রহিমা মাহমুত একজন বিখ্যাত লন্ডনভিত্তিক উইঘুর গায়িকা
রহিমা মাহমুত একজন বিখ্যাত লন্ডনভিত্তিক উইঘুর গায়িকা। যদিও তিনি চীনে তার বাড়ি ও পরিবার থেকে অনেক দূরে বসবাস করেন। তবে রহিমা তার গানের মাধমে উইঘুর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এর পাশাপাশি তিনি পরিচালনা করেন ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেসের যুক্তরাজ্য অফিস, যা হলো উইঘুরদের মানবাধিকার রক্ষায় একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠান।
রহিমা তার পরিবারকে শেষবার দেখেছিলেন ২০ বছর আগে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে নিজ শহর ঘুলজায়। তবে ২০১৭ সাল থেকে তিনি আর পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি। সংবাদমাধ্যমকে রহিমা বলেন, ‘২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আমার ভাইয়ের সাথে শেষবার কথা হয়েছিল। এরপর আর তাদের কাউকে কাছে পাওয়া হয়নি। আমার উদ্দেশ্যে বলা ভাইয়ের শেষ কথা ছিল, ‘আমাদেরকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দাও এবং আমরাও তোমাকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিচ্ছি’।’
পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে রহিমা তার পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। এমনকি ফোনেও যোগাযোগ করার সুযোগ নেই তার। তিনি আশা করেন যে, একদিন তাদের পুনর্মিলন ঘটবে।
চীনা সরকার উইঘুর সমাজের ওপর কড়া অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে নিজ ধর্মচর্চা থেকে, উইঘুর পোশাক পরা থেকে এবং উইঘুর ভাষায় কথা বলা থেকে বিরত রাখতে। অনেক উইঘুরকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে, তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তাদেরকে শোষণ করা হচ্ছে এবং তারা বসবাস করছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কড়া নজরদারির মধ্যে।
রহিমা বলেন, ‘চীনা সরকার উইঘুরদের চালচলন পুরোপুরি পাল্টে দিয়ে তাদেরকে চীনা হান জাতির সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করছে। আমরা উইঘুর জাতি, এটি আমাদের পরিচয় এবং আমরা চাই এটি ধরে রাখতে। উইঘুরদের কোনো স্বাধীনতা নেই এবং তাদের কেউ পারে না মুক্তভাবে এবং নিজস্ব উপায়ে নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চা করতে।’
তবে রহিমার অনেক মধুর স্মৃতিও আছে পরিবারের সঙ্গে। চীনের মাটিতে পরিবারের সঙ্গে ধর্মীয় উৎসব পালন করার স্মৃতি এখনো তাকে আল্পুত করে। দশ ভাইবোনের সঙ্গে একটি বড় পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে পারিবারিক মিলন মেলাগুলো রহিমার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী উইঘুর রান্নাবান্নার ছিল একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা।
রহিমা বলেন, ‘আশির দশকের দিকে একটি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর উইঘুরদেরকে তাদের ধর্মচর্চার অনুমতি দেওয়া হয় এবং একই অনুমতি দেওয়া হয় সব ধর্মকেই। আমার বাবা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং আমার মনে আছে যে কীভাবে রমজান মাসকে বছরের সেরা সময় মনে হতো। সেই সময় আমার ভাইয়েরা মসজিদ থেকে ফিরে আসার পর টেবিলগুলোকে সুসজ্জিত করা হতো নানা খাবার দিয়ে। সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতাম আমরা।’
আটত্রিশ বছর বয়সী আয়েশারও আছে চীনে তার উইঘুর পরিবারের সঙ্গে রমজান মাস পালনের মধুর স্মৃতি। যুক্তরাজ্য প্রবাসী আয়েশা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘উইঘুর সংস্কৃতিকে আমাদের শিশুদের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে টিকিয়ে রাখা আমাদের জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে চীনের বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে।’
প্রবল ইচ্ছা থাকার পরও আয়েশা ২০১৭ সালের পর চীনে বসবাসরত নিজ পরিবারকে দেখতে পারেননি। একই ভাগ্য হয়েছে আয়েশার সন্তানদেরও। তবে নিজের শৈশবকালের বিভিন্ন কাহিনি ও স্মৃতি সন্তানদেরকে শোনান আয়েশা। এভাবে তাদের উইঘুর সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। যা ছোটবেলায় তাকেও শিখিয়েছিলেন তারা বাবা-মা। প্রবাসে নিজের বাড়ির ডিজাইন করেছেন রমজান মাসে উইঘুরদের বিশেষ সাজসজ্জা এবং ঐতিহ্যবাহী উইঘুর খাবারের ছবি দিয়ে।
আয়েশা আরও বলেন, ‘আমাদের উইঘুর সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো ঐক্যবদ্ধভাবে নিজ সংস্কৃতিকে ধারণ করা এবং এটিকে টিকিয়ে রাখা। আমার মনে পড়ে যে, শৈশব কিংবা কৈশোরে পবিত্র রমজান মাসে আমরা কীভাবে নাভরার (একধরনের ড্রাম) শব্দে শেষরাতে জেগে উঠতাম। প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সঙ্গে আমরা খাবার ভাগাভাগি করতাম এবং বন্ধুদেরকে ইফতারের দাওয়াত দিতাম। কিন্তু বর্তমানে চীনে বসবাসরত উইঘুররা এটি করতে পারে না। এমনকি যারা উইঘুর ভাষা শেখায় কিংবা সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে তাদের অবস্থাও একই।’
রহিমা মাহমুত লন্ডনে বাস করছনে এখন। এখানে তিনি যুক্ত আছে নমাকাম মিউজিকের সঙ্গে। মধ্য এশিয়া থেকে আসা একটি মিউজিক দলের অংশ হতে পারা রহিমার জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল। এটি তাকে সুযোগ করে দিয়েছিল নিজের প্রকৃত জাতিগত পরিচয় নিয়ে গর্বিত হওয়ার। তিনি জানান, কীভাবে এই মাকাম মিউজিক এই সময়ে উইঘুরদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে তাদের লোকসংগীত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রক্রিয়াগুলোকে তুলে ধরতে। ‘মাকাম হলো মুখে গাওয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী সংগীত। যা বেদনা, সুখ এবং উইঘুরদেরকে প্রভাবিত করা ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে মানুষের স্বভাবজাত অনুভূতির গল্প ভাগাভাগি করে।
রহিমা আরও জানান, ‘আমি যেসব গান পরিবেশন করে যাচ্ছি সেগুলো হলো উইঘুর সংগীত ও লোকগান। যা এসেছে মূলত আবুজা অঞ্চল থেকে। যার সঙ্গে যুক্ত আছে কাশগড় ও আরও কিছু এলাকার গান। উইঘুরদের আছে সুফিজমের একটি দীর্ঘ ইতিহাস। এসব গান সুফি কায়দায় এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে এবং এগুলো অনেকটা জিকির অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার মতো।’
চীনে উইঘুর সংগীত পরিবেশন করা কিংবা যে কোনো উইঘুর সংস্কৃতির বিকাশে সহায়তা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যারা প্রকাশ্যে এসব করে তারা হয় জেলে যায় অথবা তাদের পাঠানো হয় কনসেেেন্ট্রশন ক্যাম্পে। রহিমা বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ লোকগানই ভালোবাসা, ইচ্ছা প্রকাশ, বেদনা ও সুখ নিয়ে। আমার গাওয়া গানের অনেকগুলোই ইচ্ছার প্রকাশ নিয়ে।’ তার একটি গানের দুটি লাইন-
‘আমরা একটি জায়গা পেয়েছি পর্বতমালায় আর
আমাদের স্বর্গকে হারিয়েছি বাগানসমূহে।’
রহিমার গানের কথামালা এমনই। এই বিশেষ গানটি তার মাতৃভূমিকে কেন্দ্র করেই যেখানে জায়গাটিকে বর্ণনা করা হয়েছে একটি আকর্ষণীয় বাগান হিসেবে আর রহিমা সেখান থেকে অনেক দূরে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন।
গান পরিবেশনের জন্য রহিমা ভ্রমণ করেছেন ইতালি, আয়ারল্যান্ড, জার্মানির বার্লিন ও মিউনিখ, সুইডেন, নরওয়ে, কানাডা, তাইওয়ানসহ বিভিন্ন জায়গায়। নিজেদের সম্পর্কে বৃহত্তর সমাজের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। কারণ এই সমাজের অনেকেই জানে না যে চীনের জিনজিয়াংয়ে উইঘুর জাতি কী কঠিন সংগ্রাম করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
রহিমা বিশ্বাস করেন গান একটি শক্তিশালী মাধ্যম। যখন এটি ব্যবহৃত হয় কোনো কিছু জোরালোভাবে বলার জন্য। তিনি আরও বলেন, যখন আমরা কনসার্টে অংশ নিই তখন আমাদের পরিবেশিত গানের একটি ব্যাখ্যা দিই এবং সেই পটভূমি তুলে ধরি যে, আমরা কোথা থেকে এসেছি। এটিও বুঝিয়ে দেই যে আমরা উইঘুর সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও গানকে আগামী দিনের জন্য সংরক্ষণ করতে চাই।’
উইঘুরদের সম্পর্কে এখনকার কাহিনিগুলো মূলত শোষণ ও বঞ্চনার বিবরণকেই তুলে ধরে তবে এই জাতিটিরও আছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যাকে চীন সরকার এখন দমিয়ে রেখেছে। কিন্তু সেই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এখন পর্যন্ত টিকে আছে তাদের মাধ্যমে যারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেদের আত্মপরিচয়কে সংরক্ষণ করে যাওয়ার।
সূত্র: দ্য নিউ আরব/ জাগোনিউজ২৪ ডটকম