বেগম মতিয়া চৌধুরী সৎ রাজনীতির পথিকৃৎ
রুহুল কুদ্দুস টিটো
বেগম মতিয়া চৌধুরী বয়স তখনো ষোলো হয়নি, সবেমাত্র কলেজে পা পড়েছে। স্বৈরশাসক আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তখন দানা বাঁধছে। মিছিল-স্লোগান আর একের পর এক কর্মসূচিতে ঢাকার বাতাস উষ্ণ হয়ে উঠেছে। একজন সচেতন ছাত্রী হিসেবে মতিয়া চৌধুরীও নিজেকে ক্লাসরুমে আবদ্ধ রাখতে পারেননি। মনের অজান্তেই জড়িয়ে পড়েন ওই আন্দোলনে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনরাত কর্মসূচি সফল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একজন তরুণ সংগঠকের দায়িত্ব নিয়ে মাঠে ঝাঁপ দেন। দিনে দিনে এভাবেই পুরোপুরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন মতিয়া চৌধুরী।
মতিয়া চৌধুরী নির্লোভ, নির্মোহ ও সাদামাটা জীবনাচরণে অভ্যস্ত এক ব্যতিক্রমী রাজনীতিকের নাম মতিয়া চৌধুরী। সরকারের ও দলের মুখ্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হলেও সর্বদাই নিজেকে প্রকাশ করেন সাধারণের মতোই। এককথায় বেগম মতিয়া চৌধুরী সৎ রাজনীতির পথিকৃৎ।এখনো দেশি কাপড় পরেন, চলেন সাদামাটা।কোনো লোভ-লালসা তাঁকে টলাতে পারেনি।সাজগোজ নেই, তবু পরিপাটি। খাবারদাবারেও নেই বাড়তি কিছু, আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো। সাধারণ চালের ভাত, শাকসবজি, ভর্তা আর তরিতরকারিতেই অভ্যস্ত।
সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে ৫০ বছরেরও বেশি সময় পার করেছেন। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার কাছে থেকেছেন, তবু নিজেকে রেখেছেন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
মতিয়া চৌধুরীকে বলা হয় অগ্নিকন্যা। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে তাঁর যে উদ্দীপ্ত ভাষণ, সেই উদ্দীপ্ত ভাষণ তাঁকে অগ্নিকন্যার রূপ দিয়েছে। ত্যাগ স্বীকার করেছেন, রাজনীতিতে সততা এবং আদর্শবাদের এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন বেগম মতিয়া চৌধুরী। ছাত্র ইউনিয়ন শেষ করে তিনি ন্যাপ-এ যোগদান করেছিলেন এবং এক সংকটকালীন সময়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালে “অগ্নিকন্যা” নামে পরিচিত মতিয়া পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং এর কার্যকরী কমিটির সদস্য হন।
নিজের সদাসতর্ক অবস্থান তাঁকে দিয়েছে রাজনীতির পরিচ্ছন্ন নেত্রীর খ্যাতি। রাজপথের অগ্নিঝরা আন্দোলন-সংগ্রাম আর জেল-জুলুম-নির্যাতনও কম সহ্য করেননি। এর বদৌলতে দেশ-বিদেশে ‘অগ্নিকন্যা’ খ্যাতিও পেয়েছেন। ক্ষমতাধর হলেও থেকেছেন একেবারেই নির্লোভ-নির্মোহ।
১৯৬৩-৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে রোকেয়া হলের ভিপি এবং ১৯৬৪ সালে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্রাবস্থায় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে সাফল্যের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর নামেই ছাত্র ইউনিয়নে একটি গ্রুপের নাম হয়েছিল ‘মতিয়া গ্রুপ’।
মতিয়া চৌধুরী ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নএর সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে “অগ্নিকন্যা” নামে পরিচিত মতিয়া পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং এর কার্যকরী কমিটির সদস্য হন। ১৯৭০ ও ১৯৭১ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, প্রচারণা, তদবির এবং আহতদের শুশ্রুষায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন।
ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবন তাঁর। দীর্ঘ রাজনৈতিক এই জীবনে নানা দুর্বিষহ স্মৃতিও রয়েছে। দু-একবার নয়, জেলে গেছেন ১৫ বার। বছরের পর বছর কাটাতে হয়েছে জেলে। কিন্তু মাথা নত করেননি। প্রাণনাশের হুমকি এসেছে বহুবার, তবু নিজের অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯- টানা দুই বছর জেল খাটেন এবং সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন সময় তিনি কারাবরণ করেন। রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি বক্তা হিসেবে খুবই খ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৭১ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও মরহুম রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়কালে তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হন।
১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।বর্তমানে তিনি আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১২ জানুয়ারি ২০২৩ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব নেন।
১৯৭৯ সালে ন্যাপ ছেড়ে মতিয়া যোগ দেন দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। ১৯৮৬ সালে দলের কৃষিবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। বর্তমানে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। নিজের রাজনৈতিক দক্ষতা-যোগ্যতায় তিন দফায় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদে তিনি কৃষি, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর এ নিয়ে আরো দুই দফায় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে রাজনৈতিক ‘ক্যারিয়ারে’ আজ পর্যন্ত কোনো কালিমা লেপন করতে দেননি। নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে শেরপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এর আগেও তিনি দুইবার একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৪২ সালের ৩০ জুন মতিয়া পিরোজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা নুরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। ব্যক্তিজীবনে ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন খ্যাতিমান সাংবাদিক বজলুর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন যে ভাবে
মামার সূত্রেই মামার রুমমেট বজলুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয় মতিয়ার। পরবর্তী দেখা-সাক্ষাৎগুলোতে ধীরে ধীরে ভালো লাগা গড়ে ওঠে। পরিচয়ের পর থেকেই মতিয়া চৌধুরীদের বাসায় বজলুর রহমানের যাতায়াত বেড়ে যেতে থাকে। বাসার আড্ডার ভিড়ে তারা বুঝে নেন একে অপরের মনের কথা। দুজন সিদ্ধান্ত নেন লেখাপড়া শেষে সুবিধামতো সময়ে বিয়ে করবেন। বিয়ে তারা করেছিলেন, কিন্তু সেটা সুবিধামতো সময়ে হয়নি; বরং ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে। ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন পারিবারিক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তাদের বিয়ে হয়, কিন্তু বিয়ের আগে ঘটে এক নাটকীয় ঘটনা।
ইডেন কলেজে এইচএসসি এবং বিএসসি শেষে ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞানে মাস্টার্সে ভর্তি হন মতিয়া চৌধুরী। ততদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে মাস্টার্স শেষ করে দৈনিক সংবাদে সহকারী সম্পাদক (অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর) হিসেবে যোগ দিয়েছেন বজলুর রহমান। দুজনেই ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, তবে ক্যাম্পাসে বা রাজপথে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি বললেই চলে। তাদের ভাব বিনিময় হতো মতিয়া চৌধুরীদের বাসায়।
মতিয়া চৌধুরী আগে থেকে সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি করতেন, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও বেগবান হয়েছে। ১৯৬৩-৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে রোকেয়া হলের ভিপি এবং ১৯৬৪ সালে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। সে সময় যে কয়েকজন ছাত্রনেতা আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অন্যতম ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তাকে আন্দোলন থেকে কোনোভাবে নিবৃত্ত করতে না পেরে সরকার ভিন্ন পন্থা বেছে নেয়। তার বাবা তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে চাপ দিতে শুরু করে সরকার।
একপর্যায়ে মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। এ বিষয়ে মতিয়া জানান, তারা বাবাকে একটি চিঠি দেয়া হয়, যাতে লেখা ছিল ‘কন্ট্রোল ইয়োর ওয়ার্ড (Ward), আদারওয়াইজ ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন শুড বি টেইকেন এগেইনস্ট ইউ।’
এরপর মতিয়া চৌধুরী সিদ্ধান্ত নেন বাবাকে অভিভাবকের দায়িত্ব থেকে ভারমুক্ত করার। তিনি তার ভাইয়ের মাধ্যমে বজলুর রহমানকে চিঠি পাঠান, যাতে বজলুর রহমান বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। চিঠি পেয়ে মতিয়া চৌধুরীর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন বজলুর রহমান। মতিয়া চৌধুরীর বাবা তার সঙ্গে কথা বলেন।
তখন মতিয়া তার বাবাকে জানান, তিনি অভিভাবকত্ব থেকে তাকে মুক্তি দিতে চান। এর প্রতিক্রিয়ায় তার বাবার মুখে কষ্টের ছায়া পড়ে। তিনি বজলুর রহমানের প্রস্তাবে আপত্তি না করে তাকে পারিবারিকভাবে প্রস্তাব পাঠাতে বলেন। পরে বজলুর রহমান অভিভাবকদের নিয়ে মতিয়া চৌধুরীর বাসায় গিয়ে প্রস্তাব দেন। আলাপ-আলোচনা শেষে দুই পরিবারের সম্মতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৬৪ সালের ১৮ জুন তাদের বিয়ে হয়।
মতিয়া চৌধুরী পিরোজপুরে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট বাংলাদেশি নারী রাজনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি জাতীয় সংসদ এর সংসদ উপনেতা এবং আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য।তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থী রাজনীতি দিয়ে। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর সদস্য ছিলেন, তিনি নকলা নালিতাবাড়ী এর রানিং এমপি। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া,দ্যা ডেইলি স্টার, কালের কন্ঠ