বছর ঘুরে আবার আসছে মাহে রমজান,হিজরি বর্ষ গণনা করা হয় চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে ।। রমজান ও রোজা সংক্রান্ত মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ আয়াত ও হাদিস
বছর ঘুরে আবার আসছে মাহে রমজান। পবিত্র এই মাসে বিশ্বের শতকোটি ধর্মপ্রাণ মুসলিম রোজা পালন করেন।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজান মাসের রোজা ও ইবাদত আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাত লাভের সুবর্ণ সুযোগ। যারা ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজানের রোজা রাখবে, তাদের পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যারা ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজানের রাতে ইবাদত করবে, তাদের পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। আর যারা ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে শবে কদরে ইবাদত করবে, তাদের পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।
হিজরি বর্ষ গণনা করা হয় চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে। এখন চলছে শাবান মাস। সেই হিসাবে এবার কবে থেকে রমজান মাস শুরু হতে পারে, তা জেনে নেওয়া যাক।
হিজরি মাস সাধারণ ২৯ অথবা ৩০ দিনের হয়ে থাকে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ১০ মার্চ হিজরি ২৯ শাবান। এদিন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন অর্থাৎ ১১ মার্চ থেকে এসব দেশে পবিত্র রমজান মাস শুরু হবে। তবে এবার শাবান মাস ৩০ দিনের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সে ক্ষেত্রে সৌদি আরবসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ১২ মার্চ অর্থাৎ আগামী মঙ্গলবার থেকে রোজা শুরুর সম্ভাবনা বেশি।
উল্লেখ্য, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় ১০ মার্চ হিজরি ২৯ শাবান হলেও বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোয় এর পরদিন অর্থাৎ ১১ মার্চ ২৯ শাবান।
যুক্তরাজ্যে চাঁদ দেখার কাজ করে নটিক্যাল আলমানাক অফিসের অধীন ক্রিসেন্ট মুন ওয়াচ। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১০ মার্চ গ্রিনিচ মান সময় (জিএমটি) বিকেল ৫টা ২৩ মিনিটে চাঁদ উঠতে পারে। সেই হিসাবে সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীতে তখন সময় হবে রাত ৮টা ২৩ মিনিট ও বাংলাদেশে তখন সময় হবে রাত ১১টা ২৩ মিনিট। অর্থাৎ সেদিন রাতে খালি চোখে সৌদি আরব বা বাংলাদেশ থেকে পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখার সম্ভাবনা একেবারে কম।
আগামী ১০ মার্চ পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখা যাবে শুধু প্রশান্ত মহাসাগরের অল্প কিছু এলাকায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপূঞ্জে ও ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার কিছু এলাকা থেকে দেখা যেতে পারে। সেদিন খালি চোখে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে চাঁদ দেখার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ।
যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে, তাহলে খালি চোখে বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চল থেকে ১১ মার্চ পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বলা হচ্ছে। তবে সেদিনও অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণাঞ্চল, তাসমানিয়া ও নিউজিল্যান্ড থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে চাঁদ দেখার সম্ভাবনা আছে।
এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সৌদি আরবসহ বেশির ভাগ দেশে রোজা শুরু হতে পারে আগামী ১২ মার্চ থেকে। আর বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে রোজা শুরু হতে পারে ১৩ মার্চ থেকে।
রমজান ও রোজা সংক্রান্ত মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ আয়াত ও হাদিস
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মাহে রমজান ও রোজা সম্পর্কে একাধিক আয়াত নাজিল করেছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক হাদিসেও রমজান এবং রোজা বিষয়ক দিক-নিদের্শনা রয়েছে।
১. হে মুমিনগণ, তোমাদের জন্যে সিয়ামের (রোজা) বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো। (সুরা আল বাকারা: আয়াত ১৮৩)
২. সিয়াম (রোজা) নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূর্ণ করবে। এটি যাদের সাতিশয় কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদিয়া- একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম (রোজা) পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণ কর যদি তোমরা জানতে। (সুরা আল বাকারা: আয়াত ১৮৪)
৩. রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম (রোজা) পালন করে এবং কেউ অসুস্থ থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না, এজন্যে যে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো। (সুরা আল বাকারা: আয়াত ১৮৫)
৪. সিয়ামের (রোজার) রাতে তোমাদের জন্যে তোমাদের স্ত্রীদের বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্যে এবং তোমরাও তাদের জন্যে পরিচ্ছদ। আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা তোমাদের নিজেদের সাথে খিয়ানত করছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদেরকে মার্জনা করেছেন, সুতরাং এখন তোমরা তাদের সাথে সংগত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন (অর্থাৎ সন্তান) তা অন্বেষণ করো। আর তোমরা আহার করো ও পান করো যতক্ষণ না তোমাদের জন্যে (রাত্রির) কালো রেখা থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হয়ে যায়। এরপর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো। আর তোমরা মসজিদে ইতেকাফ অবস্থায় তাদের সাথে সংযত হয়ো না। এগুলো আল্লাহর (নির্ধারিত) সীমা, সুতরাং এর নিকটবর্তী হয়ো না। এভাবেই আল্লাহ মানুষের জন্যে তাঁর আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারে। (সুরা আল বাকারা: ১৮৭)
১. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব-সহ রমজান মাসের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বোখারি ও মুসলিম)
২. হযরত সাহল বিন সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাতের একটি দরজা আছে, একে ‘রাইয়্যান’ বলা হয়, এই দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন একমাত্র রোজাদার ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া অন্য কেউ এই পথে প্রবেশ করবে না। সেদিন এই বলে আহ্বান করা হবে, ‘রোজাদারগণ কোথায়?’ তারা যেন এই পথে প্রবেশ করে। এভাবে সকল রোজাদার ভেতরে প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। অতঃপর এ পথে আর কেউ প্রবেশ করবে না। (বোখারি ও মুসলিম)
৩. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, রোজা ঢাল স্বরূপ, তোমাদের কেউ কোনদিন রোজা রাখলে তার মুখ থেকে যেন অশ্লীল কথা বের না হয়। কেউ যদি তাকে গালমন্দ করে অথবা ঝগড়ায় প্ররোচিত করতে চায়, সে যেন বলে, আমি রোজাদার। (বোখারি ও মুসলিম)
৪. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সাওয়াব দশগুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলেন, রোজা এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। কেননা ইহা একান্ত আমারই জন্যে। অতএব আমিই এর প্রতিদান দেবো। রোজা পালনে আমার বান্দা আমারই সন্তুষ্টির জন্যে স্বীয় ইচ্ছা, বাসনা ও পানাহার পরিত্যাগ করে থাকে। রোজাদারের জন্যে দুটি আনন্দ। একটি ইফতারের সময় এবং অন্যটি তার প্রতিপালক আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। নিশ্চয় জেনে রেখো, রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট সুগন্ধি হতেও অনেক উত্তম। (বোখারি ও মুসলিম)
৫. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের নিকট রমজান মাস উপস্থিত। উহা এক অত্যন্ত বরকতময় মাস। আল্লাহ তায়ালা এ মাসে তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ উন্মুক্ত হয়ে যায়, এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এ মাসে বড় বড় শয়তানগুলো আটক করে রাখা হয়। আল্লাহর জন্যে এ মাসে একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও অনেক উত্তম। যে লোক এ রাত্রির মহা কল্যাণ লাভ হতে বঞ্চিত থাকলো, সে সত্যিই বঞ্চিত ব্যক্তি। (বোখারি ও মুসলিম)