ইতিহাস কথা কয়
রুহুল কুদ্দুস টিটো
১৯৪৭ সালে দখলদার বৃটিশ রাজশক্তি ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হলে থেকে এই উপমহাদেশ বিভাজনের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান এ দু’টি দেশের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখোয়া, সিন্ধু, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা, এই রাজ্যগুলো নিয়ে গঠিত হয়। পরবর্তীতে প্রতিবেশী রাজতান্ত্রিক কাশ্মীর রাজ্যের পশ্চিমাংশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধিকারে আসে। অপরদিকে মূলতঃ হিন্দু ও শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যগুলো নিয়ে অধুনা ভারত রাষ্ট্রটি গঠিত হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান তৈরির পেছনে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর যুক্তিতে সায় দিলেও পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা কখনই তাদের বাঙালি জাতিসত্তা এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেছিল না।
পাকিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা যেহেতু দেশের পশ্চিমাংশে ঘাঁটি গাড়েন, শাসন ক্ষমতাও সেখানেই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। সেই সাথে শুরু হয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সমস্ত ক্ষেত্রে দেশের অন্য একটি অংশের নাগরিকদের প্রতি পদে পদে বৈষম্য।
পাকিস্তানি শাসনের মূল বিষয় ছিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণ। বাঙালিরা পাকিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র ও শিল্পকারখানার প্রতিনিধিত্বে বাঙালিরা ছিল সংখ্যালঘু। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট বেঁধে পাকিস্তান সেনা ছত্রচ্ছায়ায় পুঁজিবাদী আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া চালায়। পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীর বিপুল অনুদান এবং মার্কিন প্রশাসন ও হার্ভার্ডভিত্তিক মার্কিন পরামর্শকদের উৎসাহে ভর করে সামরিক শাসকেরা ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সালের মেয়াদে প্রবৃদ্ধিভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতি গ্রহণ করে।
মোহাম্মাদ আইয়ুব খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন অধিকারিক ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার পর থেকে আইয়ুব প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বৈরীপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন এবং সেনাবাহিনীর তৎকালীন সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে নিযুক্ত করেন তিনি; ২৭শে অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জাকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে নিজে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর থেকে আইয়ুব খানের ক্ষমতায় আসার পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ নয় বছরের ভেতরও পাকিস্তানে কোন সাধারণনির্বাচন হয় নি। ফলে কখনোই জাতীয়ভিত্তিক নির্বাচনী কাঠামো নিশ্চিত হয়নি। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানে একটি নতুন ধরনের নির্বাচনী কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তিছিল মৌলিক বা বুনিয়াদী গণতন্ত্র। মৌলিক গণতন্ত্র হচ্ছে এক ধরনের সীমিত গণতন্ত্র যাতে কেবলমাত্র কিছু নির্দিষ্ট লোকের অধিকারে জাতীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের অধিকার ছিল।
মৌলিক গণতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে কোন গণতন্ত্র ছিল না। বরং এটি ছিল অনেকটা স্বৈরতান্ত্রিক কৌশল। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষমতা সংহত করে আইয়ুব খান দেশের বিরোধী নেতা-কর্মীদের জব্দ করার পথ ধরেন।
স্বৈরতান্ত্রিক কৌশল পোডো এবং এবডো: পোডো(PODO, Public Office Disqualification Order) এবং (EBDO, Elective Bodies Disqualification Order)এবডো আইন দেশের বিরোধী রাজনীতিবিদদের জব্দএবং হয়রানি করার জন্য দু’টি নির্বতনমূলক আইন আইয়ুব সরকার কর্তৃক জারি করা হয়েছিল।এর মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের বিচারের জন্য বিশেষ আদালত গঠন করা হয় এবং সেখানেঅভিযুক্ত ব্যক্তি আইনজীবীর সহায়তা পেতেন না। বিচারের মাধ্যমে শাস্তি হিসাবে রাজনৈতিকনেতা বা নির্বাচিত ব্যক্তিদের বিভিন্ন মেয়াদের জন্য রাজনীতিতে, সরকারি পদের জন্য বা এমন অন্যকোন কাজের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হতো। শুধু এবডো আইনের মাধ্যমেই প্রায় ৮৭৭জন রাজনীতিবিদ অযোগ্য ঘোষিত হন। তাঁদের মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খান আবদুল গাফফারখান, মিয়া দৌলতানা প্রমুখ অন্যতম।
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন রেডিও এবং টেলিভিশনে দেওয়া এক বার্তার মাধ্যমে এবং তিনি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে দেশের অবস্থা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন বলে বলেন।
ইয়াহিয়া খান ঐদিন দুপুর দুইটায় আরেকটি রেডিও এবং টেলিভিশন বার্তায় নিজেকে দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেন, ঐদিনই রাতে তিনি আবার শুধু রেডিওবার্তায় নিজেকে দেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন। আইয়ুবের করে যাওয়া সকল সাংবিধানিক পরিবর্তন বাতিল সহ ইয়াহিয়া দেশে নতুন করে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেন।
১৯৬৯ সালের যে গণঅভ্যুত্থানের কারণে আইয়ুব পদত্যাগ করেছিলেন সেই গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে ইয়াহিয়া বলেন,
আমি কোনো বিশৃঙ্খলা সহ্য করবোনা, সবাইকে যার যার পদে রাখা হোক। (I will not tolerate any disorder, let everyone remain in his post.)
ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মির্জা নুরুল হুদাকে সরিয়ে মেজর-জেনারেল মোজাফফর উদ্দীনকে নিয়োগ করেন (এ পদে পরে লেঃ জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান নিয়োগ পান) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে সেনা মোতায়েন করা হয় যাতে ছাত্ররা আন্দোলন করতে না পারে। বাঙালিদের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নতুন ব্যাটেলিয়ন গঠনের কথাও ইয়াহিয়া সেনা সদর দপ্তরে বলেন।
১৯৬৯-১৯৭০ অর্থবছরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ইয়াহিয়া নতুন বাজেট প্রণয়ন করেন যেটাতে অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে ২.৮ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় যদিও এটা বাস্তবায়িত হয়নি।
ইয়াহিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যেটাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শেখ মুজিবুর রহমান জয়ী হন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো হতাশা প্রকাশ করে ইয়াহিয়াকে বলেন মুজিবকে যেন ক্ষমতা দেওয়া না হয়, কারণ তিনি ক্ষমতায় গেলে পাকিস্তান ভেঙে দেবেন।
ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের বহু রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে একমত হন যে মুজিবকে ক্ষমতা দেওয়া যাবেনা কারণ তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং ১৯৬৮ সালের আগরতলা মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে খণ্ডিত করার জন্য।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ছিলেন একাধারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনী প্রধান, তথ্য এবং সম্প্রচার বিষয়ক মন্ত্রী, আইন এবং বিচার মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এছাড়া জেনারেল হামিদ খান কে তিনি সেনাপ্রধান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ভাইস এ্যাডমিরাল সৈয়দ মুহাম্মদ আহসানকে অর্থমন্ত্রী এবং বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন আর বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল নূর খানকে স্বাস্থ্য এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল’ নামের এক নতুন সভার সভাপতিত্ব করতেন ইয়াহিয়া, মেজর-জেনারেল গোলাম ওমর ছিলেন ইয়াহিয়া খানের প্রতিরক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা।
পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন, যেটাতে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ ঘটে। ইয়াহিয়া সরকার এ ভাষণ দেখে পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে আলোচনার জন্য সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে এক সভার আয়োজন করেন, যেখানে অধিকাংশ জেনারেল পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হামলা করার বিষয়ে মত দেন, তারা সবাই বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের গুটি কয়েক ছাড়া সব বাঙালিই পাকিস্তানকে খণ্ডিত করতে চায় এবং এজন্যে তারা সশস্ত্র হচ্ছে বলে গোয়েন্দারা জানিয়েছে, তাছাড়া ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগ তাদের আছে এবং তারাও নাকি তাদেরকে সাহায্য করবে বলে বলেছে।
বাঙালিরা মুক্তিবাহিনীতে ঢুকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই-এ লিপ্ত হয় যা তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি পায়। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন মে’মাসে এবং ঐ দেশের রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনকে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে তার সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদ-বিরোধী সামরিক অভিযানে লিপ্ত হয়েছে। যদিও জুলাই মাসে তিনি নিক্সনকে টেলিফোনে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদ বিরোধী সামরিক অভিযান এখন গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে।
১৯৭১ সালের নভেম্বরে ইয়াহিয়া ভারতের সঙ্গে পশ্চিম ফ্রন্টেও যুদ্ধ করার কথা ভাবেন, এবং ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের বিমান ঘাঁটির ওপর বোমা বর্ষণ করলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ জড়ানোর নির্দেশ তার দেশের তিন বাহিনীকে।
ডিসেম্বর ১৯৭১ এর দ্বিতীয় সপ্তাহে ইয়াহিয়া বুঝে যান যে যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত, তাই তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজীকে ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বললেও নিয়াজী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান, যদিও দুইদিন পর তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে তার ৫ ডিভিশন সেনাসদস্য (প্রায় ৩০,০০০ সামরিক সদস্য) এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ বিষয়ক দলিলে স্বাক্ষর করেন।২০ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়ে দিয়ে যান।
যে বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী জেনিফার কোটস পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই নিয়ে গবেষনাধর্মী একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। ঐ বইতে তিনি লেখেন, “পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির অনেক অমিল ছিল এবং বাঙালিরা তাদের সংস্কৃতি রক্ষা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল।“
কিন্তু বিশেষ করে ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও বাঙালিদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কঠোর নজরদারিতে পড়ে।
জেনিফার কোটস লেখেন, “১৯৫৮ সালে পাকিস্তান শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে ভিন্ন খাতে – তারা বলতো সঠিক খাতে- পরিবর্তনের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চাপ দেওয়া।
”ইসলামি সংস্কৃতি ঢোকানোর চেষ্টা শুরু হয়। জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো তৈরি হয় যার প্রধান কাজই ছিল বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন। সরকারের নীতির স্তুতির জন্য লেখক বুদ্ধিজীবীদের গাড়ি-বাড়ি-টাকা উপঢৌকন দেওয়া শুরু হয়। তাদের বিদেশে ভ্রমণের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
”প্রেস এবং পাবলিকেশন আইন করে ১৯৬১ সালে সংবাদপত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দারুণভাবে খর্ব করা হয়।“
এমনকি ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান এবং আইয়ুব খানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন সরকারি প্রচারমাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম প্রচার নিষিদ্ধ করে দেন। নজরুল ইসলামের কবিতা প্রচারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়, এমনকি তার কবিতার অনেক শব্দ উর্দু করে নতুন করে প্রকাশ করা হয়।
মিজ কোটস তার বইতে লিখেছেন কয়েকটি গ্রুপকে শায়েস্তার জন্য সনাক্ত করা হয়: ১. যেসব শিক্ষকের সাথে আওয়ামী লীগের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে, কারণ তারা স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে কাজ করবে। ২. নাম করা বুদ্ধিজীবী তা তিনি সরাসরি রাজনীতিতে থাকুন আর নাই থাকুন। ৩. বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ৪. ছাত্র এবং বিপ্লবী রাজনীতিক।
“মোদ্দা কথা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করছেন, জাগিয়ে রাখছেন, প্রচার করছেন এমন যে কেউই টার্গেট। ২৫শে মার্চের রাতের হামলার টার্গেট এবং নৃশংসতা দেখে বোঝা যায় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা তাদের নিয়ন্ত্রণ আরোপের পথে কাদের প্রধান সমস্যা মনে করতেন,“ মিজ কোটস লেখেন।
বছরের পর বছর এসব অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক-সংস্কৃতি নির্যাতন বাঙালিদের পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে মনস্তাত্বিকভাবে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করেছে এবং তাদের মধ্যে দিনে দিনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ শক্ত হয়েছে।
পাকিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা যেহেতু দেশের পশ্চিমাংশে ঘাঁটি গাড়েন, শাসন ক্ষমতাও সেখানেই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। সেই সাথে শুরু হয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সমস্ত ক্ষেত্রে দেশের অন্য একটি অংশের নাগরিকদের প্রতি পদে পদে বৈষম্য।
যেখানে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অংশে মাথাপিছু আয় ছিল সমান, ১৯৭১ সালে পশ্চিমের মানুষের আয় পূর্বের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ঐ ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগের অভাবে শত শত স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু পশ্চিমে বেড়ে গেছে তিন গুণ।
গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে, সেনাবাহিনীর উঁচু পদে বাঙালিদের নিয়োগ পাওয়া খুব কঠিন ছিল। সেই সাথে, বিনিয়োগে অবহেলার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে হয়ে উঠেছিল পশ্চিমের কল-কারখানার কাঁচামালের যোগানদাতা এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রধান ক্রেতা।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল তার ‘ডেডলি এমব্রেস‘ বইতে লিখেছেন পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই “পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয়“ এবং বাঙালিদের “দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক“ হিসাবে দেখা হতো।
কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক মোহাম্মদ নিয়াজ আসাদুল্লাহ ২০০৬ সালে তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিমের চেয়ে বেশি হওয়া স্বত্বেও সরকারি উন্নয়ন বরাদ্দে বৈষম্য কতটা পাহাড় সমান ছিল।
পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৫০-৫৫), কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দের মাত্র ২০ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৬৫-৭০) সেই বরাদ্দ বাড়লেও তা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ ।
মি. আসাদুল্লাহ লিখেছেন, একেতো বরাদ্দ অনেক কম দেওয়া হতো, তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রকাশ্যে এবং গোপনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে তহবিল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জটিল সব কর ব্যবস্থায় আড়ালে নানা খরচ দেখিয়ে এই তহবিল নিয়ে যাওয়া হতো। এক হিসাবে ২৫ বছরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাচার এই টাকার পরিমাণ ছিল ২৬০ কোটি ডলার।
বছরের পর বছর বরাদ্দে এই বৈষম্যের শিকার হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের অবকাঠামো, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা। ভারত ভাগের সময় পাকিস্তানের দুই অংশে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল প্রায় সমান। কিন্তু ১৯৭১ সালে এসে পূর্ব পাকিস্তানে ২৪ বছরের আগের তুলনায় প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা কমে যায়। অথচ পশ্চিমে ১৯৬০ এর দশকে এসেই প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা তিনগুণ বেশি হয়ে যায়।
উনিশ’শ একান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তানে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা ছিল ৪১০০০ আর পশ্চিমে ছিল ৪৫০০০। কিন্তু দশ বছর পর ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গ্রাজুয়েট তৈরি হয় ২৮০০০, যেখানে পশ্চিমে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪০০০-এ।
অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা শেষ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে ঐ দশ বছরে ৩২ শতাংশ কমে গিয়েছিল, পশ্চিমে বেড়েছিল ২১ শতাংশ। সরকারি বৃত্তি, অনুদান প্রধানত পেয়েছে পশ্চিমের শিক্ষার্থীরা,কারণ বিজ্ঞাপন যখন পূর্বে প্রকাশিত হত তখন আবেদনের সময় থাকতো না।
চাকরির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এবং একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে সুযোগ প্রচারে এই দেরি করা হতো উদ্দেশ্যমুলকভাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ মে মাসের ১৯৭১ একটি গোপন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল যাতে তারা দেখার চেষ্টা করেছিল যে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে দুই ভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে তার কী পরিণতি হবে। দু’হাজার দশ সালে ঐ রিপোর্টের যে খণ্ডিত অংশ প্রকাশ করা হয়, তাতে দেখা যায় যে সিআইএ তখন মনে করেছিল পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পশ্চিম পাকিস্তান বড় ধরণের বাণিজ্য সঙ্কটে পড়বে কারণ তাদের পণ্যের যে মান তাতে বিকল্প বাজার পেতে তাদের সমস্যা হবে।
সিআইএর ঐ গোপন রিপোর্টে বলা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক যত বেড়েছে দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য সেই সাথে বেড়েছে, জীবনযাত্রার মানের তারতম্য বেড়েছে।
“পূর্ব পাকিস্তানকে বিনিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। তবে সেই বিনিয়োগ কখনই ঠিকমত আসেনি, বিশেষ করে ষাটের দশকের আগে। বেসরকারি বিনিয়োগও ছিল নামে মাত্র। ফলে পূর্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল খুবই নিম্ন। “
ঐ রিপোর্টে বলা হয়,
“১৯৭০ সালের বিধ্বংসী সামুদ্রিক ঝড় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি কতটা অসহায় এবং ভঙ্গুর। ঐ সাইক্লোনের পর কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।“
রাজনীতির শিক্ষক, লেখক এবং পাঞ্জাব প্রদেশের সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হাসান আকসারি রিজভি ১৯৭১ সালে ব্রিটেনে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে স্বাধীন হয়। ফলে, পাকিস্তানের ঐ পর্ব নিয়ে পরে তিনি অনেক পড়াশোনা এবং লেখালেখি করেছেন।
মি রিজভি বলেন,
পাকিস্তান ভাঙার পেছনে যে অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতাই মূল কারণ ছিল এই বোধোদয় এখন পাকিস্তানে অনেক বেশি। “এ নিয়ে পাকিস্তানে এখন অনেক খোলামেলা তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, বিশ্লেষণ হচ্ছে।“
“পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রাজনৈতিক এবং সামরিক শাসকরা এই বৈষম্যের বিষয়টি বুঝতে পারতেন না, বোঝার চেষ্টাও করতেন না। বিশেষ করে ৫৮ সালের পর সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার পর এই বোধোদয় আরো দূরে সরে গিয়েছিল।“
বিবিসিকে মি রিজভি বলেন, বাঙালিদের অসন্তোষ যত বেড়েছে শাসক শ্রেণী ততই বলেছেন ভারত এসব করাচ্ছে। “ সন্দেহ নেই যে ভারত পাকিস্তানের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে, কিন্তু ব্যর্থতার প্রধান দায় সে সময়কার শাসকদের।“
“তারা বোঝেননি শুধু ধর্ম দিয়ে ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব নয়। জাতীয় ঐক্যের জন্য যে ভাগাভাগি, সাম্য, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন, তা ছিলনা।“
পাকিস্তান কি এখন অনুশোচনা করে? প্রশ্নে মি. রিজভি বলেন, এ নিয়ে দুই ধরনের মতামত রয়েছে। “একদল মনে করে পাকিস্তান অটুট থাকলে আজ বিশ্ব রাজনীতিতে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের অনেক বেশি প্রভাব হতে পারতো। আরেক দল মনে করে পাকিস্তান এখন অনেক ম্যানেজেবল, সামাল দেওয়া সহজ হয়েছে।“
তবে মি. রিজভি মনে করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে পাকিস্তান।
তথ্য সূত্র: বিবিসি বাংলা/ উইকিপিডিয়া