কাঠমিস্ত্রি আজ জ্ঞান প্রদীপের মিস্ত্রি
আলাপচারিতা
পেশায় কাঠমিস্ত্রী, পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ৫নং শিমুলিয়া ইউনিয়নের পাইকপাড়া মির্জাপুর গ্রামে তার বাড়ি।
স্ত্রী, পাঁচ বছরের এক মেয়ে, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এক ভাই ও মা সহ পাঁচ জনের পরিবারে তিনি একাই উপার্জন করেন। বলার মতো নিজের অর্থ-সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই, আছে একটা প্রশস্ত আলোকিত মন।
যে মন মানুষকে আলোকিত করার স্বপ্ন দেখে। আর এ স্বপ্ন থেকেই গড়ে তুলেছেন “খোকসা কমিউনিটি লাইব্রেরি” নামে একটি গ্রন্থাগার। সাথে নিজেও নিয়েছেন লাইব্রেরিয়ান পদবী।নিজের ঘরের আঙিনায় ২০১৬ সালের দিকে গড়ে তুলেছেন ছোট্ট একটি সংগ্রহশালা। যার নাম কমিউনিটি লাইব্রেরি। এখানে গল্প-উপন্যাসসহ প্রায় হাজারখানেক বই রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অবসর সময়ে এ লাইব্রেরিতে ছুটে আসেন বয়স্ক মানুষও। কাঠমিস্ত্রির ছোট্ট এ লাইব্রেরি এখন পরিণত হয়েছে পরিপূর্ণ জ্ঞান পিপাসুদের আড্ডাখানায়। এতেই তৃপ্ত জসিম উদ্দিন।
দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন নিরুদ্দেশ হয়ে যান বাবা। এরপর অভাবের কারণে আর লেখাপড়া করতে পারেননি। নিজে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে না পারলেও যেকোনো বইয়ের প্রতি রয়েছে আলাদা টান। আর সেই টান থেকেই বইপ্রেমীদের জন্য গড়ে তুলেছেন লাইব্রেরি।
নিজের ঘরের আঙিনায় ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর গড়ে তুলেছেন ছোট্ট এ সংগ্রহশালাটি। কাঠমিস্ত্রির কাজ করে যা টাকা পান তার একটি অংশ বইপ্রেমীদের জন্য বরাদ্দ রাখেন। নিজে সারাদিন কারখানায় কাজ করে বিকেলে বসেন এ লাইব্রেরিতে। মেঝে পাকা, চার চালা টিনশেডের এই ঘর এখন তাঁর আদর্শ।
ঘরের ভিতর ছোট ছোট র্যাক। তাতে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, শিশুতোষ বই, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সফল মানুষের জীবনী, ধর্মীয় বই। রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস সহ হরেক রকমের বইও। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অবসর সময়ে এই লাইব্রেরিতে ছুটে আসেন বয়স্ক মানুষও।
জসিম উদ্দিনের ছোট্ট এই লাইব্রেরি এখন পরিণত হয়েছে জ্ঞানপিপাসুদের আড্ডাখানায়। অনেকে পাঠাগারে এসে বই পড়েন। নিজের অনেক স্বপ্ন ছিল ছোটবেলায়।
পড়ালেখা করবেন, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবেন। তার স্বপ্নগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি। অন্যের মাধ্যমে নিজের স্বপ্ন বাস্তবে রুপ দান করতে তিনি বদ্ধপরিকর।
জসিম সারাদিন কারখানায় কাজে ব্যস্ত থাকেন। তবে বিকেলে বাড়ি ফিরে নিজের লাইব্রেরিতে বসেন। সে সময় বিভিন্ন বয়সী মানুষ সেখানে বই পড়তে আসেন। এছাড়া দিনের বেলায় অনেকেই বই নিতে আসেন। সে সময়টুকু সামলান জসিমের স্ত্রী পপি খাতুন।
বইপ্রেমি এই মানুষটি তা বলেছেন, “আমার বয়স যখন ১০ বছর। তখন আমার বাবা নিরুদ্দেশ হন। সেই সময়ে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় আমাকে। পাশের বাড়ির এক কাঠমিস্ত্রির সাহায্যকারী হিসেবে কাজ শুরু করি। সেখান থেকে যা পেতাম তা দিয়েই সংসার চলতো।
মাঝে মাঝে বই সংগ্রহ করে পড়তাম, অন্যকে পড়তে দিতাম। ধীরে ধীরে এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। এক সময় একটা লাইব্রেরি গড়ার সিদ্ধান্ত নেই। শুরুতে আমার আগের পড়া কিছু বই আরও কিছু কিনে প্রায় ১০০-র মতো বই নিয়ে লাইব্রেরি শুরু করি। বর্তমানে আমার সংগ্রহে দুই হাজারের অধিক বই রয়েছে।”
জসিম উদ্দীনের ভাষ্য, “আজকালের মানুষগুলো শুধু সার্টিফিকেটের জন্য বই পড়ে, কী হবে এসএসসি, এইচএসসি পাশ করে, যদি সঠিক জ্ঞানই না থাকলো? তাই আমি উদ্যোগ নিয়েছি কাঠামোর বাইরের জ্ঞানে মানুষকে জ্ঞানি করে তোলার। ”
দেশে অনেক সামর্থবান, বিত্তশালী, বড় বড় গবেষক, শিক্ষাবিদ আছেন কিন্তু কেউ এমনভাবে শিক্ষা জীবন থেকে অঙ্কুরেই ঝরে যাওয়া কাঠমিস্ত্রি জসিম উদ্দিনের মতে করে ভাবেননি।
মানুষকে বই পড়াবেন এমন চিন্তা ছোটবেলা থেকেই বাসা বেঁধেছিল। সেই স্বপ্নপূরণ হয়েছে। তার বিশ্বাস, গ্রামের কম শিক্ষিত মানুষগুলো বই পড়ার মাধ্যমে অন্য এক উচ্চতায় যেতে পারবেন। জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি এখন বইয়ের ভিক্ষুক, মানুষ যেন আমাকে বই ভিক্ষা দেন।’