রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আলাপচারিতা Ruhul Quddus Tito
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে।
তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই পরিবারের পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে ব্যবসায়ের সূত্রে কলকাতায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের চেষ্টায় এ বংশের জমিদারি এবং ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায়। ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে লালিত এবং আত্মপ্রতিষ্ঠিত দ্বারকানাথ ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি জনহিতকর কাজেও সাফল্য অর্জন করেন। উনিশ শতকের বাঙালির নবজাগরণ এবং ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। এ যুগের অন্যতম সমাজ-সংস্কারক এবং একেশ্বরবাদের প্রবক্তা রামমোহন রায় ছিলেন দ্বারকানাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রামমোহন রায়ের আদর্শ দ্বারকানাথ, তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ এবং দৌহিত্র রবীন্দ্রনাথ ওপর এক অভাবনীয় প্রভাব বিস্তার করে।
নবজাগ্রত বাঙালি সমাজের পুরোধা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু কলেজে শিক্ষালাভ করেন। দ্বারকানাথ যখন ব্যবসায় এবং জমিদারি পরিচালনায় ব্যাপৃত, সে সময় পুত্র দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে সঞ্চারিত হয় আধ্যাত্মিক চেতনা। ঈশ্বর-ব্যাকুলতায় তিনি ইউরোপীয় ও ভারতীয় দর্শনের প্রতি নিবিষ্ট হন। অবশেষে উপনিষদ চর্চার মাধ্যমে তাঁর আত্মা স্থিত হয় এবং এক বিশুদ্ধ সত্যের উপলব্ধিতে তাঁর মধ্যে জেগে ওঠে আত্মপ্রত্যয়। দেবেন্দ্রনাথের এই বৈশিষ্ট্যই আকৃষ্ট করে পুত্র রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর সমগ্র মনোজগতে এবং ব্যবহারিক জীবনে পিতার প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। পিতার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন একজন আদর্শ ব্যক্তিকে, যিনি জাগতিক বিষয়ে নিষ্ঠাবান অথচ নিরাসক্ত, প্রখর যুক্তিবাদী কিন্তু হূদয়বান।
সততায়, ধর্মবোধে, ঋষিসুলভ চারিত্রিক গুণে এবং উদার আভিজাত্যে দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন অনন্য। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবন ও সাহিত্যসাধনায় দেবেন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল ব্যাপক। সে যুগে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল ভাবধারার অন্যতম পীঠস্থান। একদিকে দেবেন্দ্রনাথের ধর্মানুশীলন এবং তাঁর পরিবারের স্বাদেশিকতা, সঙ্গীত-সাহিত্য ও শিল্পচর্চার পরিশীলিত আবহ, অন্যদিকে দেশের নানাবিধ পরিবর্তন রবীন্দ্রনাথ জীবনে গভীর তাৎপর্য বয়ে আনে।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ও কুষ্টিয়া শিলাইদহের কুঠিবাড়ি
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মভিটা কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত রবীন্দ্র মিউজিয়ামে গেলে।
সাহিত্যচর্চা বা লেখার ঘর, গান শোনার ঘর ইত্যাদি আলাদা আলাদা কক্ষ রয়েছে। গান লেখার পাশাপাশি গান গাইবার ঘরও আছে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
১৯৪১ সালের ৩০ জুলাই কবিগুরু তাঁর শেষ কবিতা, ‘তোমার সৃষ্টির পথ’র ডিক্টেশন দিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। এর মাত্র সাত দিন পর ২২ শ্রাবণ তিনি মারা যান।
রবীন্দ্র কুঠিবাড়ী ঐতিহাসিক এক কুমারখালী উপজেলায় অবস্থিত। এখানে আছে রবীন্দ্র কুঠিবাড়ী; শিলাইদহে।
সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা, লালনের আখড়া। আছে কাঙাল হরিনাথের বাড়ি ও মিউজিয়াম। সেখানে আছে ঐতিহাসিক কিছু সাক্ষী।
কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৫.০৪ কিলোমিটারের মধ্যেই পড়বে। সবগুলো একই দিকে, একই রাস্তায়। লোকাল পথ মাড়িয়ে যেতে হবে।
কুঠিবাড়ী: শিলাইদহ কুঠিবাড়ী কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে কুমারখালী উপজেলার অন্তর্গত শিলাইদহ ইউনিয়নের খোরশেদপুরে অবস্থিত। রবিঠাকুর বাংলাদেশে যত স্থানে পদচারণা করেছেন, তার মধ্যে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে।
গড়াই নদীর তীরে অবস্থিত এ শিলাইদহে কবিগুরু অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি পান। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে জমিদার হয়ে আসেন।
এখানে তিনি ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারি করেন। জানা যায়, এ সময় এখানে বসেই তিনি রচনা করেন তাঁর সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা।
জাদুঘর: ১৯৫৮ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ব্যবস্থাপনায় কুঠিবাড়ীটি সংরক্ষিত আছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবির বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে একে জাদুঘর হিসেবে রূপান্তর করা হয়। ভবনটি এখন দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত। জাদুঘরের নিচ ও দ্বিতীয় তলায় ১৬টি কক্ষেই কবি রবীন্দ্রনাথ, শিল্পী রবীন্দ্রনাথ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, কৃষকবন্ধু রবীন্দ্রনাথ অর্থাৎ নানা বয়সের বিচিত্র রবীন্দ্রনাথের ছবি। তা ছাড়া রয়েছে শিল্পকর্ম এবং তাঁর ব্যবহার্য আসবাবপত্র। আছে চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটি স্পিডবোট, পন্টুন, আট বেহারা পালকি, কাঠের চেয়ার, টি-টেবিল, সোফাসেট, আরাম চেয়ার, পালংক ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস। রবিঠাকুর ব্যবহৃত পাতকুয়া ও চৌবাচ্চাও আছে। শিশুদের জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে সামান্য। পুকুরের কাছে শিশু কর্ণারে।
জাদুঘরটি তিন তলা। উপরের তলায় সামান্য স্পেস। প্রবেশ নিষিদ্ধ। ২০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়তে পারবেন। রবিঠাকুরের হাতের লেখা পাণ্ডুলপি, চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। ব্যবহৃত খাট, আলমারি, লোহার সিন্দুক, নৌকা, পারিবারিক দুর্লভ ছবির সমাহার। মিউজিয়াম থেকে পুকুর ঘাটে যাওয়ার পথে চোখে পড়বে কবির ব্যবহৃত (স্মারক) পাতকুয়া ও চৌবাচ্চা। ফুল আর নান্দনিক ফুটপাত দিয়ে পুকুর ঘাটে বিশ্রাম নিন। দেখুন বজরার রেপ্লিকা। বিশ্রামের সময় অস্থায়ী মঞ্চ (মাটিতে) থেকে রবীন্দ্রসুর ভেসে আসবে। হারিয়ে যাবেন আনমনে।
এখানে একদল গায়ক সব সময় রবীন্দ্রসংগীত গেয়েই চলেন। পর্যটকের চাহিদা মোতাবেক গানও গান তারা। পাশেই রয়েছে নান্দনিক ফুলের বাগান। এ পথ দিয়ে মিউজিয়াম থেকে পুকুর ঘাটে যেতে হয়। মাঝে পড়বে রবির ব্যবহৃত চৌবাচ্চা ও রান্নাঘর। মূল গেট থেকেই মিউজিয়ামে ঢুকতে হয়। এখানে বিখ্যাত কুলপি মালাই পাওয়া যায়। এখান থেকে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘোরাঘুরিও করা যায়।
এখানে গীতাঞ্জলি ও সোনার তরী নামে রেস্ট হাউস আছে। বড় আকারে আবাসন ব্যবস্থা নির্মাণাধীন। একটি বড় মিউজিয়ামও তৈরি হচ্ছে। মূল গেটের পাশের ফাঁকা জায়গায়। সেখানে বৈশাখে প্রতিবছর মেলা হয়। এবার করোনাভাইরাসের কারণে মেলা হচ্ছে না।
যাবেন যেভাবে: বাংলাদেশের যেকোনো স্থান থেকে বাসে যেতে হবে কুষ্টিয়ায়। অথবা ঢাকা থেকে ট্রেনে যাওয়া যায় ভেড়ামারা বা পোড়াদহ স্টেশনে। তারপর অটো বা লোকাল বাসে কুষ্টিয়ায়। এরপর লোকাল বাস, অটো বা প্রাইভেটকারে আলাউদ্দিন নগর হয়ে কুমারখালীর শিলাইদহে। আর গাবতলী থেকে বেশকিছু পরিবহন বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে অথবা দৌলতদিয়ার ঘাট হয়ে নিয়মিত যাতায়াত করে।
থাকা ও খাওয়া: থাকার জন্য জেলা পরিষদ ডাকবাংলো আছে, আছে রেস্ট হাউস, লাইব্রেরি রুম। একটু দূরেই রবীন্দ্রনাথের কাচারি বাড়ি। কুষ্টিয়া শহরে থাকা-খাওয়ার জন্য কোনো টেনশন নেই। বাজেটের মধ্যেই হোটেল খুঁজে পাবেন।