ডেঙ্গু জ্বর একটি সাধারণ রোগ। কিন্তু অবহেলা করলে এই রোগ মারাত্মক হতে পারে। ডেঙ্গুর যে নতুন উপসর্গ এগুলোর সাথে (মানুষ) অপরিচিত বা তারা এই উপসর্গ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত নন।
রুহুল কুদ্দুস টিটো
ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ, যা সাধারণত স্ত্রী মশা থেকে মানবদেহে বাহিত হয়। চার ধরনের ভাইরাস এই সংক্রমণের জন্য দায়ী। প্রধানত বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরের মতো গ্রীষ্ণমণ্ডলীয় দেশ বা অঞ্চলগুলোতে ভাইরাসজনিত এই রোগের প্রকোপ বেশি। যে অঞ্চলের জলবায়ুতে গ্রীষ্মকালের প্রভাব বেশি, সে অঞ্চলকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল বলে।
এই দেশ বা অঞ্চলসমূহের শহর এবং উপশহরগুলোতেই ডেঙ্গু বেশি সংক্রমিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বর্তমানে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০-৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এমন কিছু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে যা ডেঙ্গুর প্রথাগত উপসর্গ নয়। চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু হয়েছে সেটি বুঝতে না পারার কারণে হাসপাতালে যেতে দেরি করছেন রোগীরা। ফলে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসলেও অনেকেই মারা যাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৫০ জন। এদের ৮০ শতাংশই হাসপাতালে ভর্তির এক থেকে তিন দিনের মধ্যে মারা গেছেন। বাকিদের মধ্যে ১৪ শতাংশ ৪-১০ দিনের মধ্যে এবং ৬ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির ১১-৩০ দিনের মধ্যে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে যাওয়াটাই ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুর একটি বড় কারণ।
এ বিষয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান বলেন, “এর বড় একটি কারণ হলো ডেঙ্গুর যে নতুন উপসর্গ এগুলোর সাথে (মানুষ) অপরিচিত বা তারা এই উপসর্গ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত নন। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তারা যাখন হাসপাতালে পৌঁছাচ্ছেন তখন অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ডেঙ্গু মৌসুম চলতে থাকার কারণে, বর্তমান সময়ে যে কারো শরীরে অস্বাভাবিক কোন উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে তার একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো উচিত।
সাধারণত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে জ্বর, প্রচন্ড মাথাব্যথা, শরীর ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
এবার এ ধরণের উপসর্গ নিয়েও রোগীরা হাসপাতালে যাচ্ছেন। তবে এদের সংখ্যা কম বলে জানান মি. নিয়াতুজ্জামান।
এর তুলনায় এবার হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছেন তাদের মধ্যে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা বেশি।
“তারা হয়তো আগে একটি ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছিল। এখন তারা হয়তো অন্য একটি ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত, ফলে যে উপসর্গগুলো নিয়ে তারা আসছেন – সেগুলো প্রথাগত ডেঙ্গু উপসর্গের মতো নয়।”
একে বলা হচ্ছে, “কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বা এক্সটেনডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম।”এই উপসর্গগুলো কোনভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই।
পরিবর্তিত উপসর্গ
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান যেসব উপসর্গের কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো হচ্ছে,
১. দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া: তিন দিন বা চার দিন ধরে ডায়রিয়ায় ভুগছেন কিন্তু সেটি ভাল হচ্ছে না। এমন উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। বর্তমানে ডেঙ্গুর নতুন যেসব উপসর্গ দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে এটাই বেশ উল্লেখযোগ্য। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর যে ডায়ারিয়া হয় তার সাথে সাধারণ ডায়রিয়ার কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। যে কারণে ডায়রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
২. জ্বর না থাকা: মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান বলেন, হাসপাতালে এমন সব ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন যারা এ মৌসুমে জ্বরে আক্রান্তই হননি। অর্থাৎ জ্বর না হলেও পরীক্ষার পর তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত বলে জানা গেছে। এছাড়া গরমের কারণে অনেকে হয়তো দুয়েক দিন হালকা জ্বরে ভুগেছেন কিন্তু সেটি পাত্তা দেননি। কিন্তু পরে সেটি মারাত্মক ডেঙ্গুতে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, তার হাসপাতালে এই মৌসুমের শুরুতে যেসব রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্তত দুই জনের কোন জ্বর ছিল না। তারা দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে পরীক্ষা করে তাদের মধ্যে ডেঙ্গু ধরা পড়ে।
৩. স্থায়ী বমি: কয়েক দিন জ্বর হওয়ার পর বমি শুরু হয় এবং এক বার বমি শুরু হলে সেটি আর কমে না।
৪. প্রচণ্ড মস্তিস্কে প্রদাহ: এই লক্ষণ অনেকটা মেনিনজাইটিস এর সমস্যার মতোই। এতে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা দেখা দেয়। চিকিৎসক মি. নিয়াতুজ্জামান বলেন, অল্প জ্বরের পর কারো যদি প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকে, ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, হাত-পা শক্ত হয়ে যায় কিংবা প্রচণ্ড খিঁচুনি দেখা দেয় – তাহলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো উচিত। এছাড়া যেকোন ধরণের মাথার প্রদাহ হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
৫. হাত-পা ফুলে যাওয়া।
৬. শরীরের বিভিন্ন জায়গায় – বিশেষ করে বুকে এবং পেটে যদি পানি জমে যায় – তাহলে দেরি না করে হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এই লক্ষণটি এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
৭. অসহ্য রকমের পেট ব্যথা।
মি. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গুর এসব পরিবর্তিত উপসর্গ একটি একটি করেও আসতে পারে। আবার বেশ কয়েকটি উপসর্গ এক সাথেও দেখা দিতে পারে। এটা নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর বা ডেঙ্গু কোন পর্যায়ে রয়েছে সেটির উপর।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-(সিডিসি)এর তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুর মোট তিনটি পর্যায় আছে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ফেব্রিল ফেইজ বা জ্বর পর্যায়, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ক্রিটিক্যাল ফেইজ বা গুরুতর পর্যায় এবং তৃতীয়টি হচ্ছে কনভালেসেন্ট ফেইজ বা নিরাময় পর্যায়।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ নিয়াতুজ্জামান বলেন, যত খারাপ রোগী আসে তাদের বেশিরভাগই ক্রিটিক্যাল ফেইজ বা গুরুতর পর্যায়ে চলে যাওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হতে আসে।
এ পর্যায়ের অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, কারো জ্বর এসে সেটি কমে যাওয়ার পর বমি শুরু হয়। কিন্তু এই বমি কমে না। অনেকের রক্তচাপ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু সে বুঝতেও পারে না যে, তার রক্তচাপ এতোটা কমে গিয়েছে।
এ পর্যায়ে যদি একটি বা দুটি উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যায় তাহলে তার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু যখন অনেকগুলো উপসর্গ এক সাথে থাকে তখন তাকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয়, মাল্টি-অরগান ডিসফাংশন সিনড্রোম। অর্থাৎ তার দেহের একাধিক অঙ্গ তখন আক্রান্ত হয় এবং তাদের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়।
“একাধিক অঙ্গ কাজ করছে না এই ধরণের রোগী আমরা প্রচুর পাচ্ছি। ফলে এই ধরণের রোগীদের আমাদের আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।”
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চিকিৎসকদের কাছে যে নীতিমালা দেয়া হয়েছে সেখানে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে যে, প্রথম বারের তুলনায় দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্তদের উপসর্গ প্রথাগত উপসর্গের তুলনায় ভিন্ন হতে পারে।
সে কারণে এ ধরণের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের ডেঙ্গু পরীক্ষার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
ডেঙ্গু মোকাবিলার মূল আলোচনা শহরকেন্দ্রিক
ডেঙ্গু মোকাবিলার মূল আলোচনা শহরকেন্দ্রিক, মূলত রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে। বাস্তবে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বেশি। রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকার বাইরের বাস্তব পরিস্থিতির কোনো চিত্র কারও জানা নেই।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গতকাল রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) যৌথভাবে আয়োজিত এক বৈঠকে এই বক্তব্য উঠে আসে।
বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঘাটতির নানা দিক তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে গ্রামে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ঢাকার বাইরে ভিন্ন ধরনের মশায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
ডেঙ্গু মোকাবিলার মূল আলোচনা শহরকেন্দ্রিক, মূলত রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে। বাস্তবে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বেশি। রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকার বাইরের বাস্তব পরিস্থিতির কোনো চিত্র কারও জানা নেই।
এ বছর ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ কোন ধরনের মশায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, তা আমরা জানি না।–অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা
ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গতকাল রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) যৌথভাবে আয়োজিত এক বৈঠকে এই বক্তব্য উঠে আসে।
বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঘাটতির নানা দিক তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে গ্রামে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ঢাকার বাইরে ভিন্ন ধরনের মশায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম গণমাধ্যমকে জানায়, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত) দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ বছর মোট ৫৪৮ জনের মৃত্যু হলো। এর মধ্যে ঢাকার শহরের হাসপাতালে মারা গেছেন ৪০৪ জন এবং ঢাকা শহরের বাইরে মারা গেছেন ১৪৪ জন।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে নতুন ২ হাজার ৩২৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৯২০ জন এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৪০৭ জন রোগী।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, দেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫১১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন ৬০ হাজার ১০২ জন এবং ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৫৪ হাজার ৪০৯ জন। অর্থাৎ ঢাকার বাইরে রোগী বেশি। রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু এত রোগী এই প্রথম দেখা গেল।
অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘এ বছর ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ কোন ধরনের মশায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, তা আমরা জানি না।’ তিনি আরও বলেন, শহরের মানুষকে পানি জমিয়ে রাখতে নিষেধ করা হয়।
মশার প্রাণরাসায়নিক চরিত্র এবং মশার আচরণগত পরিবর্তন কী হয়েছে, তা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হওয়া দরকার।-স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান মো. গোলাম ছারোয়ার
ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু জ্বর কি?
উপক্রান্তিয় এবং ক্রান্তীয় অঞ্চলের গ্রীষ্ম-প্রধান দেশে ডেঙ্গু এবং ডেঙ্গু জ্বর একটি অত্যন্ত সাধারণ ভেক্টর-বাহিত ভাইরাসঘটিত রোগ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। ভারতবর্ষে প্রধানত প্রাক-গ্রীষ্ম এবং বর্ষা সময় এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ডেঙ্গু সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি থাকে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত যায়। এপ্রিল মাসে এই হাড় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। জুন-জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সাধারণত হ্রাস পেতে দেখা যায়।
ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অংশেও এর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে। সময় এবং অঞ্চল-বিশেষে এই রোগ মহামারির আকারও ধারণ করে। বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায়, এবং দেরিতে চিকিৎসার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের কোন বিশেষ লক্ষণ দেখা নাও যেতে পারে। সঠিক চিকিৎসায় বাড়ি তে থেকেই এই রোগের নিরাময় করা সম্ভব। শুধুমাত্র বিশেষ কিছু ক্ষেত্রেই রোগীকে হসপিটালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। সেই ক্ষেত্রেও 1–2 সপ্তাহের মধ্যে রোগী ভাল হয়ে যাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা থাকে। এই রোগ সম্বন্ধে জনমানসে সচেতনতা বৃদ্ধি ভীষণ জরুরী। সামান্য কিছু উপায় মেনে চললে ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করেতে পারি। এই রোগ লোকালয়ে ছড়িয়ে পরার হাত থেকে সহজেই নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
ডেঙ্গু (DENG-gey) জ্বর হল একটি মশা-বাহিত ভাইরাস-ঘটিত রোগ। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে প্রথমবার ডেঙ্গু-তে আক্রান্ত রোগীর বিশেষ কোন উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায় না। শুধু অল্প কিছু ক্ষেত্রেই রোগের প্রভাব গভীর হয়। ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গ গুলি হোল –
- উচ্চ জ্বর (40°C/104°F)
- তীব্র মাথার যন্ত্রণা
- চোখের পিছনে ব্যথার অনুভূতি
- মাংসপেশি এবং অস্থি সন্ধি (bone) তে যন্ত্রণা
- বমিভাব
- মাথাঘোরা
- গ্রন্থি ফুলে যাওয়া
- ত্বকে বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি
এই উপসর্গ গুলি রোগ সংক্রমণের 4 থেকে 10 দিনের মধ্যে দেখা দেয়। সাধারণত 2 থেকে 7 দিন পর্যন্ত উপসর্গ স্থায়ী হতে পারে। দ্বিতীয় বার ডেঙ্গু তে আক্রান্ত হলে রোগের ভয়াভয়তা বৃদ্ধি পায়। সেই কারনে পূর্বে ডেঙ্গু তে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অতিরিক্ত সতর্কতা মেনে চলতে বলা হয়।
ডেঙ্গুর গুরুতর উপসর্গ গুলি হোল –
- প্রচণ্ড পেট ব্যথা
- ক্রমাগত বমি হওয়া
- মারি বা নাক থেকে রক্তপাত
- প্রস্রাবে এবং মলের সাথে রক্তপাত
- অনিয়ন্ত্রিত পায়খানা
- ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ (যা ক্ষতের মতো দেখাতে পারে)
- দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস
- ক্লান্তি
- বিরক্তি এবং অস্থিরতা
ডেঙ্গুর জীবাণু মানুষের শরীরের রক্তনালীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে রক্তনালীতে ছিদ্র তৈরি হয়। রক্ত রবাহে ক্লট-তৈরির কোষগুলির (প্ল্যাটলেট) সংখ্যা কমে যেতে থাকে। এর জন্য মানুষের শরীরে শক লাগা, শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত, যে কোন অঙ্গের ক্ষতি এবং শেষ পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু হতে পারে। রোগীর শরীরে গুরুতর উপসর্গ গুলির কোন একটি দেখা দিলে অতি অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত বা রোগী কে নিকটবর্তী হসপিটালে ভর্তি করানো দরকার। অন্যথায় রোগীর প্রাণসংকট হতে পারে।
ডেঙ্গুতে প্লেটলেটের সংখ্যা সাধারণত কত হয়?
স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সম্পন্ন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের প্লেটলেট সংখ্যা হয় 150,000 থেকে 450,000 প্লেটলেট প্রতি microliter রক্তে। উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ডেঙ্গু-আক্রান্ত রোগীদের এই সংখ্যা 20,000 এর নিচে চলে যেতে পারে। এই সময় রক্তপাতের ঝুঁকি সর্বোচ্চ হয়। মাঝারি ঝুঁকি পূর্ণ রোগীদের প্লেটলেট সংখ্যা 21-40,000/cumm মধ্যে থাকে। অবশ্য ডেঙ্গু সংক্রমণে অনেক ক্ষেত্রেই প্লেটলেট সংখ্যার দ্রুত পরিবর্তন হয়। প্লেটলেট কাউন্ট কম এবং রক্তক্ষরণের লক্ষণ প্রকাশ পেলে তবেই প্লেটলেট প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। অন্যথায় সংক্রমণ কমার সাথে সাথে আমাদের শরীরে স্বাভাবিক ভাবে প্লেটলেট কাউন্ট বৃদ্ধি পায়। এর জন্য প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, ফোলেট এবং পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহন।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
ডেঙ্গুর চিকিৎসার বিশেষ কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। গবেষকরা কাজ করে যাচ্ছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘরোয়া চিকিৎসাতেই কমে যায়। চিকিৎসকরা পেরাসিটামিল জাতীয় ওষুধ দিয়ে যন্ত্রণা এবং জ্বরের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেন। Non-steroidal প্রদাহ-প্রতিরোধী ওষুধের রক্ত ক্ষরণের সম্ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রোগের মাত্রা অতিরিক্ত ভাবে বৃদ্ধি পেলে রোগী কে হসপিটালে ভর্তি এবং ডাক্তারি নজরদারি তে রাখা একান্ত জরুরী। হসপিটালে ডেঙ্গু রোগীদের শিরায় (IV) ইলেক্ট্রোলাইট (লবণ) তরল দেওয়া হয়। এতে শরীরে প্রয়োজনীয় জল এবং লবণের যোগান বজায় থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের জন্য ডায়েট
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের জন্য, কিছু পুষ্টি উপাদান বিশেষ ভাবে উপকারী হতে পারে, যেমন
- ভিটামিন সি (সাইট্রাস ফল, বেরি এবং শাক-সবজিতে পাওয়া যায়),
- জিঙ্ক (সামুদ্রিক খাবার, মটরশুটি এবং বাদামে পাওয়া যায়)
- আয়রন (মাংস, মটরশুঁটিতে পাওয়া যায়)
- ওটমিল (সহজপাচ্য কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ)
- পেঁপে
- নারিকেলের জল
সেই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে জল পান করা দরকার শরীর কে হাইড্রেট করার জন্য।
ডেঙ্গু হলে অনুচিত খাবার
সহজে হজম হয়না এমন খাবার ডেঙ্গু রোগী দের খাওয়া উচিত নয়। যেমন –
- আমিষ খাবার
- চর্বি
- তৈলাক্ত খাবার
- ভাজাভুজি
ডেঙ্গু জ্বরের ঘরোয়া প্রতিকার
- ডেঙ্গু একটি মশা-বাহিত রোগ। তাই মশার কামড়ের হাত থেকে নিজেকে এবং আপনার পরিবার কে বাঁচান।
- বাড়ির চারপাশে জল জমতে দেবেন না। জমা জলে মশারা বংশবিস্তার করে। জল জমতে না দিয়ে মশার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সপ্তাহে অন্তত একবার জল জমতে পারে এমন জায়গা পর্যবেক্ষণ করুন। এবং গাছের টব, ফুলদানি, পরে থাকা গাড়ির টায়ারের জমে থাকা জল ফেলে দিন।
- শরীর ঢাকা জামা কাপড় যেমন লম্বা-হাতা শার্ট, লম্বা প্যান্ট, মোজা এবং জুতা পরুন।
- ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। এই সময় অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন।
- রাতে শোবার সময় মশারী ব্যবহার করুন।
- মশা নিরোধক কেমিক্যাল যেমন পারমেথ্রিন ব্যবহার করুন।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা, প্রথমআলো, দি কলকাতা মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার