জিও পলিটিক্স (Geopolitics) কি ।। বাংলাদেশ কী ভাবে জিও পলিটিক্সের শিকার
রুহুল কুদ্দুস টিটো
জিওপলিটিক্স শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন সুইডিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুডল্ফ কেজেলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপে জিওপলিটিক্স শব্দটির ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার শুরু হয়।
ভূরাজনীতির ইংরেজী শব্দ হচ্ছে- Geo Politikos- Geo অর্থ ভূ আর Politikos হচ্ছে রাষ্ট্র সম্পর্কিত। ভূগোল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরস্পরকে সম্পর্কযুক্ত করে রাজনৈতিক শক্তি এবং ভৌগলিক কিছু উপাদানের সমন্বিত কৌশলই ভূরাজনীতির মূল কথা।
কোন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সমস্যাবলির সমাধানের চেষ্টায় রাজনৈতিক ভূগোলের সফল প্রয়োগকেই ভূরাজনীতি হিসেবে গণ্য করা হয়। ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক কৌশলগত নীতি প্রণয়ন হচ্ছে ভূরাজনীতি।
ভূরাজনীতির বিভিন্ন রকমের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। তাদের প্রণীত সংজ্ঞা অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভূরাজনীতিকে একেক দেশ একেকভাবে গতিশীল করছে। ভূরাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভূরাজনৈতিক কৌশলের ওপরই কোনো দেশের অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে উঠে। ভূরাজনীতির যেসব উপাদান রয়েছে- তার যথার্থ ব্যবহারে ও সংরক্ষণে ব্যর্থ হলেই সর্বনাশ। এ উপাদানগুলো হচ্ছে পররাষ্ট্র সম্পর্ক, সমাজের অবস্থান, সম্পদের অবস্থান, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদ, ধর্মের ব্যবহারিক বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ এবং রাষ্ট্রের জনগণ। পৃথিবীর মানচিত্রে কোনো রাষ্ট্রের ভৌগলিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে, সে দেশের ভূরাজনীতি।
জিও পলিটিক্স (Geopolitics) হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি শাখা যেখানে রাষ্ট্র বা অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ, এবং সামরিক ক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রভাব এবং ক্ষমতা বিশ্লেষণ করা হয়। এটি বিশেষ করে দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে তাদের সম্পর্ক, অর্থনীতি, এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেয়।
জিও পলিটিক্সের মধ্যে দেশগুলোর মধ্যকার শক্তি ভারসাম্য, সামরিক উপস্থিতি, বাণিজ্য পথ, প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন তেল, গ্যাস, এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্যও অন্তর্ভুক্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের তেলের জন্য এবং দক্ষিণ চীন সাগর তাদের কৌশলগত বাণিজ্য পথের জন্য গুরুত্ব পায়।
জিও পলিটিক্সের মধ্যে দেশগুলোর মধ্যকার শক্তি ভারসাম্য, সামরিক উপস্থিতি, বাণিজ্য পথ, প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন তেল, গ্যাস, এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্যও অন্তর্ভুক্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের তেলের জন্য এবং দক্ষিণ চীন সাগর তাদের কৌশলগত বাণিজ্য পথের জন্য গুরুত্ব পায়।
জিও পলিটিক্স হলো বিশ্ব রাজনীতি এবং ক্ষমতার যে একটি অংশ যা ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ, সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক অবস্থা, এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের মাধ্যমে গঠিত হয়। এটি বিশেষত দেশগুলোর ভূখণ্ডগত অবস্থান এবং এর মাধ্যমে তাদের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাবকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
জিও পলিটিক্সের মূল উপাদান সমূহ:
১.ভৌগোলিক অবস্থান: কোনো দেশের অবস্থান তার জিও পলিটিকাল প্রভাবকে বিশালভাবে প্রভাবিত করে। যেমন, রাশিয়া ও চীনের মতো বৃহৎ দেশগুলো ভৌগোলিক দিক থেকে অন্যান্য দেশগুলোর ওপর কৌশলগত সুবিধা ভোগ করে।
২. প্রাকৃতিক সম্পদ: তেল, গ্যাস, খনিজ এবং পানি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলো রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্ষমতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য তাদের তেল উৎপাদনের জন্য বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ।
৩. সামরিক শক্তি: দেশের সামরিক শক্তি তাদের আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জিও পলিটিক্সে সামরিক উপস্থিতি ও সামরিক চুক্তিগুলি ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৪.অর্থনৈতিক ক্ষমতা: শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থা রাষ্ট্রগুলোর জিও পলিটিকাল অবস্থানকে সমর্থন করে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের অর্থনীতির মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে।
৫.আদর্শ এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব: কিছু দেশ তাদের সংস্কৃতি, আদর্শ ও নীতিমালার মাধ্যমে অন্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। যেমন, পশ্চিমা দেশগুলো গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মাধ্যমে জিও পলিটিকাল প্রভাব সৃষ্টি করে।
বর্তমান বিশ্বের কয়েকটি জিও পলিটিকাল উদাহরণ:
- যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা: বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং সামরিক শক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যকার প্রতিযোগিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ জিও পলিটিকাল বিষয়।
- রাশিয়া ও ইউক্রেন সংঘাত: এই সংঘাতের মূল কারণ আঞ্চলিক আধিপত্য, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যাটো’র প্রসার।
- মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব: তেল এবং গ্যাসের জন্য মধ্যপ্রাচ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ এই অঞ্চলে তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা করে।
জিও পলিটিক্স সবসময় পরিবর্তনশীল এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন কৌশলগত সিদ্ধান্ত এবং প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে এটি গঠিত হয়।
বর্তমান বিশ্বের কয়েকটি জিও পলিটিক্সের শিকার দেশ কোন গুলো
৯. লিবিয়া-সংঘাত: ২০১১ সালে গাদ্দাফির পতনের পর থেকে লিবিয়া রাজনৈতিকভাবে ভাঙনের মধ্যে রয়েছে, যেখানে উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং সরকার লড়াই করছে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: লিবিয়ার তেল সম্পদের জন্য এবং ভৌগোলিক কারণে বিভিন্ন শক্তি এখানে প্রভাব রাখতে চায়। তুরস্ক, মিসর, রাশিয়া এবং ইউরোপীয় দেশগুলো এখানে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা এবং প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
১০. লেবানন সংঘাত: লেবানন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে, যেখানে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। এতে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত ও অন্যান্য দেশগুলোর প্রভাবশালী গোষ্ঠীর শক্তি বাড়ানোর প্রচেষ্টা জড়িত।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: এই দেশটির কৌশলগত অবস্থান এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি ভারসাম্যের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইরান, সৌদি আরব, এবং যুক্তরাষ্ট্র এখানে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়।
১১. সুদান ও দক্ষিণ সুদান-সংঘাত: দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতা লাভ করার পরও উভয় দেশের মধ্যে আভ্যন্তরীণ সংঘাত চলছে, যা প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সীমান্তের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত তেল, এখানে চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর কৌশলগত আগ্রহকে বাড়িয়ে তুলেছে।
১২. সুদূর মেরু অঞ্চল (আর্কটিক)-সংঘাত: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্কটিকের বরফ গলছে এবং নতুন বাণিজ্য পথ ও প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এই অঞ্চলকে ঘিরে রাশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং নর্ডিক দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: আর্কটিক অঞ্চল প্রাকৃতিক সম্পদ (তেল, গ্যাস, খনিজ) এবং পরিবহন রুটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, ফলে শক্তিশালী দেশগুলো এই অঞ্চলের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে।
১৩. মায়ানমার (বার্মা)-সংঘাত: মায়ানমারের সামরিক সরকার এবং জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাত চলমান, এবং চীন ও ভারত উভয় দেশ এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: চীন এবং ভারতের মধ্যে মায়ানমার একটি কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। এছাড়াও, পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে মায়ানমারের সামরিক সরকারকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে।
১৪. নাইজেরিয়া-সংঘাত : আফ্রিকার বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে নাইজেরিয়া জঙ্গি গোষ্ঠী এবং স্থানীয় বিদ্রোহীদের হামলার শিকার। এই অঞ্চলে বোকো হারামের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর প্রভাবও উল্লেখযোগ্য।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: নাইজেরিয়ার তেল এবং গ্যাস খাত বিদেশী শক্তিগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো এখানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, যেখানে চীনও আফ্রিকায় তার কৌশলগত অংশীদারিত্ব বাড়াচ্ছে।
১৫. কাশ্মির (ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে)-সংঘাত: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মির অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছে, যা এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতার প্রশ্ন তুলে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: ভারত ও পাকিস্তান উভয় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ায় কাশ্মির সমস্যা বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, এবং রাশিয়া এই অঞ্চলের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে এবং নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী অবস্থান নিচ্ছে।
১৬. কোরাল সাগর ও দক্ষিণ চীন সাগর-সংঘাত: দক্ষিণ চীন সাগরে চীন এবং অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশের মধ্যে ভূখণ্ডগত দাবি নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: এই অঞ্চলটি বাণিজ্য পথের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মৎস্য ও খনিজ সম্পদের জন্য প্রভাবশালী দেশগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রে। যুক্তরাষ্ট্র এখানে তার মিত্রদের সমর্থন দিয়ে চীনের প্রভাব রোধ করতে চাচ্ছে।
১৭. ইথিওপিয়া (টাইগ্রে অঞ্চল)-সংঘাত: ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলে সাম্প্রতিক গৃহযুদ্ধ এবং এই অঞ্চলে মানবিক সংকট দেশের স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করছে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব : সুদানের সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে মিশর, সুদান এবং ইথিওপিয়ার জলসম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সমাজ এই সংকট নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
১৮. কিউবা- সংঘাত: কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী হওয়ার কারণে বহু দশক ধরে জিও পলিটিকাল চাপের মধ্যে রয়েছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং ভিন্নধর্মী আদর্শের কারণে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।
আন্তর্জাতিক প্রভাব: যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিউবার দ্বন্দ্ব দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা প্রভাবিত করে। এছাড়া রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলো তাদের সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিউবার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চায়।
এই দেশগুলো বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির কৌশলগত স্বার্থের কারণে জিও পলিটিকসের শিকার হচ্ছে। এসব অঞ্চলে সংঘাত এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন প্রায়ই বিশ্ব নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।উদাহরণ
বর্তমান বিশ্বের কয়েকটি জিও পলিটিকাল উদাহরণ:
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা : বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং সামরিক শক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যকার প্রতিযোগিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ জিও পলিটিকাল বিষয়।
রাশিয়া ও ইউক্রেন সংঘাত: এই সংঘাতের মূল কারণ আঞ্চলিক আধিপত্য, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যাটো’র প্রসার।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব: তেল এবং গ্যাসের জন্য মধ্যপ্রাচ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশ এই অঞ্চলে তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা করে।
জিও পলিটিক্স সবসময় পরিবর্তনশীল এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন কৌশলগত সিদ্ধান্ত এবং প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে এটি গঠিত হয়।
বাংলাদেশও জিও পলিটিক্সের শিকার, কারণ তার কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা এ অঞ্চলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির আগ্রহের কারণ হয়েছে।
বাংলাদেশ কী ভাবে জিও পলিটিক্সের শিকার:
১.ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রতিবেশী সম্পর্ক: বাংলাদেশ এমন একটি অবস্থানে রয়েছে যেখানে ভারত, চীন, এবং মিয়ানমারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশ রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এবং চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক দিন দিন গভীর হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ার ফলে জিও পলিটিকাল চাপ অনুভূত হচ্ছে।
২. বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI):চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (BRI) বাংলাদেশ অংশ নিয়েছে, যার ফলে চীন বাংলাদেশের বড় ধরনের অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। চীনের বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সহায়তা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ হলেও, এর ফলে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
৩.ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা:ভারত ও চীনের মধ্যে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে বাংলাদেশ প্রায়ই এই প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। ভারত বাংলাদেশের অনেক বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হলেও, চীনেরও অনেক অবকাঠামো প্রকল্পে বাংলাদেশে প্রভাব রয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ওপর কিছু জিও পলিটিকাল চাপ রয়েছে, যাতে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না করে।
৪.রোহিঙ্গা সংকট: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এই সংকট বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ মিয়ানমার, চীন, ভারত, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় এই সংকট সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এই ইস্যুতে চীন ও ভারতের আলাদা অবস্থান রয়েছে, যা জিও পলিটিকাল চাপ তৈরি করে।
৫.ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত ভূমিকা:ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশের অবস্থান এটিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, এবং জাপানের মতো শক্তিশালী দেশগুলো এই অঞ্চলে নিজেদের নৌবাহিনী এবং বাণিজ্যিক প্রভাব বাড়াতে আগ্রহী, যা বাংলাদেশের ওপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করে।
৬.কোয়াড (QUAD) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল: ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব রোধ করতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, এবং অস্ট্রেলিয়া মিলে কোয়াড গঠন করেছে। বাংলাদেশকে কোয়াডের অংশীদার করার প্রচেষ্টা চলছে, যা চীনের জন্য উদ্বেগের কারণ। এ ধরনের সংস্থায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে।
৭. ক্লাইমেট চেঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য: জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে। তাই, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সাহায্য করছে। কিন্তু এই সাহায্য ও প্রকল্পের সঙ্গে অনেক সময় কৌশলগত স্বার্থ যুক্ত থাকে, যা বাংলাদেশের জন্য জিও পলিটিকাল চাপ তৈরি করে।
৮.তিস্তা এবং অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি ভাগাভাগি: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তা নদী এবং অন্যান্য নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। এই ইস্যুতে জিও পলিটিকাল চাপ অনুভূত হয়, কারণ এটি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের পানি নিরাপত্তার ওপর বড় প্রভাব ফেলে।
সারসংক্ষেপ: বাংলাদেশ একটি ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করছে যাতে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে এবং একইসঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সহায়তাও গ্রহণ করা যায়। সমকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত যদি এক ও অভিন্ন দৃষ্টিতে এগুতো না পারে, তবে সংকট অনিবার্য। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে, তবে বৃহৎ শক্তিগুলোর কৌশলগত স্বার্থ ও চাপের কারণে এটি সবসময় সহজ নয়।
তধ্যসূত্র: ChatGPT, উইকিপিডিয়া