ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে সিয়াম বা রোজা অন্যতম একটি স্তম্ভ
ইসলামের মৌলিক রুকন বা ভিত্তি পাঁচটি। এর মধ্যে রোজা ও হজ চাঁদ দেখার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পবিত্র রমজান মাসের রোজা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে রোজা রাখে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
চাঁদ দেখা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘লোকেরা আপনাকে নতুন মাসের চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আপনি তাদের বলে দিন, এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজকর্মের) এবং হজের সময় নির্ধারণ করার জন্য।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৯)
আল্লাহ পাক রব্বুল আলাামিন কোরআনুল কারিমে রমজান মাসে যেমন রোজা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন তেমনি রোজায় করণীয় কী হবে তাও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। রোজার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ ঘোষণা দেন-
فَمَنۡ شَهِدَ مِنۡکُمُ الشَّهۡرَ فَلۡیَصُمۡهُ
‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।‘ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)
রমজান মাস। এ মাস পেলেই মুমিন মুসলমানের জন্য রোজা রাখা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। কোরআনুল কারিমে তিনি এ ঘোষণাই দিয়েছেন- ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি রমজান মাসে উপস্থিত থাকবে, বর্তমান থাকবে, তার উপর রমজান মাসের রোজা রাখা আবশ্যক কর্তব্য।’
পবিত্র কোরআনে সিয়াম রোজা সম্পর্কে আল্লাহপাক রব্বুল অলআমিন এরশাদ করেন
১.হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্যে সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া বা আল্লাহ ভীরুতা অবলম্বন করতে পারো। (সূরা বাকারাহ-১৮৩)
২.সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূর্ণ করবে। যাদের জন্য অতিশয় কষ্টদায়ক হয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদইয়া-একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্যে অধিকতর কল্যাণকর যদি তোমরা তা জানতে। (সূরা বাকারাহ-১৮৪)
৩.রমাজান মাস, এ মাসেই মানুষের জন্য আলোর দিশা এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে এবং কেউ অসুস্থ্য থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা সহজ তাই চান এবং যা তোমাদের জন্যে কষ্টকর তা চান না, এজন্যে যে তোমাদের সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মাহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো। (সূরা বাকারাহ-১৮৫)
৪.সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্যে তোমাদের স্ত্রীদের বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্যে এবং তোমরাও তাদের জন্যে পরিচ্ছদ। আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা তোমাদের নিজেদের সাথে খিয়ানত করছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদেরকে মার্জনা করেছেন, সুতরাং এখন তোমরা তাদের সাথে সংগত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন (অর্থাৎ সন্তান) তা অন্বেষণ করো। আর তোমরা আহার করো ও পান করো যতক্ষণ তোমাদের জন্যে (রাত্রির) কালো রেখা থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হয়ে যায়। এরপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো। আর তোমরা মসজিদে ই’তিকাফ অবস্থায় তাদের সাথে সংগত হয়ো না। এগুলো আল্লাহর (নির্ধারিত) সীমা, সুতরাং এর নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবেই আল্লাহ মানুষের জন্যে তার আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তারা তাকওয়া বা আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করতে পারে। (সূরা বাকারাহ-১৮৭)
রোজায় খাওয়া ও পান করা
রমজান মাসে নির্ধারিত একটি সময় খাওয়া ও পান করা নিষেধ। ভোর রাত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে কোনো হালাল খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা যাবে এটি মহান আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَکُمُ الۡخَیۡطُ الۡاَبۡیَضُ مِنَ الۡخَیۡطِ الۡاَسۡوَدِ مِنَ الۡفَجۡرِ۪ ثُمَّ اَتِمُّوا الصِّیَامَ اِلَی الَّیۡلِ
‘আর আহার করো ও পান করো যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। এরপর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)
এ নির্দেশনার মানে হলো, রাতে খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা যাবে কিন্তু ভোর রাত থেকে সূর্যান্ত পর্যন্ত সারাদিন খাবার ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে রোজা পূর্ণ করতে হবে। আর এটিই মহান প্রভুর নির্দেশ।
- যে কারণে রমজান মাস বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত
- এই মাসে কোরআনে কারিম নাজিল হয়েছে।
- এই মাসে লাইলাতুল কদর আছে।
- এই মাসে ইসলামের প্রথম জিহাদ বদর যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয়েছে।
- এই মাসে মক্কা বিজয় হয়েছে।
- রমজান মাসে বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।
- রমজান মাসে শয়তানকে শিকলে আবদ্ধ করা হয়।
- রমজান মাসে নফল ইবাদতের ফরজ ইবাদতের মর্যাদা আর ফরজ ইবাদতে সত্তর গুণ অধিক মর্যাদা।
রোজার মূল উদ্দেশ্য
রোজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মুত্তাকির গুণাবলী অর্জন করা। মুত্তাকির সার কথা হচ্ছে সর্ব অবস্থায় আল্লাহর ভয় অন্তরে জাগ্রত রাখা। অর্থাৎ সে হচ্ছে মুত্তাকি যে প্রতিটি কথা ও কাজে আল্লাহর আদেশ মেনে চলে। মানুষ যে কাজই করে না কেন তাতে দু’টি জিনিস অবশ্যই থাকবে- একটি তার উদ্দেশ্য অন্যটি সেই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য গৃহীত পন্থা।
শুধু রমজানের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তাকওয়ার গুণ অর্জিত হবে না। তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে হলে যে আল্লাহকে ভয় করে সাধ ও সাধ্য থাকার পরও দিনের বেলায় কোন খাবার খায় না, পানীয় পান করে না সেই আল্লাহকে ভয় করে বাকী সকল কাজ পরিচালনা করতে হবে।
কোনো ব্যক্তি রমজান মাসে দিনের বেলায় রোজা রাখলো রাতে মিথ্যা কথা বললো, ওজনে কম দিলো, ঘুষ বা সুদ খেল তাহলে সে সত্যিকারের রোজার সুফল থেকে বঞ্চিত হবে। সত্যিকারের রোজার সুফল পেতে হলে সব কথায় কাজে সর্ব অবস্থায় আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালন করতে হবে। আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ দুনিয়াতে যত লাভের হোক তা বর্জন করতে হবে আবার আল্লাহর আদেশ পালন দুনিয়ার জন্য যত ক্ষতির কারণ হোক না কেন তা পালন করতে হবে।
রোজা রাখার মাধ্যমে যে শিক্ষা অর্জন
- রোজা সময়ের যথাযথ ব্যবহার শেখায়। রমজানের প্রতিটি ইবাদতই সময়ের সঙ্গে জড়িত। যার ফলে মানুষ নিয়ম-শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হয়। রোজা মানুষের মধ্যে আল্লাহর নির্দেশ পালনের মানসিকতা তৈরি করে দেয়। নফসের দাসত্ব ও পাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। যারা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, তারা দুনিয়ার ধনি-গরিব সব মানুষের প্রতি সদয় থাকে।
- রমজান ঐক্যের শিক্ষা দেয়। দুনিয়ার সব মুসলমানকে এক কাতারে সামিল করে দেয় রমজান। ধনি-গরিব কিংবা আমির-ফকিরে কোনো বৈষম্য থাকে না। কেননা ইফতার-সাহরি গ্রহণে কেউই নিজেদের মধ্যে উঁচু-নিচু ভাব নেয় না। করে না সময়ের ব্যবধান।
- রমজান রোজা পালনের পাশাপাশি তারাবি-তাহাজ্জুদ পড়া এবং ইতেকাফের মাধ্যমে মানুষকে মসজিদমুখী করে গড়ে তোলে।
- রোজার বিধান পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ পালনে একনিষ্ঠ হয় রোজাদার। আর এভাবেই মানুষ মন্দ কাজ থেকে বিরত থেকে আল্লাহর ভয় অর্জনে উদ্বুদ্ধ হয়।
মহান আল্লাহর মহাঅনুগ্রহ যে, তিনি বান্দার ওপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পর্যাযে আদেশ-নিষেধ, উপদেশ দিয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে ফরজ তথা আবশ্যকীয় এবং হারাম তথা বর্জনীয় কাজ। অনুরূপ একটি ফরজ হচ্ছে রমজান মাসের সিয়াম বা রোজা পালন করা।
আল্লাহর পাক রব্বুলআলা আমিন দুনিয়া সব খারাপ কাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার মাধ্যমে আমাদের পবিত্র রমজানে তাকওয়া ও পরহেজগারি অর্জনের তৈফিক দান করুন।