চন্দ্রযান-৩অবতরণ করল চাঁদের কঠিনতম অংশে ।। যে অংশে আমেরিকার মতো দেশের মহাকাশ গবেষকেরা চন্দ্রযান নামানোর ঝুঁকি নেননি
আলাপচারিতা
কোটি কোটি ভারতবাসী অধীর উৎকন্ঠা নিয়ে টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষা করছিলেন – যেখানে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর দেওয়া অভিযানের প্রতিটি মুহুর্তর আপডেট লাইভ সম্প্রচার করা হচ্ছিল।ভারত সন্ধ্যা ছ’টা বাজার মিনিটকয়েক পরেই সেই সফট ল্যান্ডিং সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার ঘোষণা হতেই সারা দেশ উল্লাসে ফেটে পড়ে। রাস্তায় রাস্তায় আতসবাজি ফাটানো ও মিষ্টি বিলি করা শুরু হয়ে যায় – অনেকেই তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা নাড়াতে শুরু করে দেন।
সাম্প্রতিক হলিউড মুভি ওপেনহাইমার তৈরির চেয়েও কম খরচে সম্পন্ন হয়েছে চন্দ্রযান-থ্রি। সমসাময়িক আর একটি ছবি ‘বার্বি’র নির্মাণে যা খরচ হয়েছে, তার মাত্র অর্ধেক লেগেছে এই মহাকাশ অভিযানে।
ইসরোর তথ্য অনুসারে, চন্দ্রযান-থ্রি অভিযানে মোট ৬১৫ কোটি ভারতীয় রুপি বা ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো খরচ হয়েছে।এমন কী চার বছর আগেকার চন্দ্রযান-টুর চেয়েও অনেকটা কম খরচ হয়েছে এই অভিযানে।এত কম খরচে পৃথিবীতে কোনও সফল মহাকাশ অভিযান লঞ্চ করার নজির খুব কমই আছে।বস্তুত চন্দ্রযান-থ্রির খরচ হলিউডের বহু বিগ-বাজেট ও ব্লকবাস্টার ছবির নির্মাণের খরচের চেয়েও অনেক কম বলে বলা হচ্ছে।
ছবি:মিশন সেন্টারে ইসরোর বিজ্ঞানীরা
বুধবার ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে এই ঐতিহাসিক সাফল্যের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারত এই গৌরব অর্জন করল – আর চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণের দিক থেকে তারাই হল প্রথম দেশ।গত ১৪ জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে চন্দ্রযান-থ্রির এই যাত্রা শুরু হয়েছিল।
চন্দ্রযান-৩ এর খবর
দের মাটিতে ১৪ দিনের কাজ হাতে নিয়ে নেমেছে চন্দ্রযান-৩। এই ১৪ দিনের কাজ শেষ হলে কী হবে? জিনিসপত্র গুছিয়ে কি আবার ঘরে ফিরবে চন্দ্রযান-৩। ইসরো জানিয়েছে, তেমনটি হওয়ার নয়। কাজ শেষেও ‘বাড়ি’ ফেরা হবে না ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ বা অভিযাত্রী যান ‘প্রজ্ঞান’-এর। চিরতরে চাঁদের মাটিতেই থেকে যাবে তারা। এমনকি, ১৪ দিনের কাজ শেষ হলে ‘কর্মক্ষেত্রে’ মৃত্যুও হতে পারে তাদের। কিন্তু সত্যিই কি চাঁদের বুকে চন্দ্রযান-৩-এর বেঁচে থাকার কোনও সম্ভাবনাই নেই? কী বলছেন বিজ্ঞানীরা?
দিনের আলোর পর চাঁদে নামবে ১৪ দিনের অতিশীতল রাত। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।আনন্দবাজার
চাঁদে ১৪ দিনের জীবনকাল দিয়েই ইসরো পাঠিয়েছে বিক্রম এবং প্রজ্ঞানকে। বিক্রম এবং প্রজ্ঞানের যে সমস্ত যন্ত্রপাতি রয়েছে, যেগুলির সাহায্যে চাঁদের মাটিতে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে কিংবা সংগ্রহ করবে তথ্য, সেই সব যন্ত্র চলবে সৌরশক্তিতে। ফলে চাঁদে যত ক্ষণ সূর্য থাকবে তত ক্ষণই প্রাণ থাকবে তাদের। ১৪ দিন পর চাঁদে সূর্যাস্ত (চাঁদে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত হতে সময় লাগে পৃথিবীর হিসাবে ১৪ দিন) হলে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়বে বিক্রম এবং প্রজ্ঞান। নিস্তেজ হয়ে পড়বে তাদের ভিতরে থাকা সমস্ত যন্ত্রপাতিও। তবে কি ১৪ দিনের জীবনকাল শেষে সত্যিই ‘মৃত্যু’ অবধারিক চন্দ্রযান-৩-এর? ইসরোর বিজ্ঞানীরা এ প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দেননি। তবে চাঁদের মাটিতে বিক্রম আর প্রজ্ঞানে নতুন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা একেবারে নেই বলে উড়িয়েও দেননি।
বিজ্ঞানী দেবীপ্রসাদ দুয়ারির মতে, ‘‘ইসরো বিষয়টিকে একেবারে নাকচ করে দেয়নি ঠিকই। তবে বিক্রম এবং প্রজ্ঞানের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে অনেক গুলো ‘যদি’ এবং ‘তবে’র উপর।’’ বিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ১৪ দিনের ‘সকাল’ কাটানোর পর নামবে ১৪ দিনের অতিশীতল রাতও। এই ১৪ দিন সূর্য রশ্মির একটি কণাও প্রবেশ করবে না চাঁদের ‘কুমেরু’তে। তপমাত্রা নেমে যেতে পারে মাইনাস ৩০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত। তাতে চন্দ্রযান-৩-এর যন্ত্রপাতির বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
কিন্তু তার পর তো আবার চাঁদে সূর্য উঠবে? বিক্রম বা প্রজ্ঞানের সৌরশক্তি সংগ্রহ করার যন্ত্রও থাকবে। সেক্ষেত্রে সৌরশক্তি আবার সজীব করতে পারবে না চন্দ্রযান-৩কে? দুয়ারির দাবি, ‘‘সেই সম্ভাবনা নিয়ে অতিরিক্ত আশাবাদী না হওয়াই বোধ হয় ভাল। কারণ, ওই প্রচণ্ড শীতল পরিবেশে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে বিক্রম এবং প্রজ্ঞানের যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাদের তৈরি করা হয়েছে ১৪ দিনের জীবনকালের কথা মাথায় রেখে। তার পরও যদি সেই সব যন্ত্র কোনও মতে বিকল না হয় এবং সৌরশক্তিতে আবার চালু হওয়ার ক্ষমতা তাদের থাকে, তবে তাদের প্রাণ ফিরলেও ফিরতে পারে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা এতটাই কম, যে সেটা নিয়ে কোনও আশা না রাখাই বোধ হয় ভাল।
’’কিসের টানে ‘কুমেরু’তে ফিরে এল ইসরোর চন্দ্রযান? আঁধারে মোড়া দক্ষিণে লুকিয়ে কিসের আলেয়াচন্দ্র অভিযানে ভারত নিতান্তই নবীন।
২০০৮ সালে চন্দ্রযান-১ পাড়ি দিয়েছিল। তবে চাঁদে তার অবতরণ করার কথা ছিল না। সেই চেষ্টা করেছিল চন্দ্রযান-২। বেছে নিয়েছিল চাঁদের কঠিনতম এলাকাকে।
গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।আনন্দবাজার
ঠিক ৪০ দিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে বুধবার চাঁদে নামল চন্দ্রযান-৩। অবতরণ করল চাঁদের কঠিনতম অংশে। যে অংশে আমেরিকার মতো দেশের মহাকাশ গবেষকেরা চন্দ্রযান নামানোর ঝুঁকি নেননি। চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। খোদ ভারতই বিফল হয়েছে চার বছর আগে। তবু হাল ছাড়েনি ইসরো। চাঁদের আঁধারে ঘেরা ‘কুমেরু’তেই দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় লক্ষ্যভেদ করেছে। কিন্তু কিসের টানে? কেন বিপদে মোড়া চাঁদের এই দক্ষিণ মেরুতে এল ইসরো? কী আছে চাঁদের এই অংশে?
চন্দ্র অভিযানে ভারত নিতান্তই নবীন। ২০০৮ সালে চন্দ্রযান-১ পাড়ি দিয়েছিল চাঁদে। তবে সেই অভিযানে চাঁদে অবতরণ করার কথা ছিল না। সেই চেষ্টা করেছিল চন্দ্রযান-২। আর প্রথমেই বেছে নিয়েছিল চাঁদের কঠিনতম এলাকাকে। ব্যর্থ হলেও সেই লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি ইসরো। দ্বিতীয় বারের চেষ্টাতেও অবতরণের একই স্থান নির্বাচন কর হয়েছে। যদিও আমেরিকা, রাশিয়ার মতো অভিজ্ঞ পূর্বসূরিরা আগে সেই ঝুঁকি নেয়নি। চাঁদের নিরক্ষরেখার আশপাশে সহজ জায়গায় ল্যান্ডার নামিয়েছিল তারা। অথচ চাঁদে অভিযাত্রী নামিয়েছে আমেরিকা। রাশিয়ার ল্যান্ডার চাঁদের মাটি সংগ্রহ করে ফিরে এসেছে দেশে। এরা কেন ভারতের আগে চেষ্টা করেনি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামার?
কেন কুমেরু কঠিন ঠাঁই?
১। অন্ধকার: চাঁদের এই চত্বরে সর্বত্র পৌঁছয় না সূর্যের আলো। যেটুকু পৌঁছয়, তা কিছুটা তেরছা ভাবে। আলোর থেকে ছায়াই পড়ে বেশি।
২। অতিশীতল: সূর্যের আলো না পড়ায় চাঁদের দক্ষিণ মেরুর তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের অনেক নীচে। মাইনাস ৩০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত নামতে পারে তাপমাত্রা।
৩। দুর্গম: গিরি এবং খাদ দুই আছে এই দক্ষিণ মেরুতে। চাঁদের অন্যান্য অংশের থেকে একটু বেশিই তার সংখ্যা। পদে পদে রয়েছে কয়েক হাজার কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি ব্যাসের গভীরতম খাদ। যেখানে আজ পর্যন্ত পৌঁছয়নি সূর্যের আলো। আবার আছে উঁচু পাহাড়ও। সূর্যের তেরছা আলো সেই পাহাড়ের মাথায় পড়ে দীর্ঘ ছায়া তৈরি করে চাঁদের মাটিতে। আছে ছোট-বড় কূপের মতো গর্ত। পাহাড়ে ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকে তারা।
কী এমন আছে দক্ষিণ মেরুতে?
১। আগামী দিনে পৃথিবীর বাইরে যদি কখনও মানুষের থাকার জায়গা তৈরি হয়, তবে সবার আগে দরকার হবে জল। তাই পৃথিবীর বাইরে এই একটি বস্তুই হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সেই জলের সন্ধান মিলতে পারে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।
২। ইতিমধ্যেই চন্দ্রযান-১ এবং চন্দ্রযান-২-এর অরবিটার চাঁদে হাইড্রক্সিল এবং জলের উপস্থিতির সন্ধান দিয়েছে।
৩। পরে বিজ্ঞানীরা আরও গবেষণা করে দেখেছেন, চাঁদের এই সমস্ত এলাকায় অজস্র খাদের গভীরে যে হেতু কখনও সূর্যের আলো প্রবেশ করেনি, তাই সেখানে থাকতে পারে জলীয় বরফ। সেই বরফেরই সন্ধান করবে ভারতের চন্দ্রযান-৩।
৪। চাঁদের এই দক্ষিণ মেরুতে যে কূপের মতো গর্ত রয়েছে, তা থেকে আরও তথ্য পাওয়ার আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। চাঁদের আগ্নেয়গিরি এমনকি, প্রাচীন সমুদ্রের উৎসেরও সন্ধান করবে তারা।
৫। চাঁদের এই এলাকায় চাঁদের অভিযাত্রী যান ‘প্রজ্ঞান’-এর ঘুরে বেড়ানোও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ মেরুর এই আঁধারে মোড়া এলাকায় প্রায়ই উল্কাপাত হয়। যখন-তখন ছিটকে আসে গ্রহাণুও। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চন্দ্রযান-৩কে বাঁচিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জও তো কম নয়।
চন্দ্রায়ন-থ্রির পাঠানো চাঁদের বুকের ছবি
বিজ্ঞানীরা কী বলছেন?
ইসরোরই প্রাক্তন অধিকর্তা সুরেশ নায়ক সর্বভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘ইসরো বরাবরই প্রত্যেক মহাকাশ অভিযানে নতুন কিছু করার চেষ্টা করে। নতুন চ্যালেঞ্জ ছোঁয়ার চেষ্টা করে। চন্দ্রযান-২-এর সময়েও সেই চেষ্টা করেছিল ইসরো। প্রথম বার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় চ্যালেঞ্জ ছুঁয়ে দেখাল তারা। এ বার শুধু দেখার চাঁদের অভিযাত্রীযান প্রজ্ঞান, ওই আঁধারে মোড়া ‘কুমেরু’ থেকে কোন আলো উদ্ধার করে আনে।
এই অভিযানের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এটি অবতরণ করেছে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে, যেখানে সম্প্রতি জলের অস্তিত্ত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর সারা পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ ও মনোযোগ এখন চন্দ্রপৃষ্ঠের ওই অঞ্চলটিতেই।
চন্দ্রযান-টুর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইসরোর বিজ্ঞানীরা চন্দ্রযান-থ্রিতে বেশ কিছু উন্নতি সাধন করেছিলেন, যাতে এবারে সফট ল্যান্ডিং একশোভাগ সফল হতে পারে।
ইসরোর অধিকর্তা, মহাকাশবিজ্ঞানী এস সোমনাথের কথায়, “আমাদের প্ল্যান এ কোনও কারণে বানচাল হলে তার জন্য প্ল্যান বি প্রস্তুত ছিল। এমন কী সেই ব্যাকআপেরও ব্যাকআপ তৈরি ছিল!”
এই মহাকাশযানের মোট তিনটি অংশ ছিল : একটি ল্যান্ডার মডিউল (এল এম), একটি প্রোপালশন মডিউল (পিএম) আর একটি রোভার।
বিক্রম নামে এই রোভারের নামকরণ করা হয়েছিল ভারতের প্রবাদপ্রতিম মহাকাশ বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের নামানুসারে। ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা বিক্রম সারাভাইকে ভারতের মহাকাশ চর্চার পথিকৃৎ বলেও গণ্য করা হয়।
মৃত্যুর বাহান্ন বছর বাদে সেই বিক্রম সারাভাইয়ের নামাঙ্কিত মুন রোভারই ভারতকে মহাকাশচর্চার ইতিহাসে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিল।
তথ্য সূত্র : আনন্দবাজারপত্রিকা, বিবিসি নিউজ বাংলা