হাসিনা, আ ডটারস টেল
কতটা কষ্টের বর্ণনা আছে আমার আপনার কাছে? একেবারে নিজস্ব কষ্টের গল্প হিসেবে স্বজন হারানোর বেদনার প্রচলিত ফিরিস্তি সবারই থাকে। কিছু কিছু দুঃখ বড় প্রাকৃতিক। সময়ের সঙ্গে তার এক অদ্ভুত ঐক্য থাকে। তাৎক্ষণিক অসহনীয় মনে হলেও সময়ের পরিক্রমায় তা মিলিয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতি মালা গাঁথে তার নিজস্ব সমীকরণে। হিসাবটি মানুষের পক্ষে করে ওঠা কঠিন। যেখানে দাঁড়িয়ে আর আত্মবিশ্বাস হাতড়ে পাওয়ার সূত্র থাকে না, নিশানা থাকে না কোনো কূলে পৌঁছানোর, সেখান থেকেই বাংলাদেশ খুঁজে পেয়েছে নিজের এক গল্প। বহু বছরের সংগ্রাম আর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ যে জীবিত এক স্পন্দন, সেই স্পন্দনই একসময় একটি পথ রচনা করে।
নেতা তৈরি হন কষ্টে নীল হয়ে, আগুনে পুড়ে। একই উত্তাপে অন্যরা টেকে না, নেতা টিকে থাকেন। বিধাতার সীমাহীন হিসাব-নিকাশের সাপলুডু মানুষ জানে না। সে-পা-ুলিপি তার নিজস্ব। তবে বহু মানুষের আশা-আকাঙক্ষার প্রতীক হবেন তিনি, যাঁর জীবনসূত্র বড় স্পষ্ট নিজের কাছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনটি এমন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনকের কন্যা হিসেবে পঁচাত্তরের নারকীয় হতাযজ্ঞে সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেশটির প্রতিই তাঁর ভক্তি উঠে যেতে পারত; কিন্তু তা হয়নি, বরং কোথায় যেন জ্বলছিল এক অদ্ভুত বাতি। আহা জন্মভূমি! কিছু মানুষ দেশের জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে ইতিহাসের মোড় ঘোরাচ্ছে আর পৃথিবীর আরেক প্রান্তে তাঁর রক্ত পরিণত হচ্ছে তোমার ভবিষ্যৎ গড়তে। এ এক আশ্চর্য ধারাবাহিকতা। বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ কর্মসাধনার ধারাবাহিকতা, তাঁর স্বপ্নের ভেতর দিয়ে যে-স্বাধীনতার সূর্যোদয়, তা কার্যত তাঁর হাত দিয়েই লালিত হবে ইতিহাসের পালাবদলের ভেতর দিয়ে।
ঘটনাগুলো সবার জানা। তারপরও গা শিউরে ওঠে এসব ঘটনাপরম্পরা যখন সার্থক এক শিল্পকাঠামোর যত্নে পরিণত হয়ে ওঠে। কীভাবে যেন মিলে গেছে সব। বাংলাদেশকে চেতনাহীনতার মহাসমুদ্রে ফেলে দিয়েও দিশেহারা করা যায়নি, কারণ জাতির জনকের রক্তই এঁকেছে জাতির দীর্ঘ পথের নকশা।
এক ঘণ্টার ডকুড্রামা হাসিনা, আ ডটারস টেল রীতিমতো এক ঝড়। দর্শককে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত্যের পাঁকে অবস্থান নিতেই হয়। মনোযোগভঙ্গের অবকাশ থাকে না। তারপর ঘুরতে ঘুরতে যেতে হয় গভীর তলদেশে। খুব সহজ আর সরল চিত্রগুলো উঠে আসে জাতির জনকের দুই কন্যার বয়ানে। চাকচিক্যহীন আটপৌরে বাঙালির মধ্যবিত্ত সত্তা সত্যের যে সূত্র ছুঁতে পারে, দেশের প্রধানমন্ত্রী সেভাবেই বয়ান করেন। তিনি এমনই। জনগণের মহাসমুদ্রে তাঁর যে-রূপ, যে-অভিনিবেশ, যে-দৃঢ়তা, যে-দৃষ্টিপাত, একান্ত ঘরোয়া ভাব পরিবেশে তিনি একই রকম। এ-বিশ্বাস মানুষের মধ্যে এসে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নাতি-নাতনির বেষ্টনীতে রান্নার প্রস্ত্ততির মাঝে কথা বলছেন, সবুজ উদ্যানে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলছেন, পরিবারের সব সদস্য নিয়ে খাবার টেবিলে মজে আছেন কিংবা খুব সাধারণ ভঙ্গিমায় মমতামাখা কোলে এক নাতিকে ঘুম পাড়িয়ে বর্ণনা করছেন জীবনের গল্প। এসব বাঙালি মায়েদের চিরচেনা জীবনাচার। এই জীবনাচারের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস, এক অমোচনীয় অধ্যায় তুলে আনার দক্ষতাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কারণ, বাঙালির নিজস্ব পরিচয় এখানেই। দর্শক হিসেবে যখন ওই ডকুড্রামার আয়নায় নিজের মুখ খুঁজতে যাই, ঠিকই পাওয়া যায়। দেশচেতনা মাথায় নিয়ে যাঁরা দেখেছেন, বিশ্বাস তাঁরাই খুঁজে পেয়েছেন। একটি ঐতিহ্যবাহী জাতিসত্তার নিজস্ব গল্প, যে-গল্পগুলোই আসলে আমাদের এই স্বাধীন ভূখ–র ঝঞ্ঝামুখর জন্ম আর শত অনিশ্চয়তা পেরিয়ে আলো দেখার অধ্যায়।
বাংলাদেশের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে অপরিমেয় শোক আর সেখান থেকে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো শক্তি উদ্গিরণের একেকটা অধ্যায়। সেখানে জাতিকে বারবার কেঁপে উঠতে হয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কাছে এসে। স্বাধীনতার মূল মন্ত্রক, কারিগর, শক্তি ও চেতনার বাতিঘরকে সপরিবারে আমাদের মাঝ থেকে সরিয়ে দেওয়ার হীন চেষ্টার মতো ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতার সামনে-পেছনে কী ছিল আসলে? নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধই বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত জয়-পরাজয়ের পর্ব নয়। সেই পথটি দীর্ঘ হয়ে আসে। বোঝা যায়, সংগ্রামের পথটি সুদীর্ঘ। স্বাধীনতার সাতচলিস্নশ বছরে এসেও ঠিক চিনে নেওয়া যায় শত্রম্ন-মিত্র। ভীত আর কাপুরুষোচিত একদল চেতনাবিরোধী ১৫ আগস্টের কলঙ্কিত আর রক্তাক্ত এক অধ্যায়ের জন্ম দেওয়ার পর জাতির জনকের দুই উত্তরসূরির পৃথিবীতে থাকে দুটি কর্তব্য। এক. হত্যাকারীদের শাস্তি, দুই. বাংলাদেশকে বাঁচানো। এই দুই শর্ত একে অন্যের পরিপূরক। সত্যিকার অর্থে এ দুটি কর্তব্য যেন কাঁধে উঠে যায় একাত্তরে উদিত স্বাধীন সূর্যটির। এই প্রত্যয়ই এসেছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সময়ের মধ্যে। বঙ্গবন্ধুই দুটি দায়িত্ব পালন করছেন তাঁর দৃপ্তকঠিন নেতৃত্বে তাঁর দুই আত্মজার মাধ্যমে। কোথাও শোক দাঁড়িয়ে থাকে মানুষকে কাঁদাতে, কোথাও শোক জেঁকে ধরে মানুষকে পাথর করে দিতে। জাতির জনকের দুই কন্যা পাথর হয়ে গিয়েছিলেন বটে; কিন্তু সেই পাথরেও ফুল ফুটেছে যখন জাতির জনকের উত্তরসূরি হিসেবে একটি জাতির দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে এসে পড়েছে। যার কেউ থাকে না, একটি ভূখ-, একটি মানচিত্র, একটি পতাকা স্বভাবতই তার জীবনসংসার হয়ে যায়। এই সত্যগুলো ভাসা ভাসা ভাবে সবার বিশ্বাসে ছিল, কিন্তু এমন বিমূর্ত বিষয়কে চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে মূর্ত করে তোলার প্রয়াসটি অনেক বড়।
কোনো নাটকীয়তা আর রিকনস্ট্রাকশনের আশ্রয় না নিয়ে শুধু বর্ণনাকে প্রধান কন্টেন্ট ধরে হাসিনা, আ ডটারস টেল একটি অনবদ্য নির্মাণ। এর কোনো অংশেই নেই অতিরঞ্জন, নেই রাজনৈতিক উগ্রতা, বরং শিল্পের সাবলীলতায় সবকিছু হয়ে উঠেছে তীব্র সত্যের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সূত্রমুখ। বলে রাখা ভালো, রাজনীতি আর শিল্পের হাত ধরাধরি করে চলার কথা থাকলেও বিশ্বব্যাপীই রাজনীতি হয়ে উঠছে উগ্র বিজ্ঞাপন রোগে আক্রান্ত। যেখানে রাজনৈতিক চারিত্র্য থাকে, সেখানে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরির আরোপিত সত্য, অসত্য কিংবা ব্যঞ্জনার ঘনঘটা আজকের দিনে বড় বেশি প্রচলিত। তাই শিল্প হয়ে ওঠে নিজস্ব গতির ডালপালা ছাঁটা অথবা রাজনীতির ছাঁচে ফেলা এক চর্বিতচর্বণ কিছু। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বিষয় হিসেবে নিয়ে এই দূষণমুক্ত হওয়া বড় শক্ত ব্যাপার। শিল্পের নির্মোহ জায়গায় থেকে এই শক্ত কাজটিই করতে পেরেছেন ডকুড্রামার নির্মাতা। অবশ্য, শিল্পের স্বাধীনতা সুরক্ষার ক্ষেত্রেও সুবিচার ও সুবিবেচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা।
লিখিত ইতিহাসের চেয়ে সুতীব্র হয়ে উঠেছে পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের আলোচিত ও কলঙ্কিত অধ্যায়গুলোর আবহ শৈল্পিকভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।
কান্নার দৃশ্য নেই; কিন্তু ভেতর থেকে দর্শকের চোখ ভিজে আসে। কিছু কিছু জায়গায় শৈল্পিক অথচ বাস্তবসম্মতভাবে দৃশ্যপট নির্মাণ করা হয়েছে; কিন্তু দর্শক তখন আর সেই তৈরির দিকে যাচ্ছেন না, দর্শক ঢুকে পড়েছেন জাতির জনকের দুই কন্যার অতি সাধারণ জীবনকাব্যে।
প্রসঙ্গত মনে করছি, চলতি বছর ফেব্রম্নয়ারিতে ভারতে একটি প্রামাণ্যচিত্র মুক্তি পায় অমর্ত্য সেনের ওপর। সুমন ঘোষ-নির্মিত দ্য আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান। শুধু অমর্ত্য সেনের অর্থনৈতিক চিন্তার গভীর বিষয়গুলো নিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন কথামালা ছাড়া ঢাকঢোল পিটিয়ে সিনেমা হলগুলোতে মুক্তি দেওয়া ওই প্রামাণ্যচিত্রে তেমন কিছুই খুঁজে পাননি দর্শক। প্রশ্ন হলো, একটি প্রবন্ধ কিংবা গবেষণা গ্রন্থের সঙ্গে চলচ্চিত্র কিংবা প্রামাণ্যচিত্রের মৌলিক পার্থক্যের একটি আবেদন থেকেই যায়। আলোছায়া, শব্দসুরের খেলায় সেই আবেদন যদি জেগে না ওঠে তাহলে তা একসঙ্গে দেখা, শোনা ও উপলব্ধি করার সামগ্রিকতা ছোঁবে কীভাবে? সে বিবেচনায় হাসিনা, আ ডটারস টেল সফল ও সার্থক একটি কাজ।
হাসিনা, আ ডটারস টেল প্রামাণ্যচিত্র দেখার পর সার্থক দুটি পট উপলব্ধিতে আসে। একটি হচ্ছে ‘শেখ হাসিনা’, অন্যটি হচ্ছে তাঁর মুখনিঃসৃত বাণীতে সুদীর্ঘ ইতিহাসের এক সংক্ষেপিত কথিকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে সুদীর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হতেই পারে, কিন্তু এই ডকুড্রামা সেরকম প্রচলিত প্রামাণ্যচিত্রের বৃত্ত ভেঙেছে। এখানে যেভাবে শেখ হাসিনা অঙ্কিত হয়েছেন তা অনবদ্য। জীবন, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার পরিণত প্রজ্ঞা মানুষকে কতটা সাধারণ করে তোলে, কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে তার প্রমাণ রেখে গেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঠিক সেই দৃঢ় ছায়াটি যেন পড়েছে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার মুখাবয়বে। যেখানে সহজেই স্থাপিত হতে পারে গণআস্থা।
ডকুড্রামার নির্মাণ-দক্ষতায় সত্যের সুতীব্র জায়গাটি আরো উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে। এখানে শিল্পের দায়টি পুরোপুরি কাঁধে নিয়েছেন নির্মাতা পিপলু খান। আর এর জন্য সাদিক খানের চিত্রগ্রহণের নৈপুণ্য ও দক্ষতা, খুব বেশি দূরের কিছু নয়, নিকটতম দৃশ্যগুলোই এক গভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। বলতে হবে, সুর সংযোজন ও আবহসংগীত আয়োজনের প্রসঙ্গও। চিরচেনা সুরগুলোর ব্যাকুল ও আর্তনাদধর্মী উপস্থাপন বলেছে অনেক কথা, দেখিয়েছে অনেক অজানা চিত্র। সবমিলিয়ে হাসিনা, আ ডটারস টেল নির্মাণ সময়ের ধারাবাহিক দাবির একটি পর্ব মেটাতে পেরেছে বলে মনে হয়। সেইসঙ্গে মনে হয়, এই একই ইস্যুতে আরো বহু কাজ বাকি।
তথ্যসূত্র: কালিও কলম