১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায়। এর প্রায় ২০০ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুরের মুজিবনগর আম্রকাননে স্বগর্বে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য। সরকার ঘোষণা ও শপথ গ্রহণের পর ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত, অশ্রু এবং কোটি জনতার আত্মত্যাগের সুমহান ঐতিহ্য সৃষ্টি করে ৯ মাসের এক বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। যে কারণে দিনটি প্রতিটি বাঙালীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পাকিস্তান। বাংলাদেশ তখন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে অখণ্ড পাকিস্তানের একটি প্রদেশের মর্যাদা পায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এদেশকে শোষণ-নির্যাতনের কেন্দ্রস্থল করে দীর্ঘ চব্বিশ বছর তাদের করায়ত্তে রাখে। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির অধিকার আদায়ের সূচনা হয়। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের শাহাদৎ বরণকারী শফিক, রফিক, জব্বার, বরকত এর রক্তে স্বাধীনতার বীজ রচিত হয়। ১৯৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এগিয়ে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে রয়েছে বিপুল আত্মত্যাগ ও শোষণ নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস। সেই ইতিহাসের এক গৌরবময় মাইলফলক মহান ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। অবশেষে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই পূর্ববাংলার রাজনীতির মোড় ঘুরে যায় স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে। পাকিস্তানি শাসকদের হাতে নির্যাতিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৩ সালে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠিত হয়।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববাংলার আইন পরিষদের ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে পূর্ববাংলায়; শুরু হয় ষড়যন্ত্র। বাঙালি অবাঙালি দাঙ্গা বাঁধিয়ে যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক সরকার বাতিল করা হয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ১৯৫৮ সালের ৩০ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের আসন দখল করেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। ১৯৬১ সালের শেষের দিকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ এনে পাকিস্তান সরকার ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে। এর বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানী গণ-আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সমাজের ১১ দফা কর্মসূচী ঘোষণার পর গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ লাভ করে। শেষ পর্যন্ত গণ জোয়ারের চাপে আইয়ুব খান ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ মামলার সকল আসামীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।
১৯৬৯ সালে এক বিশাল জনসমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে পাক-সরকার গোপনে ষড়যন্ত্র শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসমাবেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চ গভীর রাতে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা শুরু হয় বাংলার বুকে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে।
কৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে কোন ভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে ১ মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য মূলতবি ঘোষণা করেন।
এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুত হতে আহ্বান জানানজাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তা বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ ভাষণ, এ ভাষণে রয়েছে বহুমাত্রিক বিশেষত্ব মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সেটি বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ ভাষণ। এ ভাষণে রয়েছে বহুমাত্রিক বিশেষত্ব। মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে… উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব, তখন বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তাঁর চূড়ান্ত নির্দেশ, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান তিনি। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়। পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক দিক নির্দেশনার পথ ধরেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্র আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে মুজিবনগর সরকার গঠনের ঘোষনা দেয়া হয় ।এই ঘোষণাটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি বিশেষ এবং ঐতিহসিক ঘটনাবলির একটি। মূলত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় মুজিবনর সরকার গঠনের অনুপ্রেরণা জাগায়। তারই পরিপেক্ষিতে ১৬৭ জন এমএনএ এবং ২৯৩ এমপি একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করা চেষ্টা চালিয়ে যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, মুজিবনগর দিবস আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১০ ই এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদেশ ঘোষণা করা হয়। তারপরই কুষ্টিয়া জেলার (প্রাক্তন মহকুমা) মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল। শপথ অনুষ্ঠানের সাক্ষী ছিল কয়েকশ বিদেশি সাংবাদিক। যারা নতুন একটি দেশের জন্মের সাক্ষী হওয়ার জন্য সেখানে সমবেত হয়েছিল।
মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এম মনসুর আলী কে অর্থমন্ত্রী এবং এম কামারুজ জামানকে স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। খন্দকার মোস্তাক আহমেদকে পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী হিসেবে রাখা হয়। জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী কে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।