গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) শামসুল আলম তাঁর বীরত্বগাঁথা চিরকালই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বাংলার বুকে
শামসুল আলম (বীর উত্তম)
আলাপচারিতা
শামসুল আলম (জন্ম: ১৯৪৭ – মৃত্যু: ৮ ডিসেম্বর ২০২২) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করে।
মাতৃভূমির জন্য তার ত্যাগ অবিস্মরণীয়। একজন মানুষ মাতৃভূমির জন্য কতটা ত্যাগ করতে বা বীরত্ব দেখাতে পারেন তার উদাহরণ শামসুল আলম বীর উত্তম। তাকে হাজারো নির্যাতন করেও আটকাতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান থেকে। মৃত্যুভয় তার মনে কখনো ভয় জাগাতে পারেনি।
শামসুল আলমের জন্ম পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার পাতিলাপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল ওয়াহেদ তালুকদার ও মায়ের নাম শামসুন নাহার বেগম। তার স্ত্রীর নাম শামীম আলম। তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
শামসুল আলম ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) রাওয়ালপিন্ডিতে। চাকরি করতেন পাকিস্তান বিমান-বাহিনীতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এতে যোগ দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোনোভাবেই তা সম্ভব হচ্ছিল না। শেষে সুযোগ হলো জুন মাসে। তখন ছুটি নিয়ে কয়েক দিন করাচীতে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে কৌশলে ঢাকায় আসেন। এতেও শেষরক্ষা হলো না। ঢাকায় আসামাত্র তাকে আটক করা হয়।
১৯৭১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সরকার আটক বন্দীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। শামসুল আলম এর আওতায় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তি পান। এর কয়েক দিন পর তিনি ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তখন ভারতে সবে শুরু হয়েছে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং গঠনের প্রক্রিয়া। সেখানে যাওয়ার পর শামসুল আলমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বিমান উইংয়ে। কয়েক দিন পর শুরু হয় তাদের প্রশিক্ষণ। নাগাল্যান্ড রাজ্যের ডিমাপুরে কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণে অটারের মতো বেসামরিক বিমানের সাহায্যে সঠিক নিশানায় বোমা, রকেট ইত্যাদি নিক্ষেপে পারদর্শিতা অর্জন করেন। শামসুল আলম অপারেশন করেন চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। ভারতের কমলপুর থেকে তিনি ও আকরাম আহমেদ অটার বিমান নিয়ে যাত্রা শুরু করেন চট্টগ্রামের উদ্দেশে। এই বিমানে কাঁটা-কম্পাস ছাড়া দিক নির্ণয়ের আর কোনো আধুনিক সরঞ্জাম ছিল না।
নিশ্চিন্তের ভবিষ্যৎ ছিল তার। ছিল না প্রাচুর্যের অভাব। নিশ্চিত অনাবিল সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের হাতছানি তখন তার সামনে। অথচ সেই নিশ্চিত সাফল্যমাখা ভবিষ্যতের শামসুল আলমই কি না শেষমেশ বেছে নিলেন কণ্টকময় এক অভিযাত্রা। এ পথে ছিল অজস্র বাঁধা-বিপত্তি, সংখ্যাতীত প্রতিকূলতা।
অথচ তিনি নির্ভয়ে, বিন্দুমাত্র দ্বিধা না রেখে পা রেখেছেন এক অনিশ্চিত পথে। কারণ, তার সামনে সবার আগে মাতৃভূমি। মাতৃভূমিই যখন হানাদারদের হাতে নিষ্পেষিত তখন শামসুল আলম কী করে নিরাপদে থাকায় পরিতৃপ্ত হতে পারেন!
সময়টা ১৯৭১ সালের মার্চ। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর তরুণ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম। মার্চের শুরুর দিকে একদিন বলা হলো ৪টি হারকিউলিস উড়োজাহাজের চার্টার্ড ফ্লাইটে করাচি থেকে কয়েকজন ঢাকায় যাবেন। শামসুল আলমকেও তেমনই একটি ফ্লাইটের দায়িত্ব দেওয়া হলো।
যথারীতি নির্দিষ্ট দিনে উড়োজাহাজ নিয়ে ঢাকা এলেন শামসুল আলম। তারা ঢাকায় নামার কয়েক ঘণ্টা পর এক বাঙালি লোড মাস্টার শামসুল আলমকে বললেন, ‘স্যার আমরা তো সাধারণ যাত্রী আনছি না বরং ট্রুপস আনছি।’
আঁতকে উঠলেন শামসুল আলম। কিন্তু, যাত্রীদের সবার পরনেই তো বেসামরিক পোশাক ছিল। তবে কি গোপনে ঢাকায় সেনা সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। তার বুঝতে দেরি হলো না পরিস্থিতি কোন দিকে এগোচ্ছে।
শামসুল আলমের মামা ব্যারিস্টার কে জেড আলম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ। শামসুল আলমের মনে হলো তথ্যটি বঙ্গবন্ধুকে জানানো দরকার। সে অনুযায়ী তিনি সেই ফ্লাইটের যাত্রীদের তালিকার কপি গোপনে সংগ্রহ করে বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। এটি বঙ্গবন্ধুকে অধিকতর কৌশলী হতে সাহায্য করেছিল।
শামসুল আলমের কর্মস্থল তখন রাওয়ালপিণ্ডির চাকলালা বিমান ঘাঁটিতে। ১৮ মার্চ পর্যন্ত এভাবেই ঢাকায় সেনা আনতে বাধ্য হন শামসুল আলম। ১৮ মার্চের পর আর কোনো ফ্লাইটের দায়িত্ব পাননি তিনি।
২৬ মার্চ সকাল বেলায় ক্যান্টনমেন্টের টেলিফোন বুথে এক পাকিস্তানি অফিসারকে ফোনে কথা বলতে দেখে আড়ি পাতেন তিনি। সেই অফিসার মুলতানে কারো সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে টেলিফোনে উর্দুতে বলছেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ তাদের শেষ করে দিয়েছি। সব শেষ করে দিয়েছি। বহু মানুষ মারা গেছে।’
টেলিফোনে কথোপকথন শুনেই শামসুল আলম বুঝতে পারলেন পরিস্থিতি ভীষণ ঘোলাটে। নিশ্চয়ই বড় কিছু ঘটেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে।
শামসুল আলম বুঝতে পারলেন অবস্থা সুবিধার নয়। বড় কিছু একটা ঘটেছে। ২৬ মার্চ থেকে সমস্ত বাঙালি বৈমানিকদের ফ্লাইট অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ করা হলো। অবাঙালি অফিসাররা বাঙালি অফিসারদেরকে এড়িয়ে চলতে লাগলেন।
তখন পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে ভয়েস অব আমেরিকা ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর মাধ্যমে সংবাদ নিতে থাকলেন তিনি। এরপর রেডিওতে ২৫ মার্চের নারকীয় গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি। রেডিওতে তিনি শুনতে পান দেশে সর্বস্তরে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের।
মাতৃভূমি থেকে সাড়ে ১২শ মাইল দূরে শামসুল আলম। একবার যদি ফাঁস হয় তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন তাহলে তার একমাত্র শাস্তি হবে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড। তাই সুযোগের অপেক্ষায় তিনি প্রহর গুণতে লাগলেন।
মে মাসের শেষ দিকে শামসুল আলমকে এক নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এক অতিরিক্ত সচিব। নৈশভোজের একপর্যায়ে সেই সচিব শামসুল আলমকে আলাদা করে ডেকে খাম ধরিয়ে বললেন, ‘খন্দকার সাহেব আপনাকে এই চিঠিটি দিতে বলেছেন।’
আবদুল করিম খন্দকার তখন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। ভারত সরকারের সঙ্গে তিনি তখন বিমানবাহিনী গঠনের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। শামসুল আলমকে লেখা এ কে খন্দকারের সেই চিঠিতে লেখা ছিল, ‘প্রিয় সহকর্মীরা। তোমাদের এখন নৈতিক দায়িত্ব দেশ মাতৃকার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া। মাতৃভূমি রক্ষার জন্য তোমরা এখনই সম্মুখ সমরের জন্য প্রস্তুতি নাও।’
শামসুল আলম বুঝতে পারলেন বড় ঘটনাই ঘটতে যাচ্ছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যে করেই হোক তাকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে হবে।
এক পর্যায়ে শামসুল আলমের মাথায় একটি পরিকল্পনা এলো। তিনি তার কমান্ডিং অফিসারকে বললেন, ‘আমরা বসে আছি, হাতে এখন কোনো কাজ নেই। আমার বোন থাকে করাচিতে যদি। আমাকে কয়েকদিনের ছুটি দেওয়া হলে আমি তার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে পারি।’
কয়েক দিন পর ৭ দিনের ছুটি মঞ্জুর হলো শামসুল আলমের। ছুটি পেয়েই সর্বপ্রথম ব্যাংকে গিয়ে ৫০ হাজার টাকা উঠালেন তিনি। বলে রাখা ভালো ওই সময়ে এই টাকায় রাওয়ালপিণ্ডিতে বাড়ি কেনা যেত। এরপর পিআইএ কার্যালয়ে গিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী রাওয়ালপিণ্ডি-করাচী রিটার্ন টিকেট কিনলেন তিনি। করাচিতে গিয়ে শামসুল আলম পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অফিসার্স মেস মাসরুরে উঠলেন। এরপর তিনি প্রতিদিনই বাইরে ছুটি কাটাতে লাগলেন, যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে।
এরপর করাচির পিআইএ কার্যালয়ে গিয়ে রাওয়ালপিণ্ডি ফ্লাইটের সময় অনুযায়ী করাচি থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটের টিকেট কাটলেন শামসুল আলম। নির্দিষ্ট দিনে প্রথমে রাওয়ালপিণ্ডির ফ্লাইট এলেও রাওয়ালপিণ্ডিগামী বিমানে না উঠে অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। এক পর্যায়ে ঢাকাগামী বিমান এলে সেই বিমান ধরে ঢাকা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান শামসুল আলম।
তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামার পর লাগেজের অপেক্ষায় বসে আছেন তিনি। এমন সময় এক অবাঙালি গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সঙ্গে কি গাড়ি আছে? শামসুল আলম বললেন, ‘গাড়ি নেই তবে আমি স্কুটারে করে চলে যাবো।’
তখন সেই অফিসার বললেন, ‘না না, তুমি আমার জিপটি নিয়ে যাও।’ জিপটি নিয়ে ঢাকা ঘাঁটির দিকে যাচ্ছিলেন শামসুল আলম ও সেই অফিসার। তখন সেই অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কাছে কি কারফিউ পাস আছে? সূর্যাস্তের পর শহর এলাকায় কোনো অফিসার কারফিউ পাস ছাড়া যাতায়াত করতে পারবে না।’
কথা বলতে বলতেই তাদের জিপটি এসে থামলো একটি টিনশেড অফিসের নিচে। অফিসারটি তাকে রেখে চলে গেলেন। ২ জন সেন্ট্রি বাইরে থেকে এলেন। তখনই সেই গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসে বললেন, ‘তুমি রাতটা অফিসার্স মেসে কাটাও। সকালে আমি তোমাকে কারফিউ পাস দিবো।’
এক পর্যায়ে সেই অফিসার হঠাৎ দাঁড়িয়ে বললো, ‘সরি আলম, আমি এখন তোমাকে কিছু অপ্রত্যাশিত বিষয়ে প্রশ্ন করবো। আগে আমি তোমার লাগেজটা একটু সার্চ করবো।’
শামসুল আলম কিছু বলার আগেই সেই অফিসার লাগেজ সার্চ করতে করতে বললেন, ‘ও মাই গুডনেস, তুমি তোমার ফ্লাইং লগ বুক, সার্টিফিকেট সবই দেখি নিয়ে এসেছো।’
এরপরই হ্যান্ড ব্যাগের একটি কোণা থেকে মোটা অংকের টাকা বের করলেন তিনি। মুহূর্তেই পাল্টে গেল সেই অফিসারের গলা। বললেন, ‘আলম আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হচ্ছি। তবে ভয় নেই। আমাদের সত্য বললেই তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’
কিছু বলার আগেই শামসুল আলমকে একটি অন্ধকার ঘরে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন সেই অফিসার। এটি ছিল মূলত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।
কিছুক্ষণ পরই তার ডাক পড়লো। তার বের হওয়ার সময় সেই অফিসার মুচকি হেসে বললেন, ‘ভাই একটু শক্ত থাকবেন।’ এরপরই শুরু হয় শামসুল আলমের ওপর নির্যাতন। একপর্যায়ে তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী আরেকটি ভবনে। সেখানেও পার্শ্ববর্তী ভবনগুলো থেকে নির্যাতনের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি।
শামসুল আলম বলেন, ‘আমাকে একটি ভবনের দোতালায় ডেকে আনা হলো। তখন চারপাশে কেবল নির্যাতনে আর্তনাদের শব্দ। পেটাতে পেটাতে পাকিস্তানি সেনারা একটাই শব্দ তারা বলছেন, ‘সালা মুর্গা হ যা, মুর্গা হো যা। শেখ মুজিবকা বাচ্চা।’
তার ভাষায়, ‘ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি অনুধাবন করলাম বঙ্গবন্ধুর শক্তি। এরপর আমাকে কয়েকটি A4 সাইজের কাগজ দিয়ে বলা হলো, তোমাকে এখানে পরিপূর্ণভাবে লিখতে হবে তুমি কেন পাকিস্তান ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছো।’
প্রথম দিনে শামসুল আলম লিখলেন যে, তিনি তার পরিবারের খোঁজ পাচ্ছেন না। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করা ও পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করার জন্য তিনি বাধ্য হয়ে এসেছেন। কিন্তু, সকালবেলা এসে সেই অফিসার জবাব দেখে ছিঁড়ে ফেলে বললেন, ‘এটা কী লেখেছো। আসল সত্যটা লিখো। তুমি সত্য না লিখলে মুক্তি পাবে না।’
টানা ৩ দিন একই লেখাই লিখলেন তিনি। তৃতীয়দিন সেই অফিসার বললেন, ‘তুমি কিন্তু আমাদের কথা শুনছো না। আমরা ঠাট্টা করছি না।’
এতেও দমেননি শামসুল আলম। আবারও সেই একই কথা লিখলে সেই অফিসার খেপে গিয়ে শামসুল আলমকে বিবস্ত্র করার নির্দেশ দিলেন। একই সঙ্গে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সুবেদারকে বললেন, ‘ও যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কথা মতো না লিখে ততক্ষণ কাপড় পরতে পারবে না। টানা ৩ রাত ৩ দিন বিবস্ত্র অবস্থায় শামসুল আলমের ওপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। বিবস্ত্র অবস্থাতেই সেই সময় মুহূর্তের জন্যও বসতে পারতেন না তিনি। তা সত্ত্বেও শামসুল আলম প্রথম ২ দিন একই কথা লিখছেন।’
এমন পৈশাচিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে তার শরীর ভেঙে পড়তে লাগলো। যখনই তিনি ভীষণ ক্লান্তিতে নুয়ে পড়তেন তখনই তার ওপর চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি সত্য স্বীকারের সিদ্ধান্ত নেন। অফিসারের কথা মতোই লিখলেন, ‘আমি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, পাক ৪৯২১। আমি স্বীকারোক্তি দিচ্ছি, পূর্ব পাকিস্তানে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যোগদান করা।’
পরদিন সেই অফিসার এসেই লেখাটি দেখে শামসুল আলমকে কাপড় পরতে দিলেন।
২ দিন পর এক পাকিস্তানি অফিসার শামসুল আলমের সেলে এসে বললেন, ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, তুমি তোমার স্বীকারোক্তিতে লিখেছো তুমি পূর্ব পাকিস্তানে এসেছো যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য। যা দেশদ্রোহী অপরাধ। সুতরাং তোমাকে মার্শাল ল রেগুলেশন ৩৯ সি’র মুখোমুখি করা হচ্ছে। এটির রায় হবে হয় মৃত্যুদণ্ড নয় যাবজ্জীবন।’
এর মধ্যে ১৪ আগস্ট চলে আসে। শামসুল আলমের সেলে এসে এক সুবেদার মেজর বললেন, ‘আপনার বেইস কমান্ডারের কাছে রিপোর্ট এসেছে। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’
অবাঙালি গ্রুপ ক্যাপ্টেন মাসুদ ছিলেন শামসুল আলমের অধিনায়ক। তার সঙ্গে দেখা করেই সমস্ত কিছু খুলে বললেন শামসুল আলম। মাসুদ বললেন, ‘তোমাকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হয়েছে। এখন তোমাকে পাকিস্তান যেতে হবে। ভারতের সঙ্গে শিগগির আমরা যুদ্ধে জড়াতে যাচ্ছি। আমাদের অনেক পাইলট প্রয়োজন। বলো, তুমি কবে পাকিস্তান যেতে চাও?’
জবাবে শামসুল আলম নিজের গায়ের পোশাক খুলে দেখালেন। শরীরজুড়ে কেবলই বেত্রাঘাতের চিহ্ন।
সেই অধিনায়ক করণীয় সম্পর্কে শামসুল আলমের কাছে জানতে চাইলে শামসুল আলম এক মাসের ছুটি চাইলেন। টেলিফোনে সদরদপ্তরে কথা বলে জানালেন ‘আলম তুমি ১ সপ্তাহের ছুটি পেয়েছো। এক সপ্তাহ পর তোমাকে রিপোর্ট দিতে হবে। এরপর তোমাকে পাকিস্তানে চলে যেতে হবে।’
মুক্তি পেয়েই মালিবাগের বাসায় চলে আসেন তিনি। তার মুক্তির সংবাদ শুনেই কয়েকজন কিশোর তার বাসায় এসে বললো, ‘আপনার মুক্তি পাওয়ার খবরেই আমরা এসেছি। আপনি নিশ্চয়ই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেবেন। আপনাকে আগরতলা পৌঁছে দেওয়াই আমাদের কাজ।’
এমন শারীরিক অবস্থাতেই গোপনে ৩ দিন পায়ে হেঁটে আগরতলায় পৌঁছান তিনি। এরপর উড়োজাহাজে করে কলকাতায় চলে যান। সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় এ কে খন্দকারের।
এ কে খন্দকারের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত খুলে বলেন তিনি। এ কে খন্দকার বললেন, ‘তুমি খুব ভালো সময়ে এসেছো। আমরা বিমানবাহিনী গঠন করতে যাচ্ছি।’
এরইমধ্যে ভারত সরকার থেকে পাওয়া ৩টি অতি সাধারণ এয়ারক্রাফট নিয়ে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে গঠন হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। এই ৩ এয়ারক্রাফটের মধ্যে কোনোটাই যুদ্ধবিমান বা যুদ্ধের উপযোগী ছিল না। ৩ এয়ারক্রাফটের মধ্যে ছিল একটি করে ডাকোটা ডিসি থ্রি পরিবহণ বিমান, ডি.এইচ.সি-৩ টুইন অটার পর্যবেক্ষণ বিমান ও ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানোর কাজে ব্যবহৃত অ্যালুয়েট থ্রি হেলিকপ্টার।
ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে শুরু হয় অপারেশন কিলোফ্লাইটের পথচলা।
নানান প্রতিকূলতা শেষে বেসামরিক উড়োজাহাজগুলোকে রূপান্তরিত করা হয় সামরিক বিমানে। যেহেতু বৈমানিকরা এই ধরনের বিমানে অভ্যস্ত ছিলেন না তাই শামসুল আলমদের নিতে হয়েছিল কঠোর প্রশিক্ষণ। শামসুল আলম প্রশিক্ষণ নেন অটার বিমানের মাধ্যমে অপারেশনের জন্য।
৩০ অক্টোবর পুরো অপারেশন সম্পর্কে বৈমানিকদের ব্রিফ করা হলো। সিদ্ধান্ত হয় ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে ডাকোটা বিমান দিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর ও অটার বিমান দিয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে হামলা চালানো হবে। শামসুল আলমকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পতেঙ্গায় আক্রমণের। যদিও শেষ মুহূর্তে তা স্থগিত হয়।
২৮ নভেম্বর আবার হামলার দিন ধার্য করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়েছিল অটার বিমান দিয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে হামলা চালাবেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম ও একজন গানম্যান।
অন্যদিকে অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার দিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলেন ইউএসএসওর তেলের ডিপোয় হামলা চালাবেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। শেষ পর্যন্ত সেই ২টি অপারেশনের দিনও পেছানো হয়।
৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করলে শামসুল আলমদের আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে রাতেই অপারেশন শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়।
ছবি:মুক্তি বাহিনী এভিয়েইশন কর্তৃক ব্যবহৃত ডিএইচসি-৩ অটার বিমান
৩ ডিসেম্বর রাতটি ছিল কিছুটা জ্যোৎস্নাময়। ডিমাপুর থেকে প্রথমেই কৈলাসহর আসেন শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম। কারণ, ডিমাপুর থেকে যদি সরাসরি তারা চট্টগ্রামে যেতেন তাহলে পথেই জ্বালানি ফুরিয়ে যেত।
তারা জানতেন না জীবন নিয়ে আর ফেরা হবে কিনা। কৈলাসহর থেকেই গভীর রাতে উড্ডয়ন করলেন শামসুল আলম ও আকরাম আহমেদ। পিছনে এক গানার ও বোমা ফেলার জন্য এক মুক্তিযোদ্ধা। তাদের সবার সঙ্গে ছিল হাজারখানেক পাকিস্তানি রুপি ও একটি করে রিভলভার।
উড়ার সঙ্গে সঙ্গে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছিলেন তারা। তাদের সঙ্গে রেডিও ছিল না। বাতাস পরিমাপের যন্ত্রও ছিল না। তাই বিমানের অবস্থান সম্পর্কেও জানার উপায় ছিল না।
প্রথমে হাজার ফুট উচ্চতায় উঠলেও এরপর ৩০০ ফুটে নেমে ফেনী নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরের কোস্ট লাইন ধরে চট্টগ্রামে পৌঁছান তারা। সে সময় শামসুল আলমদের অটার বিমানটির গতি ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার।
তারা জানতেন, ‘ওখানে কোনো অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান নেই। কোনো ব্ল্যাকআউটও করেন না ওরা।’ ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করায় পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোয় ব্ল্যাকআউট শুরু করে। চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রাম রিফাইনারির আলো না দেখতে পেয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন শামসুল আলমরা। একপর্যায়ে চাঁদের আলোয় চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দেখতে পেয়ে সামনে এগোতেই তারা ইস্টার্ন রিফাইনারি জ্বালানি ট্যাংকগুলো দেখতে পান।
এরপর তারা চারপাশে ঘুরে কয়েকবার রকেট হামলা চালান। প্রথম ২ বারে বিস্ফোরণ না হওয়ায় তৃতীয়বারে আক্রমণ করতে গেলে নিচ থেকে শুরু হয় পাকিস্তানিদের মেশিনগানের গুলিবৃষ্টি। এরপরই চতুর্থবার হামলা করতে গিয়ে শামসুল আলমরা দেখলেন পুরো ইস্টার্ন রিফাইনারিতে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে।
৫ বার আক্রমণের পর ফিরে আসেন শামসুল আলমরা। তাদের ফিরে আসার পথটিও ছিল বিপজ্জনক। তাদের অবতরণ করতে হয় আরও দূরে অচেনা এক ঘাঁটি কুম্ভিগ্রামে। ম্যাপে দেখলেও শামসুল আলমরা জানতেন না এটি কোথায়।
শামসুল আলমদের উড়োজাহাজের জ্বালানি কমে যাচ্ছে। যখন তারা কাছাকাছি এলেন তখন রেডিওতে কল দিতে লাগলেন শামসুল আলম। কিন্তু কোনো সাড়া পেলেন না। একটু পরেই কল পেলেন শামসুল আলম। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো ‘কিলোফ্লাইট, দিস ইজ কুম্বিগ্রাম, ডু ইউ রিড?’
তখনই শামসুল আলম বললেন, ‘ইয়েস আই রিড।’ শামসুল আলম বামে দেখতে পেলেন রানওয়ের মধ্যে কেরোসিনের বাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন।
কোনো রানওয়ে বাতি নেই। অবতরণ করলেন তারা। ঘড়িতে তখন ভোররাত ৩টা। তাদের বরণ করতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভারতীয় গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। ততক্ষণে বিবিসিতে সংবাদ পৌঁছে গেছে, এক অজানা বিমান চট্টগ্রাম ফুয়েল ডাম্পিংয়ে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং শামসুল আলমকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ও মাই বয়। ইউ হেভ ডান ইট।’ কিলোফ্লাইটের এই আক্রমণে প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জ্বালানি ব্যবস্থা। মুক্তিযুদ্ধের বাকিটা সময় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো কার্যত জ্বালানির অভাবে অচল হয়ে যায়। এই দুর্ধর্ষ অপারেশনটির পরও একাধিক অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন শামসুল আলম।
শামসুল আলম প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষ হিসেবে তো আমরা একসময় না একসময় মারাই যাবো। কিন্তু, বীরের মতো মৃত্যু আর কাপুরুষ কিংবা সাধারণ মানুষের মৃত্যু কি এক? তাহলে জীবনের সার্থকতা কোথায়?’
এই দুয়ের মধ্যে যে বিশাল তফাৎ তার এক অনন্য উদাহরণ শামসুল আলম। মাতৃভূমির জন্য তার অসীম বীরত্ব, রূপকথার মতো আত্মত্যাগ কখনোই মুছে যাওয়ার নয়।
নিরাপদ ভবিষ্যৎ, উজ্জ্বলতম ক্যারিয়ার, সব কিছুকে সরিয়ে নিজের প্রাণের মায়া ছেড়ে মাতৃভূমিকে রক্ষার যে অবদান এর কি তুলনা হয়? শামসুল আলম সৃষ্টি করেছিলেন এমনই এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
শামসুল আলম ২০২২ সালে ৮ ডিসেম্বর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা যান ,গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) শামসুল আলমের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে হয়তো শারীরিকভাবে চলে গেছেন কিন্তু তার বীরত্বগাঁথা চিরকালই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বাংলার বুকে। শামসুল আলম থাকবেন সেই ইতিহাসের এক স্রষ্টারূপে।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ১০ম খণ্ড, দ্যা ডেইলি স্টার বাংলা