কীভাবে আগুন দেয়া হলো বেনাপোল এক্সপ্রেসে
আগুন দিয়ে বেনাপোল এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি পুড়িয়ে দেওয়া এবং অন্তত চারজনের প্রাণহানির ঘটনা পুরোটাই পরিকল্পিত বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যুবদলের এক নেতা। তিনি জানিয়েছেন, বিএনপি নেতাদের উপস্থিতিতে ভার্চুয়াল একটি বৈঠকের মাধ্যমে ট্রেনে নাশকতার ওই ঘটনার পরিকল্পনা করা হয়।
শনিবার ভোররাতে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য কাজী মোহাম্মদ মনসুর আলমকে। এরপর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে একটি স্বীকারোক্তি দেন।
সেখানেই উঠে এসেছে নাশকতার পরিকল্পনা বিস্তারিত। মনসুরের স্বীকারোক্তির ওই ভিডিও পেয়েছে একাত্তর।
গোয়েন্দা পুলিশকে তিনি জানান, বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়ার আগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হক এনামের সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি একটি বৈঠক হয়।
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ১৭ মিনিটের ওই বৈঠক হয় শুক্রবার বিকেল ছয়টা ২ মিনিটে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় ট্রেনে আগুন দেওয়ার। সিদ্ধান্ত হওয়ার পর নাশকতার দায়িত্ব দেওয়া হয় একজনকে। এরপর রাত ৯টা ৫ মিনিটে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেয়া হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেন, ‘আমরা ভার্চুয়ালি মিটিং করি। মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক, সদস্য সচিবসহ আমাদের যতগুলো টিম আছে তাদের টিম লিডাররা মিটিংয়ে অংশ নেন। সেখানে দুটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, একটি থানা ভিত্তিক, আরেকটি ট্রেনের ব্যাপার নিয়ে।’
এসময় কোরআন শরীফে হাত দিয়ে মনসুর তার বাচ্চার কসম কেটে বলেন, ‘আমি সব সত্যি বলছি। আমি কাউকে ফাঁসাইতে চাই না কিংবা মিথ্যা কথা বলছি না।
‘থানা আর ওয়ার্ডভিত্তিক টিমগুলোকে ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আরেকটি সিদ্ধান্ত হলো, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভীতি সৃষ্টি করার জন্য, যাতে ভোটাররা না আসে।’
মনসুর বলেন, ট্রেনের বিষয়ে একটা কাজ ছিল, সেটা কে করতে পারবে তা জিজ্ঞেস করেছিল আমাদের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়ন। মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হক এনাম। তখন নির্দেশনা ছিলো, কথা অল্পের মধ্যে শেষ করে দেওয়ার জন্য।
‘সদস্য সচিব জানতে চাইল, ট্রেনে কে কাজ করতে পারবে? কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী ট্রেনকে নরসিংদী কিংবা গাজীপুরের কোথাও ঢাকায় ঢোকার আগে, আর তা না হলে নারায়ণগঞ্জের রুটে আপ অ্যান্ড ডাউন যেকোনো জায়গায়। মিটিংয়ে অনেকেই ইচ্ছা প্রকাশ করলে সদস্য সচিব নির্দিষ্ট করে দেন কে কাজটি করবে।’
ওই বৈঠকের মনসুরকে ট্রেনে নাশকতার দায়িত্ব দেয়া হয় বলে জানান তিনি। মনসুর বলেন, তখন সদস্য সচিব বলছে, আপনি কাজটা করবেন। আমি আপনার সঙ্গে সোর্স দিয়ে দেবো। এই বিষয়ে পরে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলবো।
‘এর মধ্যে সবাই গ্রুপ কল থেকে বেরিয়ে গেছে, তারা নিজেরা পার্সোনালি কথা বলছে,’ বলেন মনসুর।
পুলিশের লালবাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, বৈঠকের ধারাবাহিকতায় যুবদল দক্ষিণের আহ্বায়ক খন্দকার এনাম এবং সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন দেয়া হয়।
‘যুবদল দক্ষিণের দুই জন টিম লিডার, রবিউল ইসলাম নয়নের বিশ্বস্ত লালবাগের তিনজন দাগি বোমা সন্ত্রাসীসহ আরো কয়েকজন বোমা ও অগ্নি সন্ত্রাসীকে দিয়ে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে,’ বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
ট্রেনে নাশকতার পর রাতভর অভিযান চালিয়ে শনিবার ভোর সাড়ে তিনটার দিকে চকবাজার থানার বেরিবাদ চেয়ারম্যান ঘাট এলাকায় থেকে মনসুর আলমকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশের একটি দল।
মনসুরের নামে আগে থেকেই মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে নগদ ৩০ হাজার টাকা, একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও একটি বাটন মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে।
বেনাপোল এক্সপ্রেসে ভয়াবহ নাশকতার পর কেরানীগঞ্জ দিয়ে পালানোর চেষ্টার সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে ডিবি পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, মনসুর আলমের গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগন ভুঁইয়ায়। স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে জীবিকার অন্বেষণে চাকরি নেন ফকিরাপুলের একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে।
বিএনপির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বিএনপির মিছিল মিটিং ও আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন মনসুর। ২০২১ সালের যুবদল দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটিতে মনসুর আলম অন্যতম সদস্য মনোনীত হন। ওই কমিটির আহ্বায়ক গোলাম মাওলা শাহীন এবং সদস্য সচিব খন্দকার এনামুল হক।
ডিবি পুলিশ থেকে জানানো হয়, ২০২৩ সালের ২৮ শে অক্টোবরের পর থেকে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে নাশকতার পর বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে পলাতক হন, তখন মনসুর আলমকে যুগ্ম আহ্বায়কের মর্যাদায় মহানগর দক্ষিণের লালবাগ, চকবাজার এবং বংশাল এলাকায় ধ্বংসাত্মক কাজের সমন্বয়ক নির্বাচিত করা হয়।
মনসুর আলম তখন থেকে এই তিন থানার ওয়ার্ড পর্যায়ে যুবদলকে সংঘটিত, উদ্দীপিত ও তাদের কার্যকলাপ মনিটরিং করে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণের ছবি/ভিডিও উপরের নেতাদের পাঠাতেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। আর এর বিনিময়ে তাকে মোটা অঙ্কের অর্থও দেয়া হতো।
সংবাদ সূত্র: ‘৭১ টিভি