গণতন্ত্রে প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোটাধিকার থাকে ।।একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে।।ইতিহাসের পাতা থেকে
রুহুল কুদ্দুস টিটো
গণতন্ত্র বলতে কোনও জাতিরাষ্ট্রের (অথবা কোনোও সংগঠনের) এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে।অপরদিকে একনায়কতন্ত্র হলো এমন শাসনব্যবস্থা, যাতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে। একনায়কতন্ত্রকে সামাজিকভাবে নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়।
গণতন্ত্র
ইংরেজি ‘Democracy’ শব্দটি গ্রিক শব্দ Demo Kratia থেকে উদ্ভূত হয়েছে যা গ্রিক শব্দ ‘Demos’ এবং ‘Kratia’ শব্দ দুটির সমন্বয়ে সৃষ্ট। ‘Demos’শব্দের অর্থ হল ‘জনগন’ এবং ‘Kratia’শব্দের অর্থ হল ‘শাসন’। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরীর ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সু্যোগ রয়েছে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপায়ে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪২২ সালে ক্লিয়ান ডেমোক্রেসিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- That shall be the democratic which shall be the people, for the people.
অনেক পরে আব্রাহাম লিঙ্কন তার এক ভাসনের মধ্যে ঠিক এমনই এক জনপ্রিয় সংজ্ঞা প্রদান করেন। আব্রাহাম লিংকন (Abraham Lincoln) November 19, 1863 তারিখে তার দেয়া Pennsylvania state এর গেটিসবার্গ বক্তৃতাতে (Gettysburg Address) গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এভাবে ‘Government of the people, by the people, for the people.’ যার অর্থ হলো-গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য। অধ্যাপক গেটেলের মতে,’ যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগে অংশ নেওয়ার অধিকারী তাই গণতন্ত্র।
বাংলা “গণতন্ত্র” পরিভাষাটি ইংরেজি ডেমোক্রেসি (Democracy) থেকে এসেছে। এই ইংরেজি শব্দটি আবার এসেছে গ্রিক শব্দ δημοκρατία (দেমোক্রাতিয়া) থেকে, যার অর্থ “জনগণের শাসন” শব্দটির দুইটি মূল হচ্ছে δῆμος (দেমোস) “জনগণ” ও κράτος (ক্রাতোস) “ক্ষমতা” থেকে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে অ্যাথেন্স ও অন্যান্য গ্রিক নগররাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসের নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। এই শহর-রাষ্ট্রটি ছিলো এথেন্স শহর এবং তার আশপাশের গ্রামাঞ্চল নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন উপজাতির মধ্য থেকে নেতাদের বেছে নেয়ার যে সনাতনী রীতি চালু ছিলো, ক্লিসথেনিস তার অবসান ঘটান।
তার বদলে তিনি মানুষের নতুন জোট তৈরি করেন এবং প্রতিটি জোটকে ডিময় (Demoi) অথবা প্যারিশ (Parish)- এ বিভক্ত করেন। প্রতিটি মুক্ত নাগরিককে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ে শহর-রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার দেয়া হয়। সাধারণভাবে এই ঘটনাকেই গণতন্ত্রের প্রথম উন্মেষরূপে গণ্য করা হয় যার পরে নাম হয় ডেমক্রেশিয়া (Democratia) যার অর্থ হচ্ছে জনগণের (demos) শক্তি (Kratos)।
একনায়কতন্ত্র
অপরদিকে একনায়কতন্ত্র হলো এমন শাসনব্যবস্থা, যাতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে। একনায়কতন্ত্রকে সামাজিকভাবে নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়।
এই শাসন ব্যবস্থায় আইনসভার অস্তিত্ব নেই বলে শাসনকর্তা তার খেয়াল-খুশিমত দেশ পরিচালনা করেন। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে দেখা যায়।এ শাসন ব্যবস্থা মূলত স্বেচ্ছাচারমূলক।
একনায়কতন্ত্রে একজন একনায়ক সকল শাসনকাজ পরিচালনা করে থাকেন। একনায়ক রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তা এবং চরম ক্ষমতার উৎস, ক্ষমতা প্রয়োগে কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। এক দেশ, এক জাতি, এক নেতা। -একনায়কতন্ত্রের আদর্শ। একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একনায়কের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। তার কাজকর্মের জন্য তাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। তার আদেশ নির্দেশ সকলে মেনে চলতে বাধ্য।
একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় একনায়কের নেতৃত্বে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকে।
একনায়ক তার পছন্দমত উপদেষ্টাদের নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। উপদেষ্টামণ্ডলী তার কাছে দায়ী থাকে ও তার সন্তুষ্টির ওপর তাদের কার্যকাল নির্ভর করে।একনায়কতন্ত্র হচ্ছে এক ব্যক্তির বা একদলের স্বৈরাচারী শাসন যা একটি দেশের জন্য মঙ্গল জনক নয় এবং বর্তমান বিশ্বে একমাত্র উত্তর কোরিয়াতেই এই একনায়কতন্ত্র দেখা যায়।
এরিস্টটল অভিজাততন্ত্রকে সর্বাপেক্ষা উত্তম কিন্তু পলিটিকে সর্বাধিক বাস্তবধর্মী সরকার বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এ শ্রেণীবিভাগে কিছু ভুল/সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। সে যুগে গ্রিসে নগররাষ্ট্র-কেন্দ্রিক রাজ্য দেখা যেতো। এর শাসন কাজ করতেন নগরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের ইচ্ছামাফিক শাসনকাজ পরিচালনা করতেন। গণতন্ত্র সে যুগে সেভাবে দৃশ্যমান ছিল না।
আবার শাসকদের মনোভাব ছিল অনেকটাই স্বৈরাচারী, যাকে স্বৈরাচারতন্ত্র বলা হয়। এটি আসলে একনায়কতন্ত্রের একটি রূপ। এটি সে যুগে বহুল প্রচলিত বলে এরিস্টটল একে স্বাভাবিক সরকারের অন্তর্ভুক্ত করেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু এটি বিকৃত সরকারের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত বলে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এ শ্রেণীবিভাগ প্রত্যাখ্যান করেন। এতদসত্ত্বেয় এই শ্রেণীবিভাগ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ থেকে জানা যায় যে একনায়কতন্ত্র কোনো সাম্প্রতিক উদ্ভাবন নয়, বরং এক সুপ্রাচীন শাসন ব্যবস্থার বিবর্তিত রূপ।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া