ইসলাম অমুসলিমদের সাথে আচরণে ভদ্রতা ও সৌজন্য রক্ষা করার নির্দেশনা দেয় ।। ইসলাম প্রতিবেশীর অধিকার ও মর্যাদার প্রতি গুরুত্ব দেয়
রুহুল কুদ্দুস টিটো
প্রতিবেশীর অধিকার ও মর্যাদার প্রতি ইসলামে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রতিবেশী আত্মীয়–অনাত্মীয় কিংবা মুসলমান–অমুসলমান যা–ই হোক না কেন যেকোনো অবস্থায় সাধ্য অনুযায়ী তাদের সাহায্য-সহায়তা করতে হবে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতে তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সংকট নিরসন করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে।’
প্রতিবেশীর সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা বা ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত হওয়া অনুচিত। কেননা এতে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, সেই ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদে থাকে না।
প্রতিবেশীর সঙ্গে অবশ্যই উত্তম ব্যবহার করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ইমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে।
মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) সব যুগে জগতবাসীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ ও অনুকরণীয় ব্যক্তি। মহাপ্রলয় পর্যন্ত যেকোনও মানুষ তাঁর জীবন থেকে পাথেয় গ্রহণ করতে পারে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সহানুভূতিশীল আচরণের মাধ্যমেও তিনি মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁর উত্তম চরিত্রের সাক্ষ্য দিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন,
‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসুলের অনুসরণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ২১)
ইসলাম অমুসলিমদের সাথে আচরণে ভদ্রতা ও সৌজন্য রক্ষা করার নির্দেশনা দেয়। যদি কারও কোনো প্রতিবেশী কিংবা কোনো আত্মীয় অমুসলিম হয়, ইসলামের নির্দেশনা হল- তার সাথেও প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের হক রক্ষা করে চলতে হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ দুটি সম্পর্ক রক্ষা করার ওপর যথেষ্ট জোর দেয়া হয়েছে।
অমুসলিমদের সাথে সুন্দর ও সৌজন্যপূর্ণ আচরণ রক্ষার শিক্ষাপ্রদানের পাশাপাশি ইসলাম তাকিদের সাথে বারবার এ নির্দেশও দিয়েছে- ‘কোনো মুসলমান যেন কাফেরদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে।’ এবং এ তাকিদও করেছে, সৌজন্য ও উদারতার নামে যেন নিজেদের দ্বীনদারি আক্রান্ত না হয়। দ্বীনের বিষয়ে আপোস করা কোনোক্রমেই বৈধ নয়। এমনিভাবে সদাচরণের ক্ষেত্রে কোনো অমুসলিমকে মুসলিম ভাই থেকে প্রাধান্য দেওয়াও বৈধ নয়।
অমুসলিমদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে – যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করতে ও তাদের প্রতি ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তো তোমাদের তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করার কাজে একে অন্যের সহযোগিতা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারা জালিম। -(সূরা মুমতাহিনা :-৯)
সাহাবী হজরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, একজন প্রতিবেশীর ওপর আরেকজন প্রতিবেশীর কী হক রয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন,
‘যদি সে তোমার কাছে ঋণ চায় তাহলে ঋণ দেবে, যদি তোমার সহযোগিতা চায় তাহলে তাকে সহযোগিতা করবে, যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তার খোঁজখবর নেবে, তার কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে তাকে তা দেবে, সে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার খোঁজখবর নেবে, যখন সে ভালো কিছু লাভ করবে তখন তাকে শুভেচ্ছা জানাবে, যদি সে বিপদে পড়ে তাহলে সান্ত্বনা দেবে, মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় শরিক হবে, তার অনুমতি ছাড়া তোমার ঘর এত উঁচু করবে না যে তার ঘরে বাতাস ঢুকতে পারে না।
কোনো ভালো খাবার রান্না করলে তাকে এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে কষ্ট দেবে না, তবে যদি তার ঘরেও সে খাবার থেকে কিছু পৌঁছে দাও। যখন কোনো ফল কিনে তোমার বাড়িতে নেবে তখন হাদিয়াস্বরূপ তাকে সেখান থেকে কিছু দেবে। (খারায়েতী, তবারানী, আবুশ শায়খ- ফাতহুল বারী (২) খ. ১০, পৃ. ৫১৯, কিতাবুল আদব, বাব-৩১)
আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার বিষয়ে নির্দেশনা তো আরও স্পষ্ট। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে আল্লাহ ও পরকালে ঈমান এনেছে সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬১৩৮
প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার এই যে নির্দেশনা, তাতে মুসলিম-অমুসলিমের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। এমনটি বলা হয়নি- তোমার প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয় যদি মুসলমান হয়, ধার্মিক হয়, ভালো মানুষ হয়, তাহলে তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। বরং প্রতিবেশী ও আত্মীয় যেমনই হোক, মুসলমান হোক কিংবা না হোক, তার অধিকার অকাট্য ও অনস্বীকার্য। একজন মুসলমানকে এ অধিকার রক্ষা করেই জীবনযাপন করতে হবে।
সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর ঘটনা। একদিন তার ঘরে একটি বকরি জবাই করা হল। খাবার রান্না হলে তিনি তার গোলামকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের ইহুদি প্রতিবেশীকে কি এ খাবার দিয়েছ?’ এরপর তিনি বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, প্রতিবেশীর বিষয়ে জিবরাইল আমাকে এত উপদেশ দিচ্ছিলেন, আমি মনে করছিলাম, তিনি হয়ত তাদেরকে ওয়ারিশই বানিয়ে দেবেন।’ -জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৯৪৩
হযরত উমর রা.-এর একটি ঘটনা। তিনি তখন খলীফাতুল মুসলিমীন। একদিন এক ইহুদি বৃদ্ধকে দেখলেন মসজিদের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে বেড়াতে। তখন তিনি ইহুদিকে লক্ষ করে বললেন, আমরা তোমার ওপর ইনসাফ করতে পারিনি যদি তোমার যৌবনে আমরা তোমার নিকট থেকে জিয্য়া গ্রহণ করে থাকি আর তোমার বার্ধক্যে তোমাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেই। এরপর তিনি তার জন্যে বায়তুল মাল থেকে প্রয়োজনীয় ভাতার ব্যবস্থা করে দেন। -কিতাবুল আমওয়াল, ইবনে যানজূয়াহ্, ১/১৪৩, হাদীস ১৭৯
আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে মানবাধিকার ও ধর্মের মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না। কবিরা গোনাহের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় গোনাহ হলো—শিরক (আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা)। সেই সঙ্গে বলেন, কোনও মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করাও কবিরা গোনাহ। এখানে ‘মুসলমান’ বলেননি; বরং মুসলিম কিংবা অমুসলিম। যে কাউকে হত্যা করা বড় গোনাহ। (বুখারি শরিফ)
মুসলমানদের মধ্যে জাত-বংশের ভিন্নতা থাকলেও এটাকে স্রেফ পরিচয়ের মাধ্যম আখ্যায়িত করা হয়েছে। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে তাকওয়া তথা খোদাভীতিকে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘…তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী।…’। (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
পৃথিবীতে রাসুল (সা.)-এর আগমনেও ধর্ম-বর্ণের পার্থক্য করা হয়নি; আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত ও করুণা হিসেবে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে জগতসমূহের রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭) অর্থাৎ তিনি শুধু মুসলমানদের নবী হিসেবে প্রেরিত হননি। তার উম্মত ভিন্ন ধর্মের লোকেরাও। আর তিনি সারাটি জীবন সেভাবেই সবার কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন এবং সবার প্রতি সমান ব্যথিত ছিলেন।
একবার রাসুল (সা.)-এর সামনে দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এটি দেখে তিনি দাঁড়ালেন, তখন উপস্থিত সাহাবারা বললেন, এটি ইহুদির লাশ। রাসুল (সা.) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, সে কী মানুষ নয়? (বুখারি, হাদিস: ১৩১২)
মুসলিম দেশে রাষ্ট্রের আইন মেনে বসবাসকারী ভিন্নধর্মীদের জানের সুরক্ষা এবং মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মুসলিমদের দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনও ভিন্নধর্মী নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ তার সুগন্ধ ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস: ২৯৯৫)
ইসলাম ভিন্নধর্মীদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি করতে বাধা দেয় না। মহানবী (সা.) ইহুদিদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং যথাসময়ে তা পরিশোধ করে দিয়েছেন—এরকম একাধিক উদাহরণ রয়েছে। একবার নির্ধারিত সময়ের আগেই একজন ঋণদাতা ইহুদি এসে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে খারাপ আচরণ করলো, তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) এর কোনও প্রতিবাদ করলেন না; বরং সাহাবাদের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন।
প্রতিবেশী অভুক্ত থাকলে তাকে খাবার না দিয়ে নিজে পেট পুরে খাওয়া ইমানদারের পরিচয় হতে পারে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সেই মানুষটি পূর্ণ মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায়, অথচ তার পাশেই প্রতিবেশীটি অভুক্ত অবস্থায় থাকে।
প্রতিবেশী যে ধর্মের হোন না কেন, উত্তম আচরণ পাওয়া তাঁর অধিকার। বাড়িতে ভালো কোনো খাবার রান্না হলে তাতে প্রতিবেশীকে শরিক করা রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ। তিনি আবু যর (রা.)-কে বলেন, হে আবু যর! যখন কোনো তরকারি রান্না করবে, তখন তাতে একটু বেশি পানি দিয়ে ঝোল বাড়াও, আর তোমার প্রতিবেশীকে পৌঁছে দাও।