ইসরাইলি বার্তা সংস্থার বিশ্লেষণ
হাজার হাজার সেনা প্রত্যাহার; গাজা যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে ইসরাইল!
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধরত পাঁচটি ব্রিগেড প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইহুদিবাদী ইসরাইল। তিনটি প্রশিক্ষণ ব্রিগেডের পাশাপাশি ৫৫১তম এবং ১১৪তম রিজার্ভ ব্রিগেড প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। একটি ব্রিডেগে সাধারণত তিন থেকে পাঁচ হাজার সেনা থাকে। সে হিসাবে ১৫ থেকে ২৫ হাজার সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে তেল আবিব।
ইহুদিবাদী সংবাদ মাধ্যম ইয়েদিওত আহরোনোথ জানিয়েছে, ইসরাইলি অর্থনীতিকে মারাত্মক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এসব সেনা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ইসরাইলি বাহিনী দাবি করেছে, গাজা উপত্যকার উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে তাদের লক্ষ্য ব্যাপকভাবে অর্জিত হওয়ায় এসব সেনা আর সেখানে মোতায়েন করে রাখার প্রয়োজন নেই।
ইহুদিবাদী ইসরাইল এর আগে গতমাসে গাজা থেকে তাদের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত ও দুর্ধর্ষ গোলানি ব্রিগেড প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। গাজা থেকে বিপুল সংখ্যক সেনা প্রত্যাহারের এই ঘটনাকে ইসরাইলি বাহিনীর জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা প্যালেস্টাইন ক্রনিক গাজা যুদ্ধের বাস্তব তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে একথা বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, এই যুদ্ধে ইসরাইলের পরাজয়ের লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। উত্তর ও মধ্য গাজায় ইসরাইলি সেনারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করে ফেলেছে বলে যে দাবি করেছে, বার্তা সংস্থাটি তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্যাল্টেস্টাইন ক্রনিক লিখেছে:
উত্তর ও মধ্য গাজায় লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার দাবি কি সত্য?
একেবারেই না।
গাজা উপত্যকায় যে ১৭ ব্রিগেড ইসরাইলি সেনা মোতায়েন রয়েছে তাদের মধ্যে উত্তর গাজায় এখনও চার ব্রিগেড সেনা যুদ্ধ করছে এবং সেখানকার যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু মধ্য গাজার স্থলযুদ্ধ এখন পর্যন্ত আল-বুরেজ শরণার্থী শিবিরের পূর্ব সীমান্তই অতিক্রম করেনি। ইসরাইলি বাহিনীর কয়েকটি ব্রিগেড একসঙ্গে চেষ্টা করেও মাত্র কয়েক বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট একটি এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
নুসিরাত, মাগাজি কিংবা দেইরাল বালাহ এলাকায় এখনও সংঘর্ষ শুরুই হয়নি। অথচ এই তিনটি শরণার্থী শিবিরে ৭ অক্টোবর থেকে অবিরাম বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে ইসরাইলি সেনারা। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকায় ইসরাইলের সাতটি ব্রিগেড যুদ্ধ করে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তারা উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য পেয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
এটি কি সেই কথিত তৃতীয় পর্যায়ের যুদ্ধ শুরুর ইঙ্গিত?
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরাইলি গণমাধ্যম দাবি করে আসছে যে, শিগগিরই গাজা যুদ্ধের তৃতীয় পর্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। কিন্তু তৃতীয় পর্যায় শুরু হতে যাওয়ার অর্থ মোটেও একথা নয় যে, প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের যুদ্ধে ইসরাইল বিজয়ী হয়েছে; যদিও তেল আবিব সেরকম কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করছে। ইসরাইল মূলত একের পর এক পর্যায়ের কথা বলে জনমনে এমন ধারনা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে যে, যুদ্ধ তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে।
কিন্তু সত্যিই কি যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে?
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মূল সমস্যা হচ্ছে, তেলআবিব হামাসকে ধ্বংস করে গাজা পুনর্দখলের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যুদ্ধ শুরুর দিন থেকে সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের মতো কোনো সুস্পষ্ট সামরিক পরিকল্পনা তাদের ছিল না।
শনিবার ইসরাইলি যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘আরো বহু মাস’ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু তার ওই ঘোষণার পরদিন অন্তত ১৫ হাজার সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, ইসরাইলি জনগণকে বোকা বানানো ছাড়া তার ওই অঙ্গীকারের অন্য কোনো অর্থ হয় না। ইসরাইলি বার্তা সংস্থা ওয়ালা নিউজ জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহে গাজা থেকে আরো সেনা প্রত্যাহার করার ঘোষণা আসতে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ নামকাওয়াস্ত সংঘাতে পরিণত হবে।
তাহলে কি যুদ্ধে হেরে গেছে ইসরাইল?
আরব-ইসরাইল সংঘাতের ইতিহাসে গাজায় নজিরবিহীন প্রতিরোধের মুখে পড়েছে তেল আবিব। এ অবস্থায় সেনা প্রত্যাহারের ঘটনাকে ইসরাইলি বাহিনীর জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা গেলেও এখনও এ বিষয়টি স্পষ্ট নয় যে, ইহুদিবাদীরা কি গাজা থেকে পুরোপুরি সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নাকি এখনও যেনতেন একটি জয়ের আশা তারা করছে।
কোনো কোনো ইসরাইলি গণমাধ্যম চতুর্থ পর্যায়ের যুদ্ধের কথা বলার চেষ্টা করছে। ওই পর্যায়ে গাজা উপত্যকা পুরোপুরি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসার কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যদি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পরাজিত করতে না পারে তাহলে তারা কীভাবে গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে?
ফিলিস্তিনিরা কি তাহলে জিততে যাচ্ছে?
‘বারজিলাই মেডিক্যাল সেন্টার’ নামক একটি ইসরাইলি হাসপাতাল রোববার জানিয়েছে, তারা ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৩,৫০০ আহত ইসরাইলি সেনার চিকিৎসা করেছে। এই এক হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণকারী এত বেশি সেনা ইসরাইলের ৭৫ বছরের ইতিহাসে কখনও আহত হয়নি; যদিও ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এই পরিসংখ্যান কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি।
কাজেই গাজায় ইসরাইল পরাজিত হতে যাচ্ছে এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা বিজয়ী হতে যাচ্ছেন- এটি বলা ছাড়া বিদ্যমান পরিস্থিতিকে অন্য কোনো ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে গাজা থেকে বিপুল সংখ্যক ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার করাকে কোন অবস্থায়ই অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা সুযোগ নেই।
ইসরাইলি জেনারেলের তির্যক মন্তব্য
ইহুদিবাদী সেনারা গাজার কাদায় আটকে গেছে, লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ
ইসরাইলের সন্ত্রাসী সেনারা গাজার গাদায় আটকে গেছে এবং তারা হামাসকে ধ্বংস করার মতো অবাস্তব লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ইসরাইলের সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ইৎজাক বারিক।
ইসরাইলের মারিভ পত্রিকায় গতকাল (সোমবার) এক কলামে তিনি এই কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ইসরাইল একটি “দুষ্ট চক্রের” মধ্যে আটকা পড়েছে এবং “যুদ্ধক্ষেত্রের তথ্য” উপেক্ষা করার জন্য এবং কল্পনার জগতে বাস করার জন্য সরকারকে নিন্দা করেছেন।
কলামে জেনারেল বারিক বলেন, “যতই দিন যাচ্ছে ততই আমরা যুদ্ধের লক্ষ্যগুলো অর্জন থেকে পিছিয়ে পড়ছি, হামাসকে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না এবং গাজা থেকে বন্দিদেরও মুক্ত করা যাচ্ছে না। আমরা দিন দিন গাজার কাদায় আরো বেশি ডুবে যাচ্ছি।”
জেনারেল বারিকের মতে, রাফায় হামাসের রাজত্ব ধ্বংস এবং টানেলের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হওয়ার অর্থই হচ্ছে নেতানিয়াহু সরকার হামাসকে নির্মূলের যে লক্ষ্য ঠিক করেছিল তা অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ফলে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জেনারেল ইৎজাক বারিক আরো বলেন, “এই যুদ্ধ প্রতিদিন আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি বয়ে এনেছে, এই ক্ষতি হয়েছে হামাসের গোলাবারুদ এবং তাদের পেতে রাখা ফাঁদ থেকে, এই ক্ষতি হয়েছে হামাসের ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র থেকে। এ অবস্থায় নেতানিয়াহু সরকারকে অবশ্যই যুদ্ধের পরিস্থিতি নতুন করে বিবেচনা করতে হবে।
চড়া মূল্যে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার
‘বিরানভূমি’ উত্তর গাজায় ফিরতে শুরু করেছেন ফিলিস্তিনিরা
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চল থেকে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া লোকজন নিজেদের বসতভিটায় ফিরতে শুরু করেছেন। তবে দখলদার সেনাদের বর্বর আগ্রাসনে এরই মধ্যে উত্তর গাজা বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে; সেখানে বসবাসের জন্য তেমন কোনো ঘরবাড়ি আর আস্ত নেই।
ইহুদিবাদী ইসরাইল গাজা থেকে বেশকিছু সেনা প্রত্যাহার করার পর ফিলিস্তিনিরা নিজেদের বসত ভিটায় ফিরতে শুরু করেছেন। গত তিন মাসের যুদ্ধে বহু ইসরাইলি সেনা হতাহত হয়েছে এবং তাদের বিপুল সংখ্যক ট্যাংক ও সাঁজোয়াযান ধ্বংস হয়েছে।
উত্তর গাজায় ফিরে আসা এক নারী আল-জাজিরা টেলিভিশনকে জানিয়েছেন, লোকজন তাদের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপের ভেতরেই শুয়ে বসে সময় পার করছেন। বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসস্তূপের ভেতরে এখনো রক্ত এবং মৃত্যুর চিহ্ন বিদ্যমান।
এই নারী বলেন, ব্যাপক অপরাধ ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ইহুদিবাদী সেনারা। কিন্তু এখানকার লোকজন সবসময়ই দখলদার সেনাদের চেয়ে নৈতিক শক্তি ও মনোবলের দিক দিয়ে অনেক বেশি এগিয়ে।
আরেক নারী বলেন, খাদ্য এবং পানির অভাব থাকলেও তিনি কখনো উত্তর গাজা ছেড়ে যাবেন না। তিনি বলেন, যতই দুঃখ-কষ্ট আসুক আমি আমার ভূমি এবং পরিবার ছেড়ে যাব না।
এর আগে গতকাল (সোমবার) ইহুদিবাদী ইসরাইলের বর্বর সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা গাজা থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে। ইসরাইলি সেনা মুখপাত্র বলেন, যুদ্ধের অবসান নয় বরং সেনাদের বিশ্রামের জন্য এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
সংবাদ সূত্র: পার্সটুডে