ঈদ উল আযহা কেন পালিত হয় মুসলিম বিশ্বে
রুহুল কুদ্দুস টিটো
মুসলমানের জীবনে যেমন প্রচুর ত্যাগ-তিতীক্ষা ও জান-মালের কোরবানী আছে, তেমনি খুশিও আছে। দুঃখ-বেদনার সাথে উৎসবও আছে।
মুসলিম উৎসবে মোহচ্ছন্নতা নাই, আছে পবিত্রতা। মুসলিম বিশ্বের ঘরে ঘরে ঈদ তাই পবিত্র উৎসব বা খুশি বয়ে আনে। এমন খুশির দিন সারা বছরে মাত্র দু’টি। একটি ঈদুল ফিতর, এবং অপরটি ঈদুল আযহা। এ খুশির দিন দু’টিতে প্রতিটি মুসলিম দেশ নতুন ভাবে সাজে। কিন্তু কেন এ খুশি বা উৎসব?
খুশি বা উৎসব তো আসে বিশাল বিজয় বা বড় কিছু অর্জনের পর। কিন্তু কি সে বিজয় বা অর্জন, যার জন্য মুসলমানেরা ঘরে ঘরে ঈদের খুশি করবে? অন্য ধর্ম বা অন্য জাতির উৎসব ইসলামের এ উৎসবের পার্থক্য কোথায়? ঈদের শ্রেষ্ঠত্বই বা কি? কেনই বা দিন দু’টি মানব-সংস্কৃতিতে অনন্য? ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম, কিন্তু এ উৎসবে শান্তি ও কল্যাণই বা কি?
ঈদের উৎসব ও তার দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। তিনি যেমন পবিত্র কোরআন দিয়েছেন এবং নামায-রোযা,হজ-যাকাতের বিধান দিয়েছেন,তেমনি এ উৎসবটিও দিয়েছেন। উৎসবের পরিকল্পনায় ও উদযাপনের যে বিধানটি মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মোমিনদের জন্য।
কুরবানির ঈদ এই উৎসবকে ঈদুজ্জোহাও বলা হয়। ঈদুল আযহা মূলত আরবি বাক্যাংশ। এর অর্থ হলো ‘ত্যাগের উৎসব’। হজ্জ পরবর্তী ঈদ উল আজহার পালিত হয়।
আল্লাহতায়ালার প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই তাঁর অসীম কুদরতের পরিচয়। ধরা পড়ে মানব কল্যাণে মহান আল্লাহর মহা আয়োজন। ঈদ সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব হওয়ার কারণ,এটি কোন মানুষের আবিস্কৃত উৎসব নয়। এটি এসেছে মহান আল্লাহতায়ালা পক্ষ থেকে
হজের শাব্দিক অর্থ: ‘কোনো মহৎ কাজের ইচ্ছা করা’। পরিভাষায় হজ বলা হয়: ‘র্নিদিষ্ট দিনে হজের নিয়তে ইহরাম অবস্থায় আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করা’। (শামী: ২/৪৫৪)
হজের সূচনা: সর্বপ্রথম পৃথিবীতে হজ পালন করেন হজরত আদম আ.।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন- “হজরত আদম আ. যখন পৃথিবীতে অবতরণ করেন তখন তিনি কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করেন। অতঃপর বর্তমানে যেটা মাকামে ইবরাহিম সেখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন এবং কাকুতি-মিনতি করে প্রভূর দরবারে দোয়া করেন।” (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১/১৮৩)
হজরত ইবরাহিম আ. ও তদয় পুত্র হজরত ইসমাঈল আ. কর্তৃক কাবা গৃহ পূণনির্মাণ ও হজের ঘোষণা: হজরত নূহ আ. -এর প্লাবণের পর আল্লাহতায়ালার নির্দেশে হজরত জিবরাঈল আ. -এর মাধ্যমে হজরত ইবরাহিম আ. ও হজরত ইসমাঈল আ. পুনরায় কাবা গৃহ র্নিমাণ করেন। নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে হজের ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা তখন দুনিয়ায় বিদ্যমান এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষের কানে পৌঁছে দেওয়া হয়। আল্লাহতায়ালা কিয়ামত পর্যন্ত যাদের হজ পালন করার সৌভাগ্য লিখে রেখেছেন তারা সবাই সেদিন ইবরাহিম আ.-এর উক্ত অহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলে ছিলেন।
যা কুরাআনে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে: ‘আর আপনি মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা করেন তারা আপনার কাছে অনেক দূর-দূরান্ত এলাকা থেকে পায়ে হেটে ও দূর্বল বাহণের উপর আরোহণ করে আসবে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, সূরা হজ: ২৭)
এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ত্যাগ করা। এ দিনটিতে মুসলমানেরা ফযরের নামাযের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাক্বাত ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করে ও অব্যবহিত পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট আল্লাহর নামে কোরবানি করে।
আল্লাহর আদেশে নিজ পুত্র ইসমাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর জন্য কুরবানি করার হযরত ইব্রাহিম আ. এর ইচ্ছা ও ত্যাগের কথা স্মরণ।
মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামের রাসুল হযরত ইব্রাহীম কে স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দেন:
“ তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর। ”
ইব্রাহীম স্বপ্নে এরূপ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর ইব্রাহীম এবার ১০০টি উট কোরবানি করেন।
এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিসহ আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ সময় শয়তান আল্লাহর আদেশ পালন করা থেকে বিরত করার জন্য ইব্রাহীম ও তার পরিবারকে প্রলুব্ধ করেছিল, এবং ইব্রাহীম শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলেন। শয়তানকে তার প্রত্যাখ্যানের কথা স্মরণে হজ্জের সময় শয়তানের অবস্থানের চিহ্ন স্বরূপ নির্মিত ৩টি স্তম্ভে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করা হয়।
যখন ইব্রাহীম আরাফাত পর্বতের উপর তার পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তার পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তার পুত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। ইব্রাহীম আল্লাহর আদেশ পালন করার দ্বারা কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এটি ছিল ছয় সংখ্যক পরীক্ষা। এতে সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ ইব্রাহীম কে তার খলিল (বন্ধু) হিসাবে গ্রহণ করেন।
কোরআনে ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্রের কুরবানীর ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে,
১০০| হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান কর।
১০১| সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম।
১০২| অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন।
১০৩| যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল।
১০৪| তখন আমি তাকে ডেকে বললামঃ হে ইব্রাহীম,
১০৫| তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
১০৬| নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।
১০৭| আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু।
১০৮| আমি তার জন্যে এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিয়েছি যে,
১০৯| ইব্রাহীমের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক।
১১০| এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।
১১১| সে ছিল আমার বিশ্বাসী বান্দাদের একজন।
—সূরা সাফফাত ৩৭:১০০-১১১
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে
“আর সে বলল (আগুন থেকে তার উদ্ধার হওয়ার পরে): নিশ্চয় আমি আমার রবের কাছে যাচ্ছি। তিনিই আমাকে দিকনির্দেশনা দেবেন। হে আমার রব! আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করুন। সুতরাং আমরা তাকে সহনশীল পুত্রসন্তানের সুসংবাদ দিলাম এবং যখন সে (ছেলেটি) তার সাথে হাঁটার মতো বড় হলো, তখন সে বললো, হে আমার পুত্র! আমি একটা স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি (আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য কুরবানী করছি)। তাহলে তুমি কি মনে কর! সে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা-ই করুন।
ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। তারপর তারা উভয়ে নিজেদেরকে (আল্লাহর ইচ্ছার কাছে) সমর্পণ করল এবং সে তাকে তার কপালের উপর সাজদারত অবস্থায় শুইয়ে দিল (অথবা কাত করে পাশের উপর শুইয়ে দিল)। আমরা তাকে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছো! নিশ্চয় এভাবেই আমরা মুহসিন (সৎকর্মশীল) বান্দাদের পুরস্কৃত করি। নিশ্চয় ওটা ছিল স্পষ্ট পরীক্ষা এবং আমরা তাকে একটা বড় কুরবানী দিয়ে (অর্থাৎ একটা ভেড়া দিয়ে) মুক্ত করেছি এবং এটা আমরা পরবর্তী প্রজন্মগুলোর স্মরণে রেখেছি। ইবরাহীমের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবেই আমরা মুহসিন বান্দাদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় সে আমাদের বিশ্বাসী বান্দাদের একজন ছিল এবং আমরা তাকে ইসহাকের ব্যাপারে সুসংবাদ দিলাম সৎকর্মশীলদের মাঝে থেকে একজন নবী হিসেবে। আমরা তাকে এবং ইসহাককে বরকত দান করলাম এবং তাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মপরায়ণ এবং কতক নিজেদের মধ্যে স্পষ্ট যুলুমকারী। [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৯৯-১১৩]
এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিমরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি উদ্যাপন করে। হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিন ধরে ঈদুল আজহার কুরবানি চলে। হিজরি চান্দ্র বছরের গণনা অনুযায়ী ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার মাঝে ২ মাস ১০ দিন ব্যবধান থাকে। দিনের হিসেবে যা সর্বোচ্চ ৭০ দিন হতে পারে।
ইসলামি চান্দ্র পঞ্জিকায়, ঈদুল আযহা জ্বিলহজ্জের ১০ তারিখে পড়ে। আন্তর্জাতিক (গ্রেগরীয়) পঞ্জিকায় তারিখ প্রতি বছর ভিন্ন হয়, সাধারণত এক বছর থেকে আরেক বছর ১০ বা ১১ দিন করে কমতে থাকে। ঈদের তারিখ স্থানীয়ভাবে জ্বিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে।