সৈয়দ আসিফ শাহকার তারুণ্যের প্রতিবাদী এ পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সুইডিশ বিচারপতি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেলেন
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেলেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সুইডিশ বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত বিচারপতি আসিফ শাহকার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লেখেন।
দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে (নং-০৩ নাগ/জিএন-০৭/২৩, বহি:৩) সৈয়দ আসিফ শাহকারকে নাগরিকত্ব সনদ প্রদান করা হয়।
এতে বলা হয়, ‘যেহেতু আসিফ শাহকার সৈয়দ, যাহার বিবরণ নিম্নে পদত্ত হইলো, নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করিয়াছেন এবং অনুরূপ নাগরিকত্বের সনদ প্রদানের ব্যাপারে তিনি সরকারকে সন্তুষ্ট করিয়াছেন। সেহেতু, এক্ষণে বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ (টেম্পোরারি প্রভিশন্স) অর্ডার, ১৯৭২ (পি.ও. নং ১৪৯ অব ১৯৭২)-এর আর্টিকেল ৪ এবং উক্ত অর্ডার এর অধীনে প্রণীত বিধিমালায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার এতদ্বারা উক্ত আসিফ শাহকার সৈয়দকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করিলেন এবং ঘোষণা করিলেন যে, উক্ত অর্ডার এর বিধানাবলী সাপেক্ষে, তিনি বাংলাদেশের একজন নাগরিক বলিয়া গণ্য হইবেন এবং বাংলাদেশের একজন নাগরিক যে সব অধিকার, সুযোগ সুবিধা ও যোগ্যতার অধিকারী তিনিও সেই সব অধিকার সুযোগ-সুবিধা ও যোগ্যতার অধিকারী হইবেন এবং বাংলাদেশের যে কোন কিংবা সকল আইন অনুসারে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের যে সকল দায়িত্ব, কর্তব্য ও দায় থাকিবে তাঁহারও সেই সকল দায়িত্ব, কর্তব্য ও দায় থাকিবে।’
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় সৈয়দ আসিফ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে দেয়া টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আজ আমার নতুন জন্ম হলো। ১৯৭১ সাল থেকে যে দেশ এবং দেশের মানুষকে আমি ভালোবাসি, সেই দেশের নাগরিক হিসেবে আমি আজ পুনর্জন্ম লাভ করলাম। আমি আজ সবচেয়ে আনন্দিত এজন্য যে, বাংলাদেশের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে আমি শেষ নিদ্রায় শায়িত হতে পারবো।’
তিনি জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘মহান নেতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি সালাম জানাই। আমি মনে করি বিশ্বের হাজার হাজার বঙ্গবন্ধুর অনুসারী এই পৃথিবীকে স্বর্গ করতে পারে। পাকিস্তানের যদি বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা থাকত তাহলে তা বিশ্বের একটি দৃষ্টান্ত হতো। আমি মানবতার জননী শেখ হাসিনাকে সালাম জানাই, যিনি আমার স্বপ্নকে সত্য করেছেন। আমি তাঁর কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকব। আমি যেন, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশের সেবা করতে পারি।’
নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), আমরা একাত্তর এবং লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ জহিরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছি। তবে, বাসস এবং লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ জহির-এর কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
তিনি সুইডেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেহেদী হাসান, তার ফার্স্ট সেক্রেটারি আশরাফ মোহন এবং এম্বেসির কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং ধন্যবাদ জানান।
লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ জহির বলেন, সৈয়দ আসিফের চিঠিটি হাতে পাওয়ার পর তিনি এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপনের উপযুক্ত করে তৈরি করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. ক. ম. মোজাম্মেল হকের সঙ্গে দেখা করে সৈয়দ আসিফ শাহকারের আবেদনের কথা জানান। মন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইসরাত জাহান পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠান। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ও স্বাক্ষরের পর এটি সংশ্লিষ্ট দপ্তর হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। বুধবার এই চিঠির মাধ্যমে তা সম্পন্ন হলো।
সুইডেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেহেদী হাসান জানান, বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকারের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে সুইডেনে বাংলাদেশ এম্বেসি থেকে সৈয়দ আসিফ শাহকারের সঙ্গে যোগাযোগ এবং স্থানীয়ভাবে খোঁজ খবর নেয়া হয়েছে। তার সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রমাণক বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সরবরাহ করা হয়েছে।
সৈয়দ আসিফ শাহকার ১৯৪৮ সালের ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানের পাঞ্জাবের হরোপ্পায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি তরুণ। পাঞ্জাব স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন। ২৫ মার্চের কালরাত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের নির্মম ও নৃশংস জেনোসাইডের প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকদের একটি অংশ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে প্রতিবাদ, সমাবেশ, কবিতা লেখা ও লিফলেট বিতরণ করেন এই তরুণ। আর তার পরিণামে তিনি নিজ পরিবার, সমাজ ও দেশের মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠেন। তাকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে কারাদণ্ড দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি পাকিস্তানের কারাগারে নানারকম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের বিপক্ষে যাননি। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ বাংলাদেশের বিজয়ের পর সৈয়দ আসিফ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি কিছুদিন লাহোরে পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু নিজ দেশে ‘কুলাঙ্গার’ হিসেবে স্থায়ী পরিচিতি নিয়ে তিনি বেশিদিন পাকিস্তানে থাকতে পারেননি। ১৯৭৭ সালে তিনি সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে যান। নতুন এক জীবন যুদ্ধ শুরু করেন। পরবর্তীতে সেখানেই তিনি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান এবং কাজ শুরু করেন।
স্বাধীনতার ৪১ বছর পর ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে বিচারপতি আসিফ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে আসেন। রাষ্ট্রপ্রতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তার হাতে সম্মাননা তুলে দেন। এরপরই ২০১৬ সালে তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লেখেন। কিন্তু সে চিঠির কোনো উত্তর তিনি পাননি।
সুইডেনের স্টকহোমে বসবাসরত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকার বাংলাদেশের জন্য কাজ করে চলেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর পরিচালিত নৃশংস জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিতেও তিনি সোচ্চার। ২০২২ সালের ৩ অক্টোবর জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদর দপ্তরে জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে তিনিও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরামের সহায়তায় নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক প্রবাসী সংগঠন বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ, আমরা একাত্তর ও প্রজন্ম ৭১’ আয়োজিত এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। সেখানেই তিনি বাসুগ প্রধান বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়ার মাধ্যমে বাসসের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফোনে তার ইচ্ছের কথা জানান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা তার চিঠি পাঠান।
সৈয়দ আসিফের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে এবং প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিটির অনুবাদ বাসস থেকে প্রকাশ করা হয়, যা পরবর্তীতে অন্যান্য গণমাধ্যমে ও প্রকাশিত হয়। গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর, শাহকার আমরা একাত্তর-এর চেয়ারপারসন মাহবুব জামান ও প্রধান সমন্বয়ক হিলাল ফয়েজীকেও ফোনে তার অন্তিম ইচ্ছের কথা জানান। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা একাত্তরের পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানানো হয়। তারা প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি ইহসানুল করিম হেলালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আবেদনপত্র পেশ করেন। পরবর্তীতে তারা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কাছেও একই আবেদনের অনুলিপি পেশ করেন।
২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিয্দ্ধু মৈত্রী সম্মাননা প্রদানকালে লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ জহির সৈয়দ আসিফের মুক্তিয্দ্ধু মৈত্রী সম্মাননা সনদটি রচনা করেন। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই বাসস থেকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি আসিফ লে. কর্নেল সাজ্জাদ জহিরকে ফোনে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ জানান। এরই প্রেক্ষিতে লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ জহির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করেন। এর প্রেক্ষিতে বিচারপতি আসিফের অন্তিম ইচ্ছে পূরণ হলো। বাংলাদেশের আরেকজন অকৃত্রিম বন্ধ জুলিয়ান ফ্রান্সিসের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির ব্যাপারেও সাজ্জাদ জহির প্রধান দায়িত্ব পালন করেন।
তথ্যসূত্র: বাসস