তিস্তা নিয়ে মানবিকতা ভারতের না থাকলেও বাংলাদেশের আছে বলেই ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে সরবরাহ করা ।। তিস্তা প্রকল্পের বড় বাধা ভারত
রুহুল কুদ্দুস টিটো
অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদী অমিমাংসিত ইস্যু। দু’দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে একমাত্র গঙ্গা নদীর পানির বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষর হলেও তিস্তাসহ আলোচনায় থাকা ৮টি নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।
গঙ্গা চুক্তির পর আলোচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারটি। ২০১১ সালে দু’দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সব প্র্রস্তুতি নেয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় তা আজও সম্পন্ন করা যায়নি।
তিস্তার পানি বন্টনের ক্ষেত্রে একটি চুক্তি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা হয়েছিল। পরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণে তা এগুতে পারেনি।
ভারত থেকে বাংলাদেশে যে ৫৪টি নদী প্রবেশ করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে তিস্তা। এটি ভারতের সোলামো লেক থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুর জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে এটি চিলমারির কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলিত হয়েছে।
গজলডোবা বাঁধ স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা নদীর উজানে ভারতীয় অংশে। গজলডোবা বাঁধের (ব্যারাজ) মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে গেছে। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধে ফটক রয়েছে ৫৪টি যা বন্ধ করে তিস্তার মূল প্রবাহ থেকে পানি বিভিন্ন খাতে পুনর্বাহিত করা হয়। প্রধানত তিস্তার পানি তিস্তা-মহানন্দা খালে পুনার্বাহিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই বাঁধ স্থাপন করা হয়। ২ হাজার ৯১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা-মহানন্দা খালের মাধ্যমে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ জেলায় সেচের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। কার্যত তিস্তার নদীর পানি গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে বিহারের মেচী নদীর দিকে প্রবাহিত করা হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ভারত-বাংলাদেশের কূটনীতিক কাঁটাতারে তিস্তা চুক্তি ঝুলে থাকার পর ২০১১ সালে বাংলাদেশ এবং ভারত সম্মত হয় ১৫ বছরের জন্য একটি পানিবণ্টন চুক্তি করতে। যেখানে শুকনো মৌসুমে বিশেষ করে ডিসেম্বর থেকে জুন মাসের এই শুষ্ক মৌসুমে দুই দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে ভারত পাবে এই নদীর পানির ৪২.৫ শতাংশ আর বাংলাদেশ পাবে ৩৭.৫ শতাংশ পানি। এই চুক্তিতে একটি যৌথ নদী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র করে এই নদীর পানির তথ্য পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়। ফলে বর্ষা মৌসুমে বন্যা এড়াতে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হবে এমনটাই ছিল প্রত্যাশা।
তবে পশ্চিম বাংলার ক্ষমতায় থাকা ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ এই চুক্তির বিরোধিতা করে, এবং তাতে সম্মতি দেয়নি। আর অংশীদার রাজ্যের সহায়তা ছাড়া এই চুক্তি সম্পাদন সম্ভব নয়, শেষ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হয়ে ঢাকা আসার কথা থাকলেও, মমতা ব্যানার্জী তা বাতিল করে দেন। তিস্তা চুক্তি আবারো বন্দি হয়ে যায় কাগজে কলমে।
চীনের হোয়াংহো নদীকে একসময় বলা হতো চীনের দুঃখ। প্রতিবছর ওই নদীর পানি ভাসিয়ে দিতো শত শত মাইল জনপদ। ভেঙে নিয়ে যেত বহু গ্রাম-পথ-ঘাট জনপদ। সেই সর্বনাশা নদীশাসন করায় (পরিকল্পিত ড্রেজিং) চীনের মানুষের দুঃখ ঘুচেছে। হোয়াংহো এখন হয়ে গেছে চীনের কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ।
হোয়াংহোর মতোই এখন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ‘পাগলা নদী’ খ্যাত তিস্তা ড্রেজিং করে কোটি মানুষের দুঃখ ঘোচানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তিস্তা নদীকে ঘিরে উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। মহাপরিকল্পনায় পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার চীনের সেই প্রস্তাবনার আলোকেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছে।
২৪০ বছরের পুরোনো নদী তিস্তা। এর সঙ্গে রয়েছে উত্তরের ২৫টি নদীর প্রবাহ। গত ২০১৪ সাল থেকে ভারত সরকার একতরফা তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীটি একেবারেই শুকিয়ে যায়। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার রাজাহাট, উলিপুর, চিলমারী, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা। তবে শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। এ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই তিস্তা নদীবেষ্টিত। নদীশাসন না হওয়ায় গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী।
বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিং সফরের সময় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি আরো কয়েকটি বিষয়ে চীনের সহায়তা চেয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্প প্রণয়নের জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-কে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যাতে ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে একদা বিশ্বে বহুল পরিচিত হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারকে চীন যেভাবে ‘চীনের আশীর্বাদে’ পরিণত করেছে ঐ একই কায়দায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের জন্য প্রতিবছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকেও একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ চীনা অর্থায়নে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পর প্রকল্প প্রস্তাবটি চীনের পক্ষ থেকে কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সাথে চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানের প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশও ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের মানুষকে তিস্তা নদী ঘিরে মহাপরিকল্পনা উপহার দিতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার। ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্রসৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। যাতে পর্যটকরা লং ড্রাইভে যেতে পারেন। এছাড়া এই রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে। নদীপাড়ের দুইধারে গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী। টাউন নামের আধুনিক পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দর গড়ে তোলা হবে। তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী।
প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে দশ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হবে এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হবে। একইসাথে, রিভার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারেজ-কাম-রোড নির্মাণ করে নদীর দু’তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার সৃষ্টি করে সেচখাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। উপরন্তু, নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ন সুবিধাদি গড়ে তোলা হবে।তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য-পীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হবে।
তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নদীর দুই পাশে শহর গড়ে উঠবে, নদী শাসন হবে এবং নদীর নাব্যতা থাকবে। ফলে পুরো এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এবং দুই কোটি মানুষের জীবনও বদলে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তিস্তা নিয়ে মানবিকতা ভারতের না থাকলেও বাংলাদেশের আছে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা নদীর জল ভাগাভাগির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনও অগ্রগতি না-হলেও আর একটি অভিন্ন নদী ফেনী থেকে ভারতকে জল দিতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ।
দুদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে সরবরাহ করা হবে, যাতে সেখানে পানীয় জলের প্রয়োজন মেটানো যায়।বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বিবিসিকে বলেছেন, সম্পূর্ণ মানবিক কারণেই প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।-৬ অক্টোবর ২০১৯ বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত
ভারতের সঙ্গে ঝুলে থাকা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিকল্প কোনো কিছু নয় এই তিস্তা মহাপরিকল্পনা। কিন্তু এরপরও নাকি আপত্তি আছে ভারতের। কারণ ভারতের শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে চীনের সহায়তায় তিস্তা প্রকল্পের কাজ ভারতের নিরাপত্তার জন্য নাকি হুমকি।
তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহকে ভারত বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। ভারত মনে করে, চীন তাদের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে চায়।
ভারতের দাবি, তাদের শিলিগুড়ি করিডরের ‘চিকেন নেকের’ এত কাছাকাছি তিস্তা প্রকল্পে কয়েকশ’ বা হাজারের বেশি চীনা নাগরিকের অবস্থানকে ভারত মেনে নেবে না। অতএব, বাংলাদেশকে এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে বলা হচ্ছে।
নির্বাচনের আগে গত ২১ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক সেমিনারে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, তার দেশ তিস্তা নদীর উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলেও আশা প্রকাশ করছিলেন তিনি। ২৮ জানুয়ারি এই বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন বলেছিলেন, চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র। তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের সঙ্গে কাজ নিয়ে প্রতিবেশী ভারত কোনো আপত্তি তুললে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হবার বিষয়ে তিনি আশাবাদী।নির্বাচনের পরে চীনের রাষ্ট্রদূত তার সেই আগ্রহ চাপা রাখেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সাথে এক বৈঠকের পর রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ চাইলে তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে তৈরি আছে চীন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের দিক থেকে প্রকল্পের প্রস্তাব পেলে চীন সহযোগিতা দেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ভারতের সিকিম হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত তিস্তার অববাহিকা ঘুরে দেখেছেন।অধ্যাপক আহমেদ মনে করেন, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প নিয়ে চীনের আগ্রহ এখানে গৌণ এবং তাদের কোন ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থও জড়িত নেই।
অধ্যাপক আহমেদ বলেন, “তিস্তা নদীতে এটি বাংলাদেশের প্রকল্প, এটি চীনের কোন প্রকল্প নয়। চীন শুধু এখানে অর্থায়ন করতে রাজী হয়েছে। কারণ অন্যরা সে অর্থ দিতে পারছেনা।”তিস্তা নদীর পানি বন্টণ নিয়ে ভারত যেহেতু বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করতে পারছেনা, সেজন্য এর বিকল্প একটি সমাধান খুঁজছে বাংলাদেশ।
এজন্য তিস্তা প্রকল্প সামনে এনেছিল বাংলাদেশ, এ প্র্রকল্প চীনের ভাবনা থেকে আসেনি। এটা বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের চিন্তা থেকে এসেছিল – বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আহমেদ।বাংলাদেশের অংশ তিস্তা নদীর অববাহিকায় উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষের কৃষি ও মৎস্যসহ নানা ধরণের কর্মকাণ্ড জড়িত।
এ প্রকল্প নিয়ে ভারতের আপত্তির বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।প্রথমত: ভারত যদি এই প্রকল্পকে স্বাগত জানায়, তাহলে এখানে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের বাধ্যবাধকতা তৈরি হতে পারে এবং সেক্ষত্রে তাদের বিনিয়োগের প্রশ্ন উঠতে পারে।
“এরকম একটা প্রকল্প ঝুলিয়ে রাখা ভালো। সেক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের উপর চাপ বজায় রাখতে পারে,” অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি মনে করেন, তিস্তা ইস্যু সমাধান হয়ে গেলে বাংলাদেশের উপর ভারতের যে প্রভাব, সেটা আর থাকবে না।
অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তখন আর ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকবেনা।
তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নদীর দুই পাশে শহর গড়ে উঠবে, নদী শাসন হবে এবং নদীর নাব্যতা থাকবে। ফলে পুরো এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে এবং দুই কোটি মানুষের জীবনও বদলে যাবে।
এর ফলে সেখানে চীনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরির পাশাপাশি ভারত-বিরোধী মনোভাব আরো প্রবল হব – বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক আহমেদ।
তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ঝুলে আছে ২০১১ সাল থেকে। এই চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের আর্থসামাজিক জীবনের বাইরে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানও নিয়ে আসবে। অনেকে মনে করেন সরকারের সক্ষমতা প্রমাণের বিষয়ও আছে এর মধ্যে ।
কে জানে চীন আর ভারতের সমীকরণ মেলাতে শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গড়ায় এ আলোচনা দীর্ঘদিন ধরেই। হয়ত ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই হবে ভারত ও চীনের সঙ্গে।
তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে এদেশের জনগণের অপেক্ষার যেন শেষ হয়। কারণ তিস্তা মহাপরিকল্পনা উত্তরবঙ্গের ২ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’র বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ভারতের সীমান্তের কাছে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে চীনের এই বিশাল আকারের প্রোজেক্ট ভারতের নদীর জলবণ্টনের হিস্যা আদায়ে সরাসরি কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। তবে ভারতের সীমান্তের কাছে এই মেগাপ্রোজেক্ট ভারতকে কূটনীতিক চাপে ফেলবে নিশ্চিতভাবে। বিশেষ করে চীন নদী শাসন, ব্যবস্থাপনা এবং বাঁধ নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রগ্রামী দেশ, নিজেদের দেশে তারা তৈরি করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে চীনা প্রযুক্তি যদি গতিশীলতা তৈরি করে তবে ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ, আসামে পানি ও নদী ব্যবস্থাপনার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। পাশাপাশি ভারত কৌশলগত প্রতিবেশী বাংলাদেশের সাথে পানিবণ্টন চুক্তিতে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে এটিও প্রতিষ্ঠিত হবে দক্ষিণ এশিয়ায়। তাই তিস্তা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ-চীনের কূটনৈতিক যুদ্ধ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আগামী দিনে দেখার ব্যাপার। তবে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মানুষের চাওয়া বর্ষাকালে প্রলম্বিত বন্যা এবং শুকনা মৌসুমে হাহাকারের অবসান ঘটুক।
তথ্রসূত্র: বিবিসি বাংলা