একদিনের গল্প // হাবিব আনিসুর রহমান
হাবিব আনিসুর রহমান
সকালে উঠেই আবদুর রহমানকে বাজারে যাওয়ার কথা বললেন তার স্ত্রী রেবেকা সুলতানা- ছেলেটা ইলিশ মাছ খেতে চেয়েছে, কদিন ধরে বলছি কিন্তু কথাটা কানে ঢুকছে না তোমার। কথাটা যে আবদুর রহমানের কানে যায়নি তা নয়। আসল কথাটা হল ইলিশ মাছ কিনতে যাওয়াটাই একটা বিড়ম্বনা। সরকারি স্কুলের শিক্ষক আবদুর রহমান অবসর নেয়ার পর দেখলেন দুনিয়াটা বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ‘আরে মিয়া আপনে তো চাক্কার তলে পড়বেন, দেইখ্যা হাঁটেন’- রিকশাওয়ালা তাকে ঠেলে বাঁদিকে সরিয়ে দিল। পাশ দিয়ে গা ঘেঁষে একটা গাড়িও চলে গেল। তাই তো, এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটলে তিনি তো গাড়ির তলায় পড়ে মারা যাবেন। একেবারে রাস্তার বাঁদিকে সরে গেলেন রহমান সাহেব। তিনি মারা গেলে কার কী হবে? কারও কিছুই হবে না বরং নিকট-ভবিষ্যতের পৃথিবীতে যা কিছু ঘটবে সেসবের অনেক কিছুই দেখা হবে না তার, একটি বড় রকমের আফসোস থেকে যাবে, তার আÍাটা অতৃপ্ত থাকবে। বাজারটা দূরে রিকশায় যাতায়াত করলে তিরিশ+তিরিশ ষাট টাকা খসে যাবে বাজারের হিসাব থেকে, তাই হেঁটেই বাজারে যান তিনি।
মনে মনে বলছেন রেবেকা সুলতানা, প্রতিদিন বাজারে পাঠাও আর বলো চুলোর ধারে আগুনের উত্তাপে রান্না করতে আমার কষ্ট হয়। তোমার ওই চুলোর চেয়েও বাজারের উত্তাপটা অনেক বেশি সেটা তুমি জানতে চাইলে না কখনও!বাজারে ঢোকার আগে পকেট থেকে বের করে ফর্দটা একবার দেখলেন, প্রথমেই লেখা আছে মাঝারি সাইজের একটি ইলিশ (আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকার মধ্যে), তারপর পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আদা, জিরা, আলু… এ রকম হাজারটা জিনিস। ফর্দটা তিনি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় একবার দেখেছেন তবুও বাজারে ঢোকার মুখে আর একবার দেখলেন। তিনি জানেন যতবার ওটা দেখবেন ততবার বুকের ভেতরে বাজপড়ার মতো একটা শব্দ হবে। এই শব্দটা সহ্য করা বড্ড কঠিন! মাসে মাসে পেনশনের যে টাকাটা হাতে পান তার অর্ধেকটাই চলে যায় বাড়িভাড়া দিতে। জিনিসপত্রের দাম এখন সবার আলোচনার বিষয় হলেও দাম কমে না বরঞ্চ প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। একজন শিক্ষকের মানসম্মান আবার কী! তার তো গাড়ি-বাড়ি নেই। রহমান সাহেব স্ত্রীর কাছে কিছুই চান না শুধু একটা বিষয় ছাড়া, সেটা হল একটুখানি সহানুভূতি। কিন্তু সহানুভূতির বিষয়টা উঠে যাচ্ছে দিন দিন। যখন চাকরিতে ছিলেন তখন পুরনো ছাত্ররা মাঝে মাঝে বাড়ি এসে দাওয়াত-টাওয়াত দিত, আজকাল আর কেউ আসে না। শুধু পুরনো স্মৃতিকে পুঁজি করে মানুষ বাঁচতে পারে না। মাঝে মাঝে আবদুর রহমান বিষণœ হয়ে পড়েন। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় জীবনটা এমনই, এভাবেই চলে আসছে আবার চলবে। তার ডানপাশের বিশাল উঁচু ভবনগুলো টপকে সূর্য উঠে আসতে পারছে না। তবে ভীষণ গরম, আজ চৈত্রের বাইশ তারিখ, কদিন পরই বৈশাখ। নতুন বছরের শুরু।বাজারে ঢুকে আবদুর রহমান সব জিনিসের দাম জিজ্ঞাসা করলেন। গত দুদিনের চেয়ে আজ আবার দাম বেড়েছে। কিছু বললেই দোকানদার বলছে হরতাল, মাল আইতে পারে না, সামনে পহেলা বৈশাখ, বুঝেন না, দাম তো বাড়বই। হ্যাঁ, পহেলা বৈশাখ তো তোমাদের মওকা মারার সময়।সামনে মাছের বাজার।
দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা সেখানে উজ্জ্বল আলো জ্বলে মাছের ওপর, যাতে মাছগুলো চকচক করে। আজ শুক্রবার তার ওপর সামনে পহেলা বৈশাখ, কী হয় কে জানে! মাঝারি সাইজের একটি ইলিশের দিকে আঙুল তুলে রহমান সাহেব বললেন ভাই, এটা কত? মাছওয়ালা তার দিকে ফিরেও তাকাল না কারণ বড় সাইজের মাছের হালি জিজ্ঞাসা করেছে অন্য আর এক খদ্দের, তাকে নিয়েই ব্যস্ত মাছওয়ালা। ওরা পোশাক-পরিচ্ছদ আর মুখের ভঙ্গি দেখলেই বুঝতে পারে কোন ক্রেতা কেমন। উপরওয়ালা হয়তো মাছওয়ালাদের বড় মাপের মনোবিজ্ঞানী করে সৃষ্টি করেছেন। এমনকি কার পকেটে কত টাকা আছে তাও হয়তো চেহারা দেখে বলে দিতে পারবে ওরা। তা না হলে রহমান সাহেবের কথায় উত্তর দিচ্ছে না কেন সে?বড় ইলিশের হালি জানতে চাওয়া খদ্দেরের পাশে একটা ছেলে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে কাছে ডেকে খুব যত্নের সঙ্গে চারটা ইলিশ তুলে দিয়ে মাছওয়ালা বলল- স্যার, কম দিয়েন না স্যার। খদ্দের ছয়টা গোলাপি রঙের এক হাজার টাকার নোট দিলে কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম জানাল মাছওয়ালা আবার আইসেন স্যার।লোকটা চলে গেলে রহমান সাহেব একটু ভালোভাবে দাঁড়িয়ে বললেন এটা কত?এইটা সাতশ’।‘এত ছোট মাছ সাতশ’। সাড়ে তিনশ’ হবে, হলে দাও।’ সাড়ে তিনশ’ বলে বুকটা কেমন করে উঠল তার। ফর্দে আছে আড়াইশ’ থেকে তিনশ’র মধ্যে। মাছওয়ালা এমনভাবে রহমান সাহেবের দিকে তাকাল যেন তিনি মস্তবড় অন্যায় করে ফেলেছেন। সে কিছুটা তুচ্ছ করেই বলল- চারশ’-পাঁচশ’ এইখানে নাই, অইন্য দিকে গিয়া দ্যাখেন।মাছের বাজার ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেলন আবদুর রহমান সাহেব। শেষ পর্যন্ত বাজার থেকে বেরিয়ে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে পড়লেন ক্লান্তিটা দূর করতে। দোকানে রঙিন টিভি চলছে, ধুমধাড়াক্কা বোম্বের সিনেমার গান দেখছে আর চা-সিগারেট খাচ্ছে লোকগুলো। রহমান সাহেব এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে ভাবলেন আজ একটা বড় বিড়ম্বনার মধ্যে পড়বেন, হতে পারে সেটা এই বাজারেই অথবা বাসায় স্ত্রীর কাছে। ততক্ষণে চা দোকানের লোকগুলো হরতাল, হেফাজতি, শাহবাগের ব্লগার, নারীনীতি, নাস্তিক-আস্তিক এসব নিয়ে উদ্ভব কথাবার্তা বলে চলেছে। আবদুর রহমান এসব কতাবার্তা শুনে ভীষণ রেগে গেলেন, মনে মনে বললেন কথায় কোনো কাজ হবে না, যত্তসব স্টুপিডের দল। টিভির দিকে তাকালেন, ক্যাটরিনা কাইফ তখন তার উদোম নাভি, উদ্ধতবুক আর কোমর দুলিয়ে চলেছে দ্রুত- দিল খো গ্যায়া হো গ্যায়া… কিসিকা আব রাস্তা মিল গ্যায়া…।বাজার থেকে ফিরে এসে ক্লান্ত আবদুর রহমান যখন বাজারের থলেটা স্ত্রীর হাতে দিলেন তখন রেবেকা সুলতানা তাড়াতাড়ি ভেতর থেকে পলিথিনে মোড়ানো ইলিশ মাছটা বের করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার স্বামীকে বললেন, এটা ইলিশ মাছ! রহমান সাহেব কিছু বললেন না, চুপ করে থাকলেন। হঠাৎ কী হলো, চিৎকার করে উঠলেন রেবেকা সুলতানা তোমাকে বললাম মাঝারি সাইজের ইলিশ আর তুমি আনলে জাটকা বলেই মাছটা ছুড়ে মারলেন স্বামীর দিকে ‘নাও তোমার মাছ তুমি খাও, তুমি রান্না করে খাও।’আবদুর রহমান রেগে যাওয়া স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, এখন তিনি যা কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করেন না কেন সে আরও রেগে গিয়ে যাচ্ছেতাই কিছু একটা করে বসবে, কোনোভাবেই তাকে বোঝানো যাবে না যে, তিনশ’-চারশ’ টাকায় ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না।পাঁচশ’ টাকার ওই ছোট ইলিশটা তিনি অনেক কষ্টে চারশ’ টাকায় এনেছেন। এছাড়া অন্য কিছু সম্ভব ছিল না। মাছটা না কিনেও তিনি খালি হাতে ফিরতে পারতেন না কারণ রেবেকা বলেছে ছেলে ইলিশ খেতে চেয়েছে। অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের জন্য ছেলে খেতে চেয়েছে মানে এটা একটা সেন্টিমেন্টের ব্যাপার। হঠাৎ রহমান সাহেবও রেগে গেলেন যেটা সাধারণত কখনও তিনি করেন না- যেটা আমার সাধ্যের ভেতর ছিল সেটাই করেছি মাছ নিয়ে তোমার যা খুশি তাই করো, আমি চললাম। বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।বাসা থেকে বের হয়ে সোজা বড় রাস্তা ধরে তিনি হনহন করে হাঁটতে লাগলেন উত্তর দিকে।
আধা ঘণ্টা এভাবেই হেঁটে যাওয়ার পর বাঁদিকের রাস্তা ধরলেন। একটু এগিয়ে যেতেই সামনে লেকের পাশে একটা পার্ক দেখে ওখানেই ঢুকে পড়লেন। এখানে পার্ক আছে তিনি জানতেন কিন্তু কখনও আসেননি। জায়গাটা খুব সুন্দর। লেকের পাড়ে ইট বাঁধানো সরু পথ। পশ্চিমে লেকপূর্বদিকে ফুলের বাগান আর মেহগনি, শিশু গাছের সারি। অজস্র ফুল ফুটে আছে বাগানে। ঝিরঝির বাতাসে লেকের পানির ওপর ঝিলমিল ঢেউ। আবদুর রহমান সিমেন্টের বেঞ্চের ওপর বসে লেকের পানি দেখতে লাগলেন অবাক হয়ে, ঠিক তখন মাথার ওপর গাছে একটা পাখি ডেকে উঠল। ইলিশ মাছ নিয়ে ঝগড়া করে পার্কে এলেও এখন মনটা একদম বদলে গেল। ঘড়ি দেখলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন আজ সারাদিন পার্কে কাটাবেন বাসায় ফিরে যাবেন না। ফিরলেও রাতে ফিরবেন। চারপাশে তাকালেন। কোনো ঝুটঝামেলা নেই। ঝালমুড়িওয়ালাকে ডাকলেন। ১০ টাকার ঝালমুড়ি খেলেন খুব তৃপ্তির সঙ্গে, এ পার্কের ঝালমুড়ি এত টেস্টি বাহ। ছোট ছোট ছেলেরা এখানে কফিও বিক্রি করে। একজনকে ডেকে কফি খেলেন। ১৫ টাকার কফি অথচ দারুণ স্বাদ। খুব ভালো লাগল রহমান সাহেবের। জীবন এমন সুন্দর ঝালমুড়ি আর কফির মতো কেটে যেত যদি তাহলে কি মজাই না হতো। মাথার ওপরের বিশাল গাছগুলো তাকে ছায়া দিচ্ছে, সময় খুব দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে, নির্ঝঞ্ঝাট সময় আসলে খুব দ্রুত কেটে যায়। ছুটির দিন।
চারপাশে তরুণ-তরুণীরা গল্পে মশগুল, কোনোদিকে খেয়াল নেই ওদের। মাথার ওপর আবার ডেকে উঠল পাখিটা। পাখিটার দিকে তাকালেন। খুব সুন্দর পাখি। এখন দুপুরের খাবারের প্রয়োজন নেই। লম্বা সময় কাটাবেন এখানে। এসব ভেবে খুব খুশি আবদুর রহমান। মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে ৫৮ বছরের ক্লান্ত জীবনের ভার লাঘব করে দিল এ সুন্দর পাখিটা, ওই সারিসারি ফুলের মেলা, ওই জীবন্ত তরুণ-তরুণীরা আর লেকের স্বচ্ছ পানির ঝিলমিল ঢেউ। বসে বসে এসব দেখার মধ্যে অন্যরকম একটা আনন্দ আছে। কেন যে তিনি এ পার্কে আগে আসেননি। পস্তাতে লাগলেন।তখন বিকাল গড়িয়ে সূর্যটা পশ্চিমের ভবনগুলোর ওপারে চলে যাচ্ছে। একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল রহমান সাহেবের সম্মুখে এক্সকিউজ মি, একটু বসতে পারি? আবদুর রহমান বেঞ্চের একপাশে সরে বসে বললেনÑ সিওর, হোয়াই নট। মেয়েটা তার পাশে বসলে, তিনি সরাসরি মেয়েটার দিকে তাকালেন না। হয়তো ভাববে লোকটা হ্যাংলা। তিনি লম্বা মেহগনি গাছটার ডালে পাখি খুঁজতে লাগলেন। মাঝে মাঝে পরখ করছিলেন, কী হতে পারে মেয়েটা?
পায়ে সুন্দর জুতা, পরনে ম্যাচ করে চমৎকার সালোয়ার-কামিজ-ওড়না পরেছে, কাঁধে ঝুলছে ভারী ব্যাগ, সুগন্ধি মেখেছে শরীরে। সব মিলিয়ে ভীষণ স্মার্ট লাগছে তাকে। হঠাৎ মেয়েটা কথা বলে উঠল,‘আপনি প্রতিদিন এখানে আসেন?’‘না, আজই প্রথম এলাম।’‘হঠাৎ চলে আসলেন আজ?’‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’‘কি আশ্চর্য ব্যাপার! যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি অবসর নিয়েছেন?’‘হ্যাঁ, তাহলে তো আমার জন্য খুব ভালো হল, আগে কি করতেন প্লিজ…।’‘শিক্ষকতা করতাম। আপনি কি আমাকে ইন্টারভিউ করছেন।’‘দেখুন আমি একটা এনজিওতে কাজ করি- আমার কাজ হল যেসব মানুষ রিটায়ার্ড করেছেন তারা অবসর সময়টা কি করে কাটাচ্ছেন সে সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করা, আপনি কি অনুগ্রহ করে একটু সাহায্য করবেন আমাকে?’‘অবশ্যই করব, একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ।’বাসা থেকে বের হয়ে রহমান সাহেব রাগ করে মোবাইল ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিলেন।
দেখলেন তার স্ত্রী আঠারোবার কল করেছেন, না পেয়ে মেসেজ করেছেনÑ তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো প্লিজ। রান্না শেষ, আমার খুব খারাপ লাগছে। মেসেজটা পড়ে ফোনটা পকেটে রাখলেন আবদুর রহমান। মেয়েটা বলল,‘স্যার, এদিকটায় কোলাহল বেশি, যদি একটু ওদিকে যেতেন তাহলে আমার জন্য খুব ভালো হতো প্লিজ।’‘ঠিক আছে চলুন, তবে তাড়াতাড়ি করবেন আমাকে আবার বাসায় ফিরে যেতে হবে।’‘অবশ্যই।’ মেয়েটা পার্কের এক কোণায় নিয়ে গেল, রহমান সাহেবকে একটা সিমেন্টের বেঞ্চে বসতে বলল যার চারপাশে গাছ দিয়ে ঘেরা। বেঞ্চে বসে রহমান সাহেব বললেন,‘বলুন, কি জানতে চান?’‘আচ্ছা আজ যে আপনি হঠাৎ পার্কে আসলেন এর পেছনে কী কারণ আছে বলবেন দয়া করে।’‘না, ওটা তো পারিবারিক বিষয়, ওটা বলা ঠিক হবে না।’দেখুন পারিবারিক ঠিক আছে, কিন্তু ধরনটি কেমন সেটা যদি একটু বলেন তাহলে আমার সুবিধা হয়।’ মেয়েটা একটা ডাইরি আর কলম বের করল।‘ওই পরিবারে যা হয়, ছোটখাটো তুচ্ছ ঘটনা, নিয়ে মান-অভিমান। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।’‘ঠিক আছে স্যার, আপনাকে অন্য ধরনের কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই, করব…?’‘অন্য ধরন মানে?’‘আপনাকে দেখে মনেই হয় না আপনি অবসরে গেছেন, কোনো একসময় আপনার চেহারা অসম্ভব সুন্দর ছিল তাই না? এখন মনে হয় আপনি পঁয়তাল্লিশ পার করেননি…।’‘না, এটা ঠিক না। তবে আমার বন্ধুদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে আমাকে কিছুটা কম বয়েসী মনে হয় এই আর কি।’‘এখানে আপনি অসম্ভব সুন্দর, এই কথাগুলো কখনও কি কেউ বলেছে আপনাকে?’একটু হাসলেন আবদুর রহমান সাহেব। বহুদিন পর তিনি গর্বভরে বলে উঠলেন,‘জানেন অনার্স পড়ার সময় গল্প-কবিতা এসব লিখতাম। বন্ধুরা বলত খুব ভালো হয়েছে। এমএ পাড়ার সময় কয়েকটা গল্প বের হয়েছিল একটা ভালো দৈনিকের সাহিত্য পাতায়। কী যে আনন্দ হয়েছিল সেসব দিনগুলোতে বলে বোঝাতে পারব না! আশ্চর্য সেসব দিন। আর…।’‘আর?’‘আর গানও গাইতে পারতাম, কোনো তালিম ছাড়াই শুধু রেডিওতে শুনে, সিনেমা দেখে, মেহেদী হাসানের গজল গাইতে পারতাম।
আসলে সত্যি বলতে কি জীবনে অনেক কিছুই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি।’‘হয়নি বলছেন কেন? আপনার জীবন তো ফুরিয়ে যায়নি স্যার? শিল্পের কোনো বয়স থাকে না। আপনি আবার গাইবেন আবার লিখবেন তাই না, শুধু শুরু করাট যা একটু কঠিন, তবে আপনার হবেই।’‘সত্যি বলছেন?’কথাটা বলে সূর্য ডুবে যাওয়ার আগ মুহূর্তের আকাশের দিকে তাকালেন রহমান সাহেব। প্রবাল রঙের আকাশ তার সামনে। লেকের কালো পানির ওপর বাতাসের ঝিরঝির কম্পন নেই এখানকার সবকিছু কেমন শান্ত। শুধু দূরের রাস্তায় গাড়িগুলো ছুটে চলেছে। আগত সন্ধ্যায় আবদুর রহমান সাহেব কিছুটা আÍনিমগ্ন হলেন। মেয়েটা রহমান সাহেবের কাছে সরে বসল একটু গা ঘেঁষে। আচমকা মেয়েটি রহমান সাহেবকে জড়িয়ে ধরে একজনকে বলল- কেমন লাগছে দেখুন তো? চকিতে দু’জন যুবক রহমান সাহেবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল- ‘শালা সন্ধ্যাবেলা খারাপ মেয়েছেলে নিয়ে পার্কে লুচ্চামি করা হচ্ছে।’‘এসব কী বলছ তোমরা, আমাকে চেন?’একজন রহমান সাহেবের সার্টের কলার চেপে ধরে বলল- চুপ একদম চুপ। তার অন্য হাতে ধারালো ছুরি। অন্য যুবক রহমান সাহেবের হাতের ঘড়ি, পকেটের মোবাইল, টাকা, সবকিছু কেড়ে নিল। দ্রুত ওরা পার্ক থেকে বেরিয়ে গেল। আবদুর রহমান পেছন পেছন ‘ছিনতাইকারী’ ‘ছিনতাইকারী’ বলতে বলতে ছুটে গেলেন। ততক্ষণে ওরা একটা মোটরসাইকেলে চেপে দ্রুত চলে গেল। সামনে দু’জন পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। রহমান সাহেব ওদের কাছে গিয়ে দ্রুত সবকিছু বলে আঙুল তুলে দেখালেন ওই যে, ওই যে ওই মোটসাইকেলের ছেলেমেয়েগুলো হ্যাঁ ওরাই ছিনতাইকারী ধরুন, আমার সবকিছু নিয়ে পালিয়ে গেছে। রহমান সাহেবের চারপাশে তখন কিছু মানুষের ভিড়। সবাই বলছে পুলিশ কি করবে, ওরা তো এখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।আবদুর রহমান সাহেব অবাক! এক মুহূর্তে ওরা তিনজন কীভাবে তাকে অপদস্ত করে মোবাইল ফোন আর ঘড়িটা নিয়ে চলে গেল! রেবেকার ছোটভাই আবুধাবি থাকে, গতকাল এসে ওই ফোন আর ঘড়িটা তাকে উপহার দিয়েছিল, দুটোই খুব দামি জিনিস। রহমান সাহেব রাগ করে এ পার্কে এসে বসেছিলেন, তার ৫৮ বছরের জীবনে এমন সুন্দর মুহূর্ত এর আগে কখনও আসেনি। কিন্তু মেয়েটা আর ছেলে দুটি তাকে এভাবে অপমান-অপদস্ত করে সবকিছু নিয়ে গেল!আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাকে দেখছিল বোকার মতো। রহমান সাহেবের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল সত্যি! কিন্তু এটাও সত্যি যে, মেয়েটা তার মধ্যে এক অসীম সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল যা এর আগে কেউ কখনও করেনি!