“দ্বিজাতি তত্ত্ব” এর উপর ভিত্তি করে ভারতের বিভক্তির পর এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ধর্মীয় বিষয়টিকে মুখ্য বিবেচনা করা হয়েছে
রুহুল কুদ্দুস টিটো
বাঙলা সমন্বিতকরণ পরিকল্পনা
“দ্বিজাতি তত্ত্ব” এর উপর ভিত্তি করে ভারতের বিভক্তির পরে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এখানে ধর্মীয় বিষয়টিকে মুখ্য বিবেচনা করা হয়েছে। তখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি ভিত্তিগত পরিকল্পনা পেশ করেন যে, পূর্ব এবং পশ্চিম বাঙলা ভারত কিংবা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে না যুক্ত হয়ে বরং একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে । সোহরাওয়ার্দী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, যদি বাঙলা এভাবে বিভক্ত হয় তবে পূর্ব বাঙলা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। হবে কেননা, সব কয়লা খনি কিংবা পাট কল পশ্চিম বাংলার অংশ হয়ে যাবে এবং সিংহভাগ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যারা কিনা শিল্পায়নের সাথে যুক্ত পশ্চিম বাংলায় অভিবাসন সম্পন্ন করবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ‘কোলকাতা’ যা ভারতের অন্যতম প্রধান শহর এবং শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু তা পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সোহরাওয়ার্দী ২৪ এপ্রিল, ১৯৪৭ সালে দিল্লির একটি সংবাদ সম্মেলনে তার প্রস্তাব তুলে ধরেন। তবে পরিকল্পনাটি সরাসরি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ (ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল ছিলো এবং দ্বিজাতিতত্বের আলোকে একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছিলো) বাতিল করে দেয়। প্রাথমিকভাবে, বাঙলা প্রদেশের মুসলিমলীগ নেতারা দ্বিধা বিভক্ত ছিলেন। বর্ধমানের নেতা আবুল হাসিম সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং অন্যদিকে, নুরুল আমিন এবং মোহাম্মদ আকরাম খান এর বিরোধিতা করেছেন।কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবের বৈধতা বুঝতে পেরে পরিকল্পনাকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর সমর্থন লাভের পর সোহরাওয়ার্দী তার পরিকল্পনার সপক্ষে সমর্থন জমায়েত শুরু করেন।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গুটিকয়েক নেতাই এই পরিকল্পনার সাথে একমত ছিলেন। তাদের মাঝে ছিলেন বাঙলা প্রদেশের প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা এবং নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোসের বড় ভাই শরৎ চন্দ্র বোস এবং কিরণ সংকর রয়। তবে, জওহরলাল নেহেরু এবং ভাল্লাবভাই পাতিল সহ বেশিরভাগ বিপিসিসি নেতা এই পরিকল্পনা বাতিল করেন। এছাড়াও শ্যাম প্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল এর তীব্রভাবে বিরোধিতা করে।তাদের মতামত ছিলো যে, এই পরিকল্পনা আসলে বিভক্তিকরনের বিপক্ষে সোহরাওয়ার্দীর দ্বারা একটি চাল মাত্র যাতে কলকাতা শহর সহ শিল্পোন্নত পশ্চিম অংশের উপর লীগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। তারা আরও মতামত পোষণ করেছিলেন যে, যদিও পরিকল্পনায় একটি সার্বভৌম বাংলার কথা উল্লেখ করা আছে, এটা বাস্তবিক পক্ষে একটি ভার্চুয়াল পাকিস্তান ছাড়া কিছুই হবে না এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের চিরতরে মুসলিম সংখ্যাগুরুদের দয়ার উপর চলতে হবে।
যদিও কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া প্রস্তাবটি আলোর মুখ দেখা সম্ভব ছিলো না, বোস এবং সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাবিত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গঠনতন্ত্র নিয়ে একটি মতৈক্যে পৌঁছুতে তাদের আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর মত বোসও বিশ্বাস করতেন যে, বিভক্তিকরণের ফলে বাংলার অর্থনীতি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অর্ধেকের মত হিন্দু জনগোষ্ঠী অসহায় অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে আটকা পরবে।চুক্তিটি ২৪ মে,১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় চুক্তিটি আক্ষরিক অর্থে একটি রাজনৈতিক চুক্তি ছিলো এবং তৃণমূল পর্যায়ে বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। কেননা ছয় বছর ধরে মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্বের ক্রমাগত প্রচার; সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রণালয়ে হিন্দু ধর্মালম্বীদের প্রান্তিকীকরণ এবং ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার ফলে মুসলিম লীগের প্রতি বাঙালি হিন্দুদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস তখন সামান্যই অবশিষ্ট ছিলো।এর মাঝেই নির্বাচকমণ্ডলীর প্রকৃতি প্রশ্নে (পৃথক বা যৌথ) বোস এবং সোহরাওয়ার্দীর মাঝে মতানৈক্য দেখা দেয় । সোহরাওয়ার্দী মুসলিম ও মুসলিম নন- তাদের জন্য পৃথক নির্বাচন বজায় রাখার উপর জোর দেন। কিন্তু বোস এর বিরোধিতা করেন। তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন কেননা কংগ্রেস এর দিক থেকে এবং অন্য কোন উল্লেখযোগ্য সমর্থনের অভাব ছিল। ফলে অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।তারপরেও, এই পদক্ষেপকে বাংলার বিভক্তি এড়ানো এবং বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একত্রে বসবাস করার ইচ্ছার শেষ চেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন জওহরলাল নেহেরু এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে দেশভাগের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা
বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫)
বঙ্গভঙ্গ বাংলার ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের আদেশে ১ম বঙ্গভঙ্গ সম্পন্ন হয়। বাংলা বিভক্ত করে ফেলার ধারনাটি অবশ্য কার্জন থেকে শুরু হয়নি। ১৭৬৫ সালের পর থেকেই বিহার ও ওড়িশা বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সরকারী প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বাংলা অতিরিক্ত বড় হয়ে যায় এবং ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এটির সুষ্ঠু শাসনক্রিয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত এখান থেকেই।
কিন্তু ১৯১১ সালে, প্রচণ্ড গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়। দ্বিতীয়বার বঙ্গভঙ্গ হয় ১৯৪৭ সালে। এর ফলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতে যুক্ত হয়। এই পূর্ববঙ্গই পরবর্তীকালে পাকিস্তানের কাছ থেকে এক রক্তক্ষয়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে ও বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে।
বঙ্গ প্রদেশের আয়তন ছিল ১,৮৯,০০০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ছিল ৭৮.৫ মিলিয়ন। বঙ্গের পূর্বাঞ্চল ভৌগোলিক এবং অপ্রতুল যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে পশ্চিমাঞ্চল হতে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৮৩৬ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে বঙ্গ থেকে পৃথক করে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধিনে ন্যস্ত করা হয় এবং ১৮৫৪ সালে বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব হতে গভর্নর-জেনারেল-ইন-কাউন্সিলকে অব্যাহতি দিয়ে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের উপর অর্পণ করা হয়। ১৮৭৪ সালে সিলেট সহ আসামকে বঙ্গ হতে বিচ্ছিন্ন করে চিফ-কমিশনারশীপ গঠন করা হয় এবং ১৮৯৮ সালে লুসাই পাহাড়কে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
১৯০৩ সালে প্রথম বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবসমূহ বিবেচনা করা হয়। তখন বঙ্গ হতে চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাদ্বয়কে আসাম প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাবও ছিল। তেমনিভাবে ছোট নাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে আত্তিকরণেরও একটি প্রস্তাব ছিল। ১৯০৪ সালের জানুয়ারিতে সরকারীভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় এবং ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন বঙ্গের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে এক সরকারি সফরের মাধ্যমে এই বিভক্তির ব্যাপারে জনমত যাচাইয়ের চেষ্টা করেন। তিনি বিভিন্ন জেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে এই বিভক্তির বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা দেন।
পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী (দার্জিলিং বাদে) বিভাগ এবং মালদা জেলা, আসাম প্রদেশের সঙ্গে একীভূত হয়ে এই নতুন প্রদেশ গঠন করবে। এর ফলে বঙ্গ শুধু তার বৃহৎ পূর্বাঞ্চলই হারাবে না, তাকে হিন্দীভাষী পাঁচটি রাজ্যও মধ্যপ্রদেশকে ছেড়ে দিতে হবে। অন্যদিকে পশ্চিমে সম্বলপুর এবং মধ্যপ্রদেশের পাঁচটি ওড়িয়া-ভাষী রাজ্যের সামান্য অংশ বঙ্গকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ফলে বঙ্গের আয়তন দাঁড়ায় ১,৪১,৫৮০ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ৫৪ মিলিয়ন যার মধ্যে ৪২ মিলিয়ন হিন্দু ও ৯ মিলিয়ন মুসলিম।
নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব বঙ্গ ও আসাম” যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। এর আয়তন হবে ১,০৬,৫০৪ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা হবে ৩১ মিলিয়ন যাদের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন মুসলিম ও ১২ মিলিয়ন হিন্দু। এর প্রশাসন একটি আইন পরিষদ ও দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি রাজস্ব বোর্ড নিয়ে গঠিত হবে এবং কলকাতা হাইকোর্টের এখতিয়ার বজায় থাকবে। সরকার নির্দেশ দেয় যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের পশ্চিম সীমানা স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকবে সাথেসাথে এর ভৌগোলিক, জাতিক, ভাষিক ও সামাজিক বৈশিষ্টাবলিও নির্দিষ্ট থাকবে। সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯শে জুলাই, ১৯০৫ সালে এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর।
বঙ্গভঙ্গ (১৯৪৭)
১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গ ভারতবর্ষ বিভক্তির একটি অংশ হিসেবে ধর্মের উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত বঙ্গ প্রদেশ ভারত এবং পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বিভক্ত হয়। প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত “পশ্চিম বঙ্গ” ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত “পূর্ব বঙ্গ” পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়।
১৯৪৭ সালের ২০ শে জুন, বঙ্গীয় আইন পরিষদের বঙ্গ প্রদেশের ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য মিলিত হয় যেখানে ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে সংযুক্ত বাংলা বা পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে বিভক্ত যথাক্রমে বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুদের আবাসস্থল হিসাবে গঠনের প্রস্তাব হয়। প্রাথমিক যৌথ অধিবেশনে, পরিষদ ১২০-৯০ দ্বারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে যদি বঙ্গ পাকিস্তানের নতুন গণপরিষদে যোগ দেয় তবে এটি ঐক্যবদ্ধ বা অবিভক্ত থাকবে। পরে, পশ্চিমবঙ্গের আইনপ্রণেতাদের একটি পৃথক বৈঠকে ৫৮-২১ ভোটে সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রদেশটি বিভক্ত করা উচিত এবং পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের বিদ্যমান গণপরিষদে যোগদান করা উচিত। পূর্ব বাংলার আইনপ্রণেতাদের আরেকটি পৃথক সভায় ১০৬-৩৫ ভোটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্রদেশটি বিভক্ত করা উচিত নয় এবং ১০৭-৩৪ সালের মধ্যে দেশভাগের ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে যোগ দেবে।
১৯৪৭ সালের ৬ জুলাই সিলেট গণভোটে আসাম থেকে সিলেটকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ব বাংলায় একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়।
৩ জুন পরিকল্পনা বা মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ অগাস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান এবং ভারতের নিকট এই নতুন ভাবে বিভক্ত বাংলা প্রদেশের ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান যা পাকিস্তানের প্রদেশ ছিল, তা ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৪৭ সালের বাংলা বিভক্তির পূর্বে,১৯০৫ সালে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে সহজতর করার লক্ষ্যে পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলায় বিভক্ত করা হয় যা বঙ্গ ভঙ্গ হিসেবে পরিচিত। সে সময় পশ্চিমবাংলা ছিল হিন্দু অধ্যুসিত এবং মুসলিমরা সেখানে সংখ্যালঘু, অন্যদিকে পূর্ববাংলা ছিল মুসলিম অধ্যুসিত এবং হিন্দুরা ছিল সংখ্যালঘু। মুসলিম অধ্যুসিত পূর্ববাংলার মানুষ এই বঙ্গ ভঙ্গের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছিল, কেননা তারা উপলব্ধি করেছিল যে এই বিভক্তির মাধ্যমে তারা তাদের নিজস্ব একটি প্রদেশ পেতে পারে। কিন্তু হিন্দুরা এই বিভক্তির বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। এই বিতর্ক পরবর্তীকালে প্রতিবাদ এবং সন্ত্রাসের জন্ম দেয় এবং ১৯১১ সালে বঙ্গ ভঙ্গ রদের মাধ্যমে এর নিষ্পত্তি করা হয়।
১৯০৫ সালের বাঙলা বিভক্তির সময়ে হিন্দু এবং মুসলিমদের মাঝে সৃষ্টি হওয়া এই মতানৈক্য পরবর্তীকালে আবারো বিতর্ক তৈরি করে যা আইন তৈরী, এমনকি ১৯৪৭ সালের বাঙলা বিভক্তিতে প্রভাব রেখেছে এবং সেই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডা হিসেবে বারংবার সামনে এসেছে।
বিভক্তিকরণ
পরিকল্পনা অনুসারে, ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্যগণ বাঙলা বিভক্তিকরণ প্রস্তাবের উপরে তিনটি আলাদা ভোট প্রদান করেন।
- পরিষদের সকল সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ অধিবেশনে, যৌথ অধিবেশন বিভক্তিকরণের পক্ষে ১২৬ ভোট এবং বিদ্যমান সংবিধান পরিষদের যোগ দেওয়ার পক্ষে ৯০ ভোট (অর্থাৎ, ভারত) প্রণীত হয়।
- তারপর একটি পৃথক অধিবেশনে বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় সদস্যগণ, বাংলার বিভক্তি এবং সম্পূর্ণ একটি নতুন গণপরিষদ (অর্থাৎ, পাকিস্তান ) এ যোগদান করার সপক্ষে ভোট প্রদান করেন; যেখানে নতুন রাষ্ট্রে যোগদানের সপক্ষে ১০৬ এবং বিপক্ষে ৩৫ টি ভোট প্রণীত হয়।
- একই পদ্ধতি বাংলার মুসলিম অধ্যুসিত নয়, এমন স্থানগুলোতেও অনুসরণ করা হয়েছিল। সেখানে ৫৮ ভোট বিভক্তিকরণের পক্ষে এবং ২১ ভোট বিপক্ষে প্রণীত হয়।
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুযায়ী, যদি একটিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট বিভক্তিকরণের পক্ষে প্রণীত হয় তাহলে প্রদেশ বিভক্ত হবে । এই পরিকল্পনাকে তুলে ধরে, ২০ জুন পরিষদে ভোটাভুটির ফলফলের প্রেক্ষিতে পশ্চিম বাঙলা প্রদেশ ভারত এবং পূর্ব বাঙলা প্রদেশ পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।এছাড়াও, মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুসারে,৭ জুলাই অনুষ্ঠিত একটি গণভোটে, সিলেটের নির্বাচকমণ্ডলী পূর্ব বাঙলা প্রদেশে যোগদানের সপক্ষে ভোট প্রদান করে।
পরবর্তীতে স্যার সাইরিল র্যাডক্লিফ এর নেতৃত্বে সীমানা কমিশন দুই নব নির্মিত প্রদেশের মধ্যে আঞ্চলিক সীমানা নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ অনুসারে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারতকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতা
বাংলায় কৃষক প্রজা পার্টির সৈয়দ হাবিব-উল-রহমান বলেছেন, ভারত বিভাজন ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘হাস্যকর’। বাংলা ও সামগ্রিকভাবে ভারত বিভাগের সমালোচনা করে সৈয়দ হাবিব-উল-রহমান বলেন, “হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই একটি অভিন্ন মাতৃভূমিতে বাস করে, একটি অভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যের শাখা ব্যবহার করে এবং একটি অভিন্ন ভূমিতে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাসের মাধ্যমে বিকশিত একটি সাধারণ হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির মহৎ ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত।”
শুরু থেকেই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত কঠিন। বাংলার হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঝড় তুলেছিল। তারা একে মাতৃভূমির অঙ্গচ্ছেদ হিসাবেও উল্লেখ করে।
ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমান সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে শোষিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের প্রতি উদারনীতি এবং মুসলমানদের প্রতি বৈরী নীতি অনুসরণ করত। মুসলমানরা সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন একটি দরিদ্র, রিক্ত ও নিঃস্ব সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। সুতরাং লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গবঙ্গের চিন্তা-ভাবনা শুরু হলে পূর্ববাংলার মুসলমান সম্প্রদায় স্বভাবতই এর প্রতি সমর্থন জানায়। বঙ্গবঙ্গের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের মুসলমানগণ তাদের হারানো প্রভাব-প্রতিপত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে থাকে।
১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতীয় জনগনের আন্দোলনের সুযোগ পায়। এই সংগঠনের অধীনে তারা বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করতে থাকে। লর্ড কার্জন বিশ্বাস করতো কলকাতায় কিছু ষড়যন্ত্রকারী আমার বক্তব্য কংগ্রেসে প্রচার করত। কাজেই বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করলে ষড়যন্ত্রকারীরা সে সুযোগ আর পাবে না। তারা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে।জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে দুর্বল করে কলকাতার গুরুত্ব হ্রাস করে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করলে ষড়যন্ত্রকারীরা সে সুযোগ আর পাবে না। তারা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে। এ কারনে ব্রিটিশ সরকার ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি অবলম্বন করে।