তৃণমূল স্তরের রাজনীতি বলতে কী বোঝায়? দেশের দুটি বৃহৎ দলের তৃণমূলের বা প্রান্তিক নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন
রুহুল কুদ্দুস টিটো
তৃণমূল স্তরের রাজনীতি বলতে কী বোঝায়?
তৃণমূল উদ্যোগে একটি প্রদত্ত জেলা, অঞ্চল বা সম্প্রদায়ের লোকজনকে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তৃণমূলী উদ্যোগে এবং সংস্থাগুলি স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবর্তনের আনার জন্য স্থানীয় স্তর থেকে সম্মিলিত পদক্ষেপ নেয়। তৃণমূলের আন্দোলনে শীর্ষ থেকে নীচে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবর্তে নীচে থেকে শীর্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাথে সম্পর্কিত এবং কখনও কখনও বেশি ঐতিহ্যবাহী শক্তি কাঠামোর চেয়ে প্রাকৃতিক বা স্বতঃস্ফূর্ত হিসাবে বিবেচিত হয়।
তৃণমূল আন্দোলন, স্ব-সংস্থা ব্যবহার করে সম্প্রদায়ের সদস্যদের তাদের সম্প্রদায়ের জন্য দায়িত্ব ও পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে উৎসাহিত করে। তৃণমূলের আন্দোলনগুলি ভোটারদের তহবিল সংগ্রহ এবং নিবন্ধন করা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কথোপকথনকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। সুনির্দিষ্ট আন্দোলনের লক্ষ্যগুলি ভিন্ন এবং পরিবর্তিত হয়, তবে রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগ গুলি তাদের ফোকাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই রাজনৈতিক আন্দোলনগুলি ছোট এবং স্থানীয় পর্যায়ে শুরু হতে পারে তবে তৃণমূলের রাজনীতি কর্নেল ওয়েস্টের দাবি হিসাবে প্রগতিশীল রাজনীতির গঠনে প্রয়োজনীয় কারণ তারা আঞ্চলিক রাজনৈতিক উদ্বেগের দিকে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
দেশের দুটি বৃহৎ দলের তৃণমূলের বা প্রান্তিক নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন
বিগত কয়েক দশক ধরে দেশের রাজনীতি যে ক্রমাগত তৃণমূল বিমুখ হয়েছে আর রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সরকারব্যবস্থা সবই যে কেন্দ্রমুখী হয়েছে সেটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
এ কেন্দ্রমুখিতা একদিকে দলগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করে দিয়েছে, অন্যদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে পেশিশক্তির দাপট আর টাকা ছড়ানোর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছে। এই পরিস্থিতির সাক্ষ্য পাওয়া যাবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বিরোধী দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে এবং সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের মনোনয়নের দৃষ্টান্তে। কিন্তু এ নিয়ে ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন কোনো মাথাব্যথা নেই তেমনি স্থানীয় সরকারব্যবস্থার প্রশাসনিক সংস্কারেরও কোনো উদ্যোগ নেই।
মূলত রাজনীতি কেন্দ্র থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু এর সামগ্রিক সব তৃণমূলে লুকায়িত। বাংলাদেশ মূলত গ্রামেরই সমষ্টি। সেই হিসেবে সকল তৃণমূল সংগঠিত হয়েই রাজনীতির মেরুকরণ হয়। তৃণমূলের রাজনীতি বলতে আমরা বুঝি দেশের সব প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রাজনীতি। আর রাজনীতির তৃণমূল বলতে সাধারণত রাজনীতির গ্রামীণ পটভূমি বোঝানো হয়।
দেশের দুটি বৃহৎ দলের তৃণমূলের বা প্রান্তিক নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন যেন একটি নিত্যনৈমত্তিক রাজনৈতিক সংষ্কৃতি। আর আসলের চাইতে এখন হাইব্রিডের কদর বেশী। মূল্যায়িত না হওয়ার অভিমানে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখছেন অনেক নেতাকর্মী। একদিকে অবমূল্যায়ন আর অন্যদিকে গোদের ওপর ক্যানসারের মত নিজ দলের নেতা কর্মীর দ্বারা আক্রমণ, মামলা, হামলা আর হয়রানি। বিচারের বানী নিভৃতে কাঁদে। এই বঞ্চিত-লাঞ্চিতদের গোপন কান্না দলের উচ্চ পর্যায়ে পৌছায় না। এই সব সুবিধাবাদী চক্র মন্ত্রী এমপিদের ডান হাত হয়ে যায়।
তৃণমূলে সাধারণ মানুষ দেখছে দল ক্ষমতায় গেলে কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি হয়ে যায়। এটাও সত্য অনেকেই দলে আসে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করতে, নেতা হতে; কর্মী হতে নয়। স্থানীয় পর্যায়ে দুটি দলে খণ্ড খণ্ড গ্রুপ দেখা যায়। একটি গ্রুপ সুযোগ পেলে অপর গ্রুপকে হয়রানি করছে, কর্মীদের বঞ্চিত করছে।
এখন অধিকাংশ মানুষই রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছে। এর কারণও দলগুলোর বা রাজনীতিকের তৃণমূলের ভাষা না বোঝা। সচরাচর দৈবিক লাভ ছাড়া কেউ রাজনীতির ময়দানে পা বাড়ান না। রাজনীতি অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে? যদিও প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনীতি জনবিচ্ছিন্ন হয় তখনি যখন মানুষ রাজনীতির সুফল ভোগ করতে পারে না।
প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে শাসন ক্ষমতার বাইরে থাকায় এবং বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক মামলায় জর্জরিত থাকায় বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো কয়েক বছর ধরেই বিপর্যস্ত। ফলে দলটির সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা সহজেই অনুমেয়। অবশ্য সম্প্রতি সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারা দেশে মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপির তৃণমূলের রাজনীতি নতুন করে চাঙা হয়ে উঠতে দেখা গেছে।
লুসিয়ান পাইয়ের সংজ্ঞা হল “রাজনৈতিক সংস্কৃতি হল মনোভাব, বিশ্বাস এবং অনুভূতিগুলির সমষ্টি, যা একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে এবং অর্থ দেয় এবং যা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এমন অন্তর্নিহিত ধারণা এবং নীতি সরবরাহ করে।”
কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রের যোগাযোগ এবং তৃণমূল থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্বাচনই বা কতটুকু গণতান্ত্রিক? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এক যুগের বেশি সময় ধরে টানা ক্ষমতায় থেকে একদিকে মাঠের রাজনীতিতে কোনো চ্যালেঞ্জ না থাকা আর অন্যদিকে ক্ষমতার রাজনীতির সুযোগ-সুবিধার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দলটিতে বহু বিভক্তি-বিভাজন আর টানাপড়েন চলছে। এর মধ্যে সবচয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তথাকথিত ‘হাইব্রিড আওয়ামী লীগার’ ইস্যু।
তৃণমূলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাদের সামনে আসার সুযোগ রোধ করে টাকার জোরে ‘বহিরাগতরা’ আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে চলে এসেছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সাম্প্রতিককালে দলের শীর্ষ নেতৃত্বও বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে এদের ‘হাইব্রিড’ হিসেবে অভিহিত করছেন। একই সঙ্গে এর দৃষ্টান্ত রয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে মনোনয়ন বাণিজ্য আর বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাপটে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলে যেমন তেমনি বিরোধী দলগুলোর রাজনীতিও তৃণমূল বিমুখ হয়ে পড়েছে।
তরুণ কর্মীদের ক্ষেদ এ ভাবে প্রকাশ পায়
আমাদের মেধা ও শক্তি সামর্থ্য জীবন যৌবন এই দলের জন্য উৎসর্গ করেছিলাম। পতিত স্বৈরাচার পতিত সাবেক আমলারা কেন অবসরে যাওয়ার সাথে সাথেই রাজনীতি করার শখ জাগে কমপক্ষে তিনটি সরকারে তলপিবাহক হয়।গত জাতীয় পার্টির সময় সে আমলা চাকরিতে যোগদান করেছে, সে সাবেক এরশাদের কর্মী হয়েছে এবং বিএনপি আমলে আরো একধাপ এগিয়ে, আওয়ামী লীগের আমলে আরো দুই ধাপ এগিয়ে সাচ্চা ছাত্রলীগের কর্মী সাজে, ঘুষ দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। কামাইয়ের টাকাটা ‘জায়েজ’ করার জন্য বড় রাজনীতি দলগুলোতে যোগদান করে। তারা দেশের জন্য নয়, দলের জন্যও নয়, নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য অবসরে গিয়ে বড় দল খোঁজে, কোনো দলে উপদেষ্টা হওয়া যায় এবং কোন দলে এমপি হওয়া যায়- এটাই তাদের মূল লক্ষ্য। তারা দেশ ও জাতির মঙ্গল চায় না। তাই রাজনীতি কর্মীকে মূল্যায়ন করুন, আমলাকে নয়। তবে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে সৃজনশীল পরিবর্তন আনবে জনগণ। দেশের প্রয়োজনে নতুন প্রজন্ম থেকে আসবে নতুন নেতৃত্ব। আসছে দশকেই বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধ দেশ।
আমাদের সংসদীয় রাজনীতির হীনদশা, দলীয় স্বজনপ্রীতি, ব্যাপক দুর্নীতি এবং জনগণের নিরাপত্তা বিধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অভাব শাসনযন্ত্র যদি স্বচ্ছ, যুক্তিনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত না হয় তাহলে এর প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে পড়তে বাধ্য। রাজনীতির দূষণ মানে সমাজে দূষণক্রিয়ার বিস্তার। এর প্রভাব নানামাত্রিক। বিশেষ করে সমাজে সুস্থ মূল্যবোধের অভাব। ক্ষমতার লোভ, অর্থবিত্ত, ছিনতাই, গুম, অপহরণ, খুনসহ কালোবাজারি, মজুদদারি, খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল- এ বিশাল অনাচারের তালিকা হিসাব করতে গেলে চোখ কপালে উঠবে।
এরকম পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের নামে নানা সময় নানা রকম প্রশাসনিক কাঠামো রদবদল করা হলেও দেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়েই রয়েছে। অথচ ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের প্রায় এককেন্দ্রিক শাসনকাঠামোয় কিছুটা হলেও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করত।
বিশ্লেষকদের মতে, এখন দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় এবং সেই নির্বাচনটি বিরোধী দলের অংশগ্রহণহীন হওয়ায় স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দলের একটি বর্ধিত সংস্করণে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, স্থানীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যত বেড়েছে; ততই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের বদলে জনবিচ্ছিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশিশক্তিতে এগিয়ে থাকা ব্যক্তিরা জনপ্রতিনিধি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে গেছেন। অথচ তৃণমূলের রাজনীতিতে আগে এলাকায় দীর্ঘদিন রাজনীতি করা নেতা আর শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসকদের মতো পেশাজীবীদেরই প্রাধান্য ছিল। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে পৌরসভা-ইউনিয়ন পর্যন্ত বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধিই যদি ব্যবসায়ী হন, সেটা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য অশনিসংকেতই বটে। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃণমূলের গুরুত্ব ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন অত্যাবশ্যক।