কুষ্টিয়া জেলা
কুষ্টিয়া জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। কুষ্টিয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পৌরসভা, যার আয়তন ৬৬.০০ বর্গকিলোমিটার। কুষ্টিয়া মহানগর ১২০.২৩ বর্গকিমি (৪৬.৪২ বর্গমাইল) যা কুষ্টিয়াকে বাংলাদেশের এগারো-তম বৃহত্তম ও খুলনা বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মর্যাদা দিয়েছে।
কুষ্টিয়া (মুজিবনগর) বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী। ১৮৬৯ সালে কুষ্টিয়ায় একটি পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। হ্যামিলটন’স গেজেট প্রথম কুষ্টিয়া শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। লালনের মাজার ছাড়াও এ জেলার শিলাইদহে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি ও মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা। এ জেলাতে রয়েছে ইসলাম বিষয়ক বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। কুষ্টিয়া জেলাকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পকলা একাডেমি কুষ্টিয়াতে অবস্থিত। শিল্প প্রতিষ্ঠানের দিক দিয়ে এ-জেলা দেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঘড়ির কাঁটার ক্রম অনুযায়ী: কুষ্টিয়া শহরের দিগন্তরেখা, পরিমল টাওয়ার, রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, লাভলি টাওয়ার, লালন শাহের মাজার
কুষ্টিয়ার নামকরণ
কুষ্টিয়ার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনী। কুষ্টিয়ায় একসময় কোষ্টার (পাট) চাষ হত বলে কোষ্টা শব্দ থেকে কুষ্টিয়া নামকরণ হয়েছে। হেমিলটনের গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে যে স্থানীয় জনগণ একে কুষ্টি বলে ডাকত বলে এর নাম হয়েছে কুষ্টিয়া। অনেকের মতে ফরাসি শব্দ’’ কুশতহ’’ যার অর্থ ছাই দ্বীপ থেকে কুষ্টিয়ার নামকরণ হয়েছে। সম্রাট শাহজাহানের সময় কুষ্টি বন্দরকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের উৎপত্তি ঘটেছে।
কুষ্টিয়া শহর ছাড়াও এ জেলায় কুমারখালি ও ভেড়ামারা পৌরসভায় বিসিক শিল্প গড়ে ওঠেছে৷ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবস্থিত। কুষ্টিয়া শহর হলো এ জেলার প্রশাসনিক সদর এবং প্রধান শহর। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা এ জেলা থেকেই। নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রথম জীবন ও কবিতার স্বর্নযুগ কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কাটিয়েছিলেন। এ জেলার মানুষের কথ্য ভাষাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে শুদ্ধ ভাষা অর্থাৎ বাংলাদেশে বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রমিত রূপ বলা হয়ে থাকে।
১৮৬৯ সালে কুষ্টিয়ায় একটি পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। হ্যামিলটন’স গেজেট প্রথম কুষ্টিয়া শহরের কথা উল্লেখ করে। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে এখানে একটি নদীবন্দর স্থাপিত হয়। যদিও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ বন্দর বেশি ব্যবহার করত, তবুও নীলচাষী ও নীলকরদের আগমনের পরেই নগরায়ন শুরু হয়।
১৮৬০ সালে কলকাতার (তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজধানী)সাথে সরাসরি রেললাইন স্থাপিত হয়। একারণে এ অঞ্চল শিল্প-কারখানার জন্য আদর্শ স্থান বলে তখন বিবেচিত হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস(১৮৯৬), রেণউইক, যজ্ঞেশ্বর এণ্ড কোং (১৯০৪) এবং মোহিনী মিলস (১৯১৯) প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৭২৫ সালে কুষ্টিয়া নাটোর জমিদারীর অধীনে ছিল এবং এর পরিচিতি আসে কান্ডানগর পরগণার রাজশাহী ফৌজদারীর সিভিল প্রশাসনের অমর্ত্মভূক্তিতে। পরে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৭৬ সালে কুষ্টিয়াকে যশোর জেলার অমত্মর্ভূক্ত করে। কিন্তু ১৮২৮ সালে এটি পাবনা জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৮৬১ সালে নীল বিদ্রোহের কারণে কুষ্টিয়া মহকুমা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৮৭১ সালে কুমারখালী ও খোকসা থানা নিয়ে কুষ্টিয়া মহকুমা নদীয়ার অর্ন্তগত হয়। ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির পূর্বে কুষ্টিয়া নদীয়া জেলার আওতায় একটি মহকুমা ছিল। ১৯৪৭ সালে কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয় ঘটে। তখন কুষ্টিয়া জেলা ৩ টি মহকুমা নিয়ে গঠিত ছিল। এগুলো কুষ্টিয়া , চুয়াডাঙ্গা এবং মেহেরপুর। এরপর ১৯৮৪ সালে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর আলাদা জেলা হিসেবে পৃথক হয়ে গেলে কুষ্টিয়া মহকুমার ৬ টি থানা নিয়ে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা গঠিত হয়।
শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিত পশ্চিম বাঙলার সমৃদ্ধ কুষ্টিয়া জেলাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সূর্যোদয়ের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত এই কুষ্টিয়া শিল্প ও সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশকে করেছে সমৃদ্ধ। এছাড়াও বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন এবং বাউল সম্রাট লালনের তীর্থভূমি, পুরাতন কুষ্টিয়া হাটশ হরিপুর গ্রামে গীতিকার, সুরকার ও কবি আজিজুর রহমানের বাস্তুভিটা ও কবর, এ জনপদে জন্মগ্রহণকারী বিশিষ্ট কবি দাদ আলী, লেখিকা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, ‘‘এই পদ্মা এই মেঘনা’’ গানের রচয়িতা আবু জাফর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, কুষ্টিয়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাতা কাঙাল হরিণাথ, নীল বিদ্রোহের নেত্রী প্যারী সুন্দরী, স্বদেশী আন্দোলনের নেতা বাঘা যতিন, প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী, সঙ্গীত শিল্পী মোঃ আব্দুল জববার, ফরিদা পারভীন সহ অসংখ্য গুণীজনের পীঠস্থান কুষ্টিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ হয় কুষ্টিয়ায়
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ হয় কুষ্টিয়ায়। এই প্রতিরোধযুদ্ধে পাকিস্তানীদের প্রথম পরাজয়ের দৃষ্টান্তও কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়া বাংলাদেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো শত্রু মুক্ত হয় ১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। ৩০ মার্চ এর এই যুদ্ধে প্রথমবারের মতো পাকহানাদাররা ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ এর নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের পর মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রহরেই কুষ্টিয়ায় তারা প্রথমবারের মতো পরাজিত হয়। অফিসারসহ শতাধিক পাকসেনা প্রাণ হারায়। এই সংবাদ বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন, ফরাসী টেলিভিশন সহ বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় প্র্রচারিত হলে তাদের সম্মান লুণ্ঠিত হয় অপরদিকে বিশ্বব্যাপী বাঙালির মুক্তির পক্ষে জোরালো সমর্থন আসতে থাকে।
৩ মার্চ থেকে চলতে থাকে সারাদেশে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পতাকা উত্তোলন তারই ধারাবহিতকতায় কুষ্টিয়া ইসলামীয়া কলেজের মাঠে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় লাল সবুজের ছয়টি তারা খচিত একটি পতাকা স্বাধীন বাংলার পতাকা হিসাবে উড়িয়ে দেন কুষ্টিয়া জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ও জেলা ছাত্রলগের সভাপতি আব্দুল জলিল। স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করেন কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হাদী। মারফত আলী, আব্দুল মোমেন, শাসসুল হাদীর নেতৃত্বে গঠিত হয় জয় বাংলা বাহিনী। ২৩ মার্চ কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য গোলাম কিবরিযা (এমপিএ) ও আব্দুর রউফ চৌধুরী এবং তারা জয় বাংলা বাহিনীর অভিবাবদন গ্রহণ করেন। যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে। কুষ্টিয়ার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে জয় বাংলা বাহিনী গঠিত হয়।
২৫ মার্চ ১৯৭১ রাত পৌনে বারোটায় মেজর শোয়েবের নেতৃত্বে এবং ক্যাপ্টেন শাকিল, ক্যাপ্টেন সামাদ ও লেঃ আতাউল্লাহ শাহ এর উপঅধিনায়কত্বে ২৭ বেলুচ রেজিমেন্ট এর ডি-কোম্পানীর ২১৬ জন সৈন্য কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন আক্রমণ করে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্র করে। ডিউটিরত পুলিশরা আগে থেকেই আঁচ করতে পারে এবং তারা অস্ত্র নিয়ে নদী সাঁতরে পার হয়ে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানী সৈন্যরাহিনী পুলিশ লাইন, জিলা স্কুল, টেলিগ্রাফ অফিস, থানা ও আড়ুয়াপাড়া অফিস দখল করে তাদের ঘাটি গড়ে তোলে। ২৬ মার্চ সমস্ত শহরে ২৪ ঘন্টার জন্য কারফিউ জারী করে পাক সেনারা শহরময় টহল দিতে থাকে।টহলের মধ্যেই কুষ্টিয়ার ছাত্র, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ যেনো আগে থেকেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল।
২৭ মার্চ কুষ্টিয়া নবাব সিরাজউদদৌলা রোডে মিউনিসিপিউলিটি মার্কেটের সামনে বিকেলে ভাষা সৈনিক নাজিম উদ্দিন আহমেদের শ্যালক কুষ্টিয়া কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রনি রহমান হাতবোমা নিক্ষেপ করে। পরে সেনাবাহিনীর গুলিতে তিনি শহীদ হন। রনি রহমানই মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ।
রনি রহমানের শহীদানের মধ্য দিয়ে কুষ্টিয়ার মানুষ প্রতিশোধ নিতে ২৯ মার্চ কুষ্টিয়া জেলা স্কুল, পুলিশ লাইনন্স ও টেলিগ্রাফস্থ পাক হানাদার ক্যাম্প আক্রমনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ৩০ মার্চ ভোর চারটায় আক্রমণ করে। মেজর ওসমান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীন আনুমানিক ৭০০ বাঙালি ইপিআর সৈন্য ছিল। সহস্রাধিক আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ তার বাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিল। যোগাযোগ রক্ষা র জন্য পোড়াদহের খেলার মাঠে একটি একচেঞ্জ এর মাধ্যমে কুষ্টিয়া যুদ্ধ ক্ষেত্র ও চুয়াডাঙ্গা সদর দপ্তরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়। এমপিএ ডা: আসহাব-উল –হক ফিল্ড চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন ও প্রযোজনীয় ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করলেন।
তৎকালীন এমএনএ আজিজুর রহমান আক্কাস, বারিস্টার আল ইসলাম,ব্যারিস্টার বাদল রশিদ, সহিউদ্দিন আহমেদ, সেসময়ের এমপিএ আব্দুর রউফ চৌধুরি, গোলাম কিবরিয়া, ইউনসি আলী, নুরুল হক, জহিরুল হক রাজা মিয়া, আহসানউল্লাহ এবং খন্দকার শামসুল আলম দুদু, নূর আলম জিকু, রশিদুজ্জামান দুদু, এম এ বারী, অধ্যাপক নুরুজ্জামান, আনোয়ার আলী, আব্দুল মোমেন, শামসুল হাদী কুষ্টিয়া পাক আর্মির অবস্থান, সৈন্য সংখ্যা, অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে সম্ভাব্য আক্রমণের একটি নকসা তৈরী করে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, দৌলতপুর ইপিআরদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। আব্দুর রউফ চৌধুরীর নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মাঙ্গন মিয়া সহ আরো কয়েক জন সেনা সংগ্রহের দায়িত্বে থাকেন। কুষ্টিয়ার নেতৃবৃন্দরা নকসার উপর ভিত্তি করে ২৮ মার্চ রাতে চুয়াডাঙ্গার ইপিআর সেক্টর কামন্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীর সঙ্গে কুষ্টিয়া আক্রমনের পরিকল্পনা করে।কুষ্টিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি কোম্পানী ঝিনাইদহ এসে পৌছায় এবং যশোর-ঝিনাইদহ সড়ক অবরোধ করে।যশোর সেনানিবার থেকে পাকবাহিনী আসতে চাইলে তা প্রতিহত করাই ছিল এই অবরোধের উদ্দেশ্য।
২৯ মার্চ ভোর চারটায় আক্রমণ করার কথা ছিল কিন্তু গাড়ি দুর্টনার জন্য সুবেদার মোজাফফর ক্ম্পোানী যথাসমেয় এসে পৌছেতে পারেনি, তারপর ৩০ মার্চ ভোর চারটায় তিনদিক থেকে পাকঘাটিগুলো সংযুক্তভাবে আক্রমণ করা হয়। কুষ্টিয়া জিলা স্কুল, পুলিশ লাইন , আড়ুয়াপাড়াস্থ অয়ারলেস স্টেশন এই তিনটি ছিল পাকিস্তানীদের প্রধান ক্যাম্প—এছাড়াও ছিল থানা ও টেলিফোন একচেঞ্জ। তিনদিক থেকে একই সময়ে যুগপৎ তিনটি পাকঘাটির ওপর প্রবলভাবে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীকে জিলা স্কুলে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ করতে আদেশ দেয়া হয়এবং তিনি ডিসি(ফুড) সাহেবের বাড়িতে বসে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামানকে (শহীদ) আড়ুযাপাড়াস্থ ওয়ারলেস স্টেশন আক্রমণ করতে আদেশ দেয়া হয়। ইপিআর বাহিনীর সাথে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থান নেয় নূর আলম জিকু, আবুল কাশেম ও এ্যাডভোকেট আব্দুল বারী, ছাত্র, জনতা, ইপিআর, পুলিশ, আনসারহ জয় বাংলা বাহিনী। সুবেদার মোজাফফরকে পুলিশ লাইন আক্রমণের আদেশ দেয়া হয়—এই গ্রুপে মুক্তিবাহিনীসহ ছাত্র জনতা পুলিশ লাইন সংলগ্ন জজ সাহেবের বাড়ি ও আশে পাশে অবস্থান নেয়। কুষ্টিয়া থানা ও টেলিফোন একচেঞ্জ আক্রমনের জন্য ট্রাাফিক মোড়ে রউফ চৌধুরীর বাড়ি হতে হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণের জন্য জাহেদ রুমি, শামসুল হুদা সহ ছাত্র ইউনিয়নের নতা, কর্মী ও ছাত্রলীগের ছেলেরা এবং ২৫ মার্চ হরিপুরে আশ্রয় নেয়া পুলিশ সদস্যগণ অবস্থান নেন।
৩০ মার্চ ভোর চারটায় পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ভোড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কুষ্টিয়া শহরকে বিচ্ছিন্ন কারর পর একটি অপেনিং ফায়ারের সঙ্গে সঙ্গে কুষ্টিয়ার চারদিক থেকে পাক সেনাদের উপর আক্রমণ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সামান্য রাইফেল কয়েকটি এলএমজি আর অফুরন্ত মনোবল,অদম্য সাহস ও দেশপ্রেশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঝাপিয়ে পড়েন। ৩০ মার্চ ভোর চারটায় প্রথম সুবেদার মোজাফফরের অধীনস্থ কোম্পানী পুলিল লাইনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটি বাড়ির তিনতলা থেকে আগত এক কোম্পানী আনসার ও এক কোম্পানী মুজাহিদ এ্ই যুদ্ধে যোগ দেয়। হাজার হাজার মানুষ আক্রমণের সাথে সাথে মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিতে থাকেসারাদিন যুদ্ধের পর বিকাল ৫টায় কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। ভোর থেকে শুরু হয়ে বিকাল পযন্ত চলা এই যুদ্ধে পাক সেনাদের অধিকাংশই নিহত হয়। কুষ্টিয়া শহরের তিনটি প্রধান ঘাটি পুলিশ লাইন, জিলা স্কুল ও ওয়্যারলেস এর মধ্যে শুধু মাত্র জিলা স্কুল ছাড়া সব মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। বিজয়ের আনন্দে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল শক্তিতে জেলা স্কুল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং অবিরাম আঘাত হানতে থাকে। রাতের অন্ধকারে জীবিত প্রায় ৪০-৪৫ জন পাকসেনারা ২টি জীপ ও ২টি ডজ গাড়িতে করে ঝিনাইদহের পথে পালাবার চেষ্টা করে। পলায়নকালের আগেই শৈলকুপার সেতুর কাছে মুক্তিবাহিনীরা আগে থেকেই এমবুশ করে রাথে। সেতুটি ভেঙ্গে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে আলকাতরা দিয়ে রঙ করে পীচঢালা রাস্তার মতো করে রাখে। পলায়নরত পাকসেনাদের গাড়ি দুটি গর্তের মধ্যে পড়ে গেলে মুক্তিবাহিনী অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে। এখানে মেজর শোয়েবসব বেশ কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়।অবশিষ্ট পাকসেনা আহত অবস্থায় আশেপাশের গ্রামে পালিয়ে যায়। গ্রামবাসীরা এসব পাকসেনাদের পিটিয়ে হত্যা করে।
৩১ মার্চ আহত অবস্থায় লে: আতাউল্লআহ শাহ ধরা পড়ে। ১লা এপ্রিল কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়।২রা এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান চৌধুরী তার জবানবন্দি দেন। এই যুদ্ধে মাত্র ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং কয়েকজন আহত হন। শহীদ মুক্তিযযোদ্ধারা হলেন : হামেদ আলী-পিতা –ওমোদ আলী, গ্রাম-দুধকুমড়া, কুমারখালী দেলোয়ার হোসেন পিতা-আলম হোসেন, মিরপুর, খন্দকার আব্দুর রশিদ পিতা-আব্দুর রহমান, গ্রাম-বামনপাড়া, মেহেরপুর, ফজলুর রহমান পিতা-নাসির উদ্দিন, গ্রাম-মেহেরপুর, আশরাফ আলী খান-পিতা হাছেন আলী খান,বামনপাড়া, মেহেরপুর, গোলাম শেখ পিতা-নজীর শেখ, গ্রাম-মশান, মিরপুর। আহত হন-আব্দুল মোমেন পিতা-আব্দুল করিম, কোর্টপাড়া, কুষ্টিয়া, আনসার আলী পিতা-আজগর আলী, চাপাইগাছি, কুমারখালী,কুষ্টিয়া আরও অনেকে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘কুষ্টিয়ার যুদ্ধ’ পাকিস্তানি বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব ধুলায় লুটিয়ে দেওয়া তথা পরাজয়ের প্রথম উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত, যা নিয়ে সাংবাদিক ড্যান কগিন বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের (১৯১৭) ১৯ এপ্রিল সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনী রচনা করেন। সেই কারণে কুষ্টিয়ার মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীণতার ইতিহাসের এক নজিরবিহীন উদাহরণই শুধু নয় রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে এই বীরত্মগাথা।