পৃথিবীতে মা ছাড়া আমার আপন আর কেউ নেই,মা অনুমতি দিলে যুদ্ধে যাবো
আলাপচারিতা
ছবি:শহীদ মাগফার উদ্দিন চৌধুরী’র (আজাদ)
১৯৪৬ সালের ১১ই জুলাই জন্মেছিলেন তিনি। একাত্তরে জন্মভূমির জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদ আজাদ। তাঁর মা শ্রদ্ধেয় মোসাম্মাৎ সাফিয়া বেগম এবং বাবা তৎকালীন সময়কার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ইউনুস আহমেদ চৌধুরী।
শহীদ আজাদের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায়, আত্মসম্মান রক্ষার্থে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন সাফিয়া বেগম।
পরবর্তী সময়ে, এই মহীয়সী মানুষটি কঠিন পরিশ্রম করে ছেলেকে লেখাপড়া শেখান। মাধ্যমিকে আজাদ পড়েছিলেন সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। এইচএসসি’র পর করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
শহীদ মাগফার উদ্দিন চৌধুরী’র (আজাদ) মা মোসম্মাৎ সাফিয়া বেগম একজন অনন্য মা।
আজাদ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়ার পর মা প্রতিদিন এক বেলা রুটি খেয়েছেন। ভাত খাননি, এমনকি বিছানায় ঘুমাননি। কারণ, আজাদ মৃত্যুর আগে ভাত খেতে চেয়ে পাননি, থানায় শক্ত মেঝেতে কাটিয়েছেন রাত।
শহীদ আজাদ ও তার মায়ের এ ঘটনা অনেকেরই জানা। কিন্তু মায়ের এই আত্মত্যাগ পুরনো হওয়ার নয়। স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি আজাদ ও তার মা। মায়ের নির্দেশে আজাদ জীবন উৎসর্গ করেছেন বলেই স্বাধীন হয়েছে দেশ।
ছবি:মধ্যখানে কালো কোটি গায়ে আজাদ
ষাটের দশকের কথা। ধনী পরিবারের একমাত্র সন্তান আজাদ তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন। আজাদের বাবা আরেকটি বিয়ে করতে চান। কিন্তু আজাদের মা নিষেধ করেন। আজাদের বাবা তার কথা উপেক্ষা করে বিয়ে করেন। এতে আজাদের মা আজাদকে নিয়ে চলে আসেন ঐ বাড়ি থেকে। মগবাজারে ছোট একটি ঘর ভাড়া নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করতে শুরু করেন। খুব কষ্ট করে আজাদকে লেখাপড়া করান মা। অবশেষে ১৯৭১ সালে আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজধানী ঢাকা ও সারাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমন করে ঘর-বাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়। একের পর এক নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। পাক বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারেনি বাংলার ছেলেরা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
আজাদ, তার খালাতো ভাই ফেরদৌস আহমেদ জায়েদ, তার বন্ধু রুমী (জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী) ও অন্য বন্ধুরা পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় আজাদের এক বন্ধু তাকে বলেন, ‘তোমার বাবার বন্দুক ও পিস্তল আছে এবং তুমি এগুলো চালাতে জানো। তুমি তোমার বাবার কাছ থেকে বন্দুক নিয়ে আসো।’
বন্ধুদের এ কথা শুনে মায়ের কথা মনে পড়ে আজাদের।
আজাদের দুচোখ থেকে জল পড়তে থাকে। মায়ের কষ্টের কথা তার মনে পড়ে। আজাদ চোখ মুছে বন্ধুদের বলেন, পৃথিবীতে মা ছাড়া আমার আপন আর কেউ নেই। মা অনুমতি দিলে যুদ্ধে যাবো। মায়ের কাছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমিত চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার প্রয়োজন মেটাতে তোমাকে মানুষ করিনি, দেশের মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য করেছি। যুদ্ধে যাও, দেশ স্বাধীন করো।’
মায়ের এই দেশপ্রেমের কথা শুনে আজাদ আরো অনুপ্রাণিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। আজাদের বাসায় অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয় এবং গেরিলা যোদ্ধারা সেখানে আশ্রয় নেন। আগস্ট মাসের শেষে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আজাদের বাড়ি ঘেরাও করে নির্বিচারে গুলি চালায়। মুক্তিযোদ্ধা কাজি কামাল (বীর বিক্রম) পাল্টা গুলিবর্ষণ করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও আজাদ, জুয়েলসহ বাকিরা ধরা পড়েন।
আজাদ ও তার সঙ্গীদের সবাইকে তৎকালীন রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। মা সাফিয়া বেগম আজাদকে দেখতে এসে জানতে চান, ‘বাবা, কী অবস্থা?’ আজাদ জবাবে বলেন, ‘প্রচণ্ড মারধর করে, কে কোথায় যুদ্ধ করছে তা জানতে চায়। আমার খুব ভয় করছে।’
তখন আজাদের মা বলেন, ‘বাবা, ওরা মেরে ফেললেও কিছুই স্বীকার করবে না। তোমার বন্ধুসহ কারো নাম-ঠিকানা বলবে না।’
এরপর আজাদ বলেন, ‘মা, কত দিন ভাত খাই না। আমার জন্য ভাত নিয়ে এসো। ভাত খেতে ইচ্ছা করছে।’
পরদিন ভাত নিয়ে রমনা থানায় যান আজাদের মা। কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তানি সেনারা আজাদকে গুম করে ফেলে। তিনি অনেক খুঁজেও ছেলেকে আর পাননি।
দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু ফিরে আসেনি আজাদ। প্রতিদিন আজাদের জন্য অপেক্ষা করেছেন তার মা। অপেক্ষা করেছেন ছেলেকে ভাত খাওয়াবেন বলে। কিন্তু আজাদ আর ফিরে আসেনি। আজাদ ভাত চেয়েছিল, তাকে ভাত খাওয়াতে পারেননি বলে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভাত খান নি। শুধু একবেলা রুটি খেয়ে থেকেছেন।
আজাদকে রাজধানীর নাখালপাড়ায় ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এম.পি হোস্টেলে পাকিস্তানি মিলিটারি টর্চার সেল-এ নির্যাতন করে মেঝেতে ফেলে রাখা হতো। আজাদ বিছানা পান নি- এই কষ্টে মা ১৪ বছর বিছানায় ঘুমান নি, মেঝেতে শুয়েছেন শীত–গ্রীষ্ম সব ঋতুতে।
আজাদের মনোবল ভেঙে তার কাছ থেকে অন্য গেরিলা সহযোদ্ধাদের তথ্য জানতে জামায়েত নেতা রাজাকার মোহাম্মদ কামারুজ্জামান আজাদের মাকে আজাদের কাছে নিয়ে আসে। রাজাকার কামারুজ্জামান রমনা থানায় বসে আজাদের মাকে বলে “সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনে আজাদের সাথে যারা অংশগ্রহণ করেছিলো সেইসব সহযোদ্ধারা কোথায় আছে সেটা যদি আজাদ পাকি সেনাদেরকে জানিয়ে দেয় তবে আজাদকে মুক্তি দেয়া হবে”।
পাকিস্তানী রাজাকার আর সেনাবাহিনী আশা করে সন্তানের জীবন বাঁচাতে আজাদের মা হয়তো আজাদকে সহযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করতে বলবে। কিন্তু রাজাকার আর পাকিস্তানী সেনারা কিভাবে বুঝবে এদেশের মায়েদের দেশপ্রেম আর সততার গভীরতা। আজাদের কাছে মা জানতে চাইলেন ‘কেমন আছো’, আজাদ মাকে বললেন, ‘খুব মারে, ভয় হচ্ছে কখন সব স্বীকার করে ফেলি’। ছেলের সামনে তিনি ভেঙ্গে পড়েন নি। বরং ছেলেকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো বাবা। কোন কিছু স্বীকার করবে না’।
১৯৮৫ সালের ৩০শে আগস্ট (ঠিক ১৪ বছর পর) ছেলের কাছে চলে যান শ্রদ্ধেয় মোসাম্মাৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা।দেশ স্বাধীন হয় কিন্তু আজাদ ফেরে না। মা অপেক্ষা করতে থাকে দীর্ঘ ১৪ টি বছর।এই ১৪ বছর তিনি ভাত খাননি, হাপাঁনী থাকা সত্ত্বেও মাটিতে মাদুর বিছিয়ে শুতেন । কারণ তার ছেলে জেলখানায় মাদুরে শুতেন।
১৯৮৫ সালের ৩০ শে আগস্ট, মারা যাওয়ার আগেই তিনি বলে গিয়েছিলেন তার কবরের ফলকে পরিচয় হিসেবে লিখতে ‘শহীদ আজাদের মা’। তাই আজও জুরাইনে তার কবরে লেখা ‘মোসাঃ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা’।