে গোরস্থানের কাছেই একস্থানে সমাধিস্থ করা হয়।
’৭১মেহেরপুরে তথাকথিত অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়েছিলঃ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এহিয়া খান পাকবাহিনীর নির্যাতন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয়টিকে একটি সাময়িক ও অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে বিশ্বজনমতকে ধোঁকা দেবার জন্য ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য আহ্বান জানান । তার এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে দালালদের সহায়তায় ঢাকঢোল পিটিয়ে মেহেরপুরে একটি অভ্যর্থনা শিবির খোলা হয়। কিন্তু এই অভ্যর্থনা শিবির শূন্যই পড়ে থাকে।
মেহেরপুর শহরে মুক্তিবাহিনীর মর্টার আক্রমণ
ছবি: গুগুল থেকে
১২ই নভেম্বর বিকেলের দিকে মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর শহরের অভ্যন্তরে প্রচণ্ড মর্টার আক্রমণ শুরু করে। এতে মেহেরপুরবাসীদের মনে যুগপৎ উল্লাস ও আতঙ্কের উদ্রেক হয়। এই আক্রমণে হানাদারদের কয়েকজন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এতে দূর্ভাগ্যবশত: একটি শিশু নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর মর্টার আক্রমণে পাকহানাদার ও তার দোসরদের মনে তীব্র ভীতির সঞ্চার হয়।
মেহেরপুরে মুক্তিবাহিনীর চুড়ান্ত আক্রমণ
নভেম্বর মাসের প্রথম থেকেই মেহেরপুর মহকুমার সর্বত্র মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় প্রায় প্রতিদিনই মুক্তিবাহিনীর বীর সন্তানেরা পাকহানাদারদের ওপর তাদের অবস্থান থেকে ভারী অস্ত্রের আক্রমণ চালাতে থাকেন সাথে গাংনী ও মেহেরপুর থানার বিভিন্ন স্থানে তাদের গেরিলা অভিযান অব্যাহত রাখেন। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই মুক্তিবাহিনীর একদল অকুতভয় সৈনিক মেহেরপু-চুয়াডাঙ্গা সড়কের গুরুত্বপূর্ণ দীনদত্ত সেতুটি মাইনের সাহায্যে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করেন। হানাদার বাহিনী এসময় কালাচাঁদপুর থেকে ভৈরব নদের তীর ঘেঁষে বামুনপাড়া পর্যন্ত পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে থাকে। হানাদাররা মেহেরপুর শহরের পূর্বদিকের পুরো এলাকা জুড়ে মাটির নীচে গর্ত খনন করে তার মধ্যে আশ্রয় নেয়। এই পরিখা ও গর্ত খনন কাজে রাজাকাররা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জোর করে শ্রমিকদের ধরে আনে। হানাদাররা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ভয়ে দিন রাতের বেশীর ভাগ সময়ই পরিখার মধ্যে অবস্থান নিয়ে থাকে। ১০ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে মেহেরপুর শহর অবরোধ করে রাখেন ফলে হানাদাররা কার্যত: মেহেরপুর শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
২৫শে নভেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর শহরের ওপর তাদের আক্রমণের মাত্রা তীব্র করে তোলে। তারা অব্যাহতভাবে হানাদারদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। এতে সাধারণ মানুষের মনে বাংলাদেশের মুক্তি ও পাকিস্তানীদের পরাজয়ের ব্যাপারে প্রবল আশাবাদের সঞ্চার হয়। অপরদিকে পাকহানাদারবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। তারা সম্ভাব্য পরজয়ের কথা ভেবে তাদের তল্পি-তল্পা গুটাতে থাকে। এদিন সকাল থেকেই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে মেহেরপুর শহরের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। দূর্ভাগ্যবশতঃ একটি গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ডের রিকশা চালক আইনাল মিয়ার বাড়িতে এসে পড়লে গোলার আঘাতে তার স্ত্রী হাওয়া বিবি (৩৮) সাথে সাথে মৃত্যু বরণ করেন।
ছবি: মেহেরপুর ১৯৭১ এপি ডকুমেন্ট্রি থেকে সংগৃহীত
মেহেরপুর শহরে মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণের সাথে সাথে গাংনী থানাতেও তাদের আক্রমণ জোরদার করা হয়। গাংনী থানার মুক্তিবাহিনীর সদস্যের সদর দপ্তর হিসেবে পরিগণিত গোপালনগর থেকে গাংনীতে অবস্থিত হানাদারদের শিবিরের ওপর ক্রমাগত আঘাত হানা হয়। গাংনী থানার ভাটপাড়াতে অবস্থিত হানাদাররাও ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারা ভাটপাড়া থেকে পালানোর সময় ভাটপাড়া-কাথুলি সড়কের গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি ধ্বংস করে দিয়ে যায়। নভেম্বর মাসেই মেহেরপুরে হানাদারদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায় এবং মেহেরপুর মহকুমার বেশীর ভাগ এলাকা কার্যত মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
২৮শে ও ২৯শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রবল রূপ ধারণ করে। তাদের আক্রমণে পাকহানাদাররা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কোন রকম বিরতি ছাড়াই মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে। ফলে পাকহানাদারদের চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। পলায়ন ছাড়া গত্যন্তর না দেখে হানাদাররা ৩০শে নভেম্বর গভীর রাত থেকে তারা মেহেরপুর থেকে পালাতে থাকে। তাদের এ পলায়ন পর্ব দুদিন ধরে চলে। পলায়নরত পাকহানাদারদের ওপর মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা সড়কে কুলপালায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে। এতে বেশকয়েকজন হানাদার নিহত হয়।
১লা ডিসেম্বর পালাতে না পারা হানাদারদের অবশিষ্ট অংশ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের সম্মুখীন হয়। লাল বাজার সাব-সেক্টর থেকে কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল মেহেরপুর এলাকায় হানাদারদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেন। এদিন দু’জন মুক্তিযোদ্ধা আসগার আলী পিতা- গয়জদ্দিন গ্রাম- আমঝুপি থানা-মেহেরপুর ও নুরুল ইসলাম পিতা- মকসেদ আলী গ্রাম- রাজাপুর থানা- মেহেরপুর শহীদ হন।
মেহেরপুরের ওগাংনী মুক্তির পথে
৩০শে নভেম্বর গভীর রাতে হানাদারদের মেহেরপুর থেকে পলায়নের মধ্য দিয়ে মেহেরপুরের মুক্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১লা ডিসেম্বর দিবাবসানের আগেই মেহেরপুর শহর মুক্ত হয়ে যায় । শহরের ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। জয় বাংলা শ্লোগানে শহরের অলি-গলি প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ।
গাংনী: মেহেরপুর থেকে হানাদারবাহিনীর পলায়নের আগেই তারা তাদের গাংনীর শিবির গুটিয়ে নেয় তবে ভাটপাড়াতে তখনও কিছু হানাদার অবস্থান করছিল। হানাদাররা যখন মেহেরপুর থেকে পলায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই অর্থাৎ ৩০শে নভেম্বর সকালের দিকে গোপালনগর থেকে মুক্তিবাহিনী জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সিও অফিসের মাঠের মধ্যে অবস্থিত গাংনীর হানাদারদের শূন্য শিবির লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করে এবং মুহুর্মুহু ফাঁকা গুলি বর্ষণ করতে থাকে। তাদের এই আক্রমণে ভীত হয়ে গাংনীর রাজাকার, আলবদর ও পিস কমিটির সদস্যরা এদিক সেদিক পালাতে থাকে। ঐদিন বিকাল বেলায় ভাটপাড়া থেকে পলায়নপর একদল পাকিস্তানী সৈন্য গাংনী এলে পাকিস্তানী দালালরা উল্লসিত হয়, তাদের ধারণা ছিল পাকিস্তানী সৈন্য সেখানে নতুন করে ঘাঁটি গাড়বে। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই হানাদাররা গাংনী ছেড়ে খলিসাকুণ্ডি হয়ে ঈশ্বরদীর দিকে পালিয়ে যায়। এর ফলে ঐ দিনই কার্যতঃ গাংনী পাক হানাদারমুক্ত হয়ে যায়।
১লা ডিসেম্বর দিবাগত গভীর রাতে মুক্তিবাহিনী গাংনী থানা ও গাংনী বাজারে অভিযান চালায়। গাংনী থানায় অবস্থিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বিনা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং মুক্তিবাহিনীর জয়বাংলা ধ্বনির জবাবে উচ্চস্বরে জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং সাথে সাথে সেই রাতেই থানা ভবনে এবং গাংনী বাজারের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ২রা ডিসেম্বর ভোর হবার সাথে সাথে গাংনীবাসী স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। নিজেদেরই গ্রামের সন্তান বীরমুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পেয়ে তারা তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করে তাদের বরণ করে নেয়। এই অভিযানে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন, মকবুল হোসেন (মিনাপাড়া, মেহেরপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য।), আবুল কাসেম কুরাইশী (গাংনী), আসগার আলী (বাদিয়াপাড়া), মহসীন আলী (বাদিয়াপাড়া), আবুলকাসেম (বাদিয়াপাড়া), কদম আলী (ধানখোলা), মোন্তাজ আলী (গোপালনগর), দোয়াত আলী (গাংনী), মুলুকচাঁদ (চৌগাছা), আমিরুল ইসলাম (মালসাদহ), নবীছদ্দিন (চৌগাছা, শহীদ হারেজের ছোট ভাই) প্রমুখ।
মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন প্রশাসন
/
গাংনী ও মেহেরপুর মুক্ত হবার সাথে সাথে শিকারপুরে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর অ্যাকশন ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী হাটবোয়ালিয়ায় এসে মুক্তিবাহিনীর দপ্তর স্থাপন করেন। ১লা ডিসেম্বর মেহেরপুর মুক্ত হলেও হানাদারদের পুঁতে রাখা স্থল মাইন অপসারণ করে ৪ দিন পর ৫ই ডিসেম্বর মেহেরপুরে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করে ।
৫ই ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার একদিন পরই ৬ই ডিসেম্বর ভারত স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর পর পরই ভারতে অবস্থিত মেহেরপুরের বাস্তুচ্যূত নাগরিক ও প্রবাসী নেতৃবৃন্দ আনন্দ উল্লাসে মেতে মেহেরপুরে ফিরে আসতে থাকেন।
৭ই ডিসেম্বর মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করা হয়। জাতীয় পরিষদ সদস্য মোঃ সহিউদ্দিন নবপ্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৮ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে মেহেরপুরের প্রথম মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন কমল ভট্টাচার্য । ২ সপ্তাহ পর ২২শে ডিসেম্বর মাহফুজ সোবহানকে মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্রমেই জনজীবন স্বাভাবিক ধারায় প্রবাহিত থাকে।
রুহল কুদ্দুস টিটো
তথ্যসূত্র: আলকামা অর্গা