ক্রিকেট যারা ভালোবাসেন এবংঅস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের খেলাটি যারা দেখেছেন, বহুদিন এই ইনিংসটি তাদের মনে থাকবে
আলাপচারিতা
অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এমন একটা ইনিংস খেলে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় এনে দিলেন, যে ইনিংস দেখে অনেকেই ভাবছেন এটাই ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ইনিংস কি না।
এটাকে ‘ওয়ান ম্যান শো’ বলে বর্ণনা করেছেন কিংবদন্তী ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরাম।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ের জন্য টার্গেট ২৯৩ রান এর মধ্যে ২০১ রান একাই তুলেছেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।
ম্যাক্সওয়েলের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি ছিল এটি আর এই বিশ্বকাপের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি।
রেকর্ডের পাতা তো বটেই, ক্রিকেট যারা ভালোবাসেন এবং খেলাটি যারা দেখেছেন, বহুদিন এই ইনিংসটি তাদের মনে থাকবে।
ম্যাচের একটা পর্যায়ে ম্যাক্সওয়েল পেশিতে টান অনুভব করেন।
ওয়াসিম আকরাম বলেন, “যারা ব্যাটিং করেছেন তারা বলতে পারবেন ক্র্যাম্প নিয়ে ব্যাট করা কতোটা কঠিন কারণ আপনি পা নাড়াতে পারবেন না”।
ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তী সাচিন টেন্ডুলকার সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, “ম্যাক্স প্রেশার থেকেই ম্যাক্স পারফরম্যান্স”।
ওয়ানডে ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি মানেই এক ব্যাটারের অবিশ্বাস্য ব্যাটিং৷ সেরকম ব্যাটিংয়ের চূড়ান্ত রূপ দেখালেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল৷
ইতিহাসের একজনই স্থপতি, অস্ট্রেলিয়ার ৩৫ বছর বয়সি গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, নিজের দেশকে যিনি সেমিফাইনালে তুললেন।
এবার একদিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনেক ধারণাকে বদলে দিচ্ছে, অনেক মিথ ভেঙে দিচ্ছে, ২২ গজে অনেক মহাকাব্য তৈরি হচ্ছে। যেমন হলো মঙ্গলবার মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে।
ক্রিকেট নাকি ১১ জনের খেলা। একটা দলের টপ ও মিডল অর্ডার ব্যর্থ হলে নাকি ম্যাচ জেতা যায় না। এরকম অনেক আপ্তবাক্য ক্রিকেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে। সেই সব আপ্তবাক্যকে অনায়াসে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে এক মহাকাব্যিক, অতিমানবীয় ব্যাটিং উপহার দিলেন ম্যাক্সওয়েল। পায়ের পেশীর প্রবল ব্যথাকে মনের জোরে অতিক্রম করে ম্যাক্সওয়েল দেখিয়ে দিলেন, ১১ জনের খেলায় একজনই টিমকে জিতিয়ে দিতে পারেন। নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন।
ম্যাক্সওয়েল যখন ক্রিজে এলেন তখন ৪৯ রানে চার উইকেট হারিয়ে ফেলেছে অস্ট্রেলিয়া। আফগান বোলারদের ভয়ংকর লাগছে। অস্ট্রেলিয়ার সাত উইকেট পড়ে গেল ৯১ রানে। মনে হচ্ছে, হার অনিবার্য, তখনই জ্বলে উঠলেন ম্যাক্সওয়েল। তবে তার আগে ৩৩ রানের মাথায় নুরের বলে লোপ্পা ক্যাচ দিয়েছিলেন তিনি। মিস করলেন মুজিব। ম্যাক্সওয়েল মঙ্গলবার অনেক ক্রিকেটীয় ধারণাকে ভেঙে দিলেও একটা বেঁচে গেল। ক্যাচ ফেলা মানে ম্যাচও ফেলে আসা। হয়তো বা সেমিফাইনালে ওঠার স্বপ্নও। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মুজিব ও আফগানিস্তানের বাকি প্লেয়াররা।
ম্যাক্সওয়েলের ১২৮ বলে ২০১ রানের ইনিংস এখন ক্রিকেট ইতিহাসে চিরদিনের জন্য থেকে গেল। এই ইনিংসটা মহাকাব্যিক হয়ে গেল, কারণ, শতরান করার আগে ম্যাক্সওয়েলের পেশীতে টান লাগল। দুই বার তিনি মাঠে শুয়ে পড়লেন। বারবার সাপোর্ট স্টাফ তাকে ম্যাসাজ করল, ব্যথা কমানোর ওষুধ খেতে হলো, তারপরেও ব্যথা বাড়তে থাকলো। মনের জোরে ব্যথাকে অতিক্রম করে তিনি আবার ব্যাট হাতে দাঁড়ালেন। একটা সময়ের পর রান নেয়াও প্রায় সম্ভব হলো না। তখন চার ও ছয় মেরে গেলেন।
শেষ ওভারেই তিনটে ছয় ও একটা চার মেরে দলকে জেতালেন, নিজের দুইশ রান পূর্ণ করলেন।
‘এজন্যই তো খেলা দেখা’
উইকেটের অন্যদিকে থাকা কামিন্স পরে বলেছেন, ”অবিশ্বাস্য ঘটনা। ক্রিকেটে এরকম ঘটনা আগে কখনো হয়নি। দর্শকরা বলতেই পারেন, এর জন্যই তো তারা খেলা দেখতে আসেন।”
এমনকী শচিন টেন্ডুলকরও টুইট করে বলেছেন, ”একদিনের ক্রিকেটে আমার দেখা সেরা ইনিংস। শেষ ২৫ ওভারেই ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিলেন ম্যাক্সওয়েল।”
এ বি ডিভিলিয়ার্স বলেছেন, ”ম্যাক্সওয়েল আমাদের অবাক করে দিয়েছে।” শোয়েব আখতারের মতে, ”এরকম একটা ইনিংস যে খেলা সম্ভব তা না দেখলে বুঝতে পারতাম না। অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী থাকলাম।”
কী বললেন ম্যাক্সওয়েল
খেলার পর ম্যাক্সওয়েল বলেছেন, ”আমাদের পরিকল্পনা ছিল, উইকেট হারাব না। খারাপ বল মারব। খুব গরম ছিল। শেষ পর্যন্ত ক্রিজে থাকার চেষ্টা করছিলাম।”
ম্যাক্সওয়েল বলেন, ”পরে ঠিক করি, শট খেলব। জেতার চেষ্টা করব। ক্যাচ পড়েছে সেটা ঠিক, তবে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছি। তাই খুব ভালো লাগছে।”
ম্যাক্সওয়েলের এই ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংসের কারণে রেকর্ডের খাতায় অনেক হিসাব নতুন করে লিখতে হচ্ছে।
চলতি বিশ্বকাপের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা করলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।এটাই অস্ট্রেলিয়ান পুরুষ ক্রিকেট দলের হয়ে সর্বোচ্চ ওয়ানডে স্কোর।
এর আগে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করে কোনও ব্যাটার ডাবল সেঞ্চুরি করেননি। সর্বোচ্চ ছিল পাকিস্তানের ফখর জামানের ১৯৩, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।ম্যাক্সওয়েল প্রথম অস্ট্রেলিয়ান পুরুষ ক্রিকেটার যিনি ওয়ানডে ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন।এর আগে ১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়ান নারী ক্রিকেটার বেলিন্ডা ক্লার্ক ২২৯ রান তুলেছিলেন।
বেলিন্ডা ক্লার্ক অজি ক্রিকেটের একজন কিংবদন্তী, তার সম্মানার্থে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে একটি ভাস্কর্যও রয়েছে।
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে ম্যাক্সওয়েলের মতো বেলিন্ডা ক্লার্কও ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন মুম্বাইয়ের মাটিতে।
ম্যাচের শেষে ম্যাক্সওয়েলের অধিনায়ক প্যাট কামিন্সও পুরো ঘটনাটিকে ‘ওয়ান ম্যান শো’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
আফগানিস্তানের রান তাড়া করতে ২৯৩ রান তুলেছে অস্ট্রেলিয়া, এর মধ্যে ম্যাক্সওয়েলের রান ২০১ যা মোট রানের ৬৮.৬০%।
যদিও এটা অল্পের জন্য রেকর্ড হয়নি, ক্যারিবিয়ান গ্রেট স্যার ভিভিয়িান রিচার্ডস ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দলীয় ২৭২ রানের মধ্যে ১৮৯ রান তুলেছিলেন, যা ছিল ৬৯.৪৮%।
তবে ভিভ রির্চাডসের রান ছিল প্রথম ইনিংসে, সেদিক থেকে ম্যাক্সওয়েলেরটা রান তাড়ার ক্ষেত্রে রেকর্ড।
এর আগে ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপে রান তাড়া করতে গিয়ে নিউজিল্যান্ডের ২২৫ রানের মধ্যে ১৪১ রান তুলেছিলেন স্কট স্টাইরিস।
গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চারটি শতকের মধ্যে তিনটিই বিশ্বকাপে। পাঁচ নম্বরে বা তারও নিচে ব্যাট করে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির রেকর্ডও ম্যাক্সওয়েলের।
সূত্র: বিবিসি বাংলা, ডয়চে ভেলে বাংলা