সত্যের বিপরীতই মিথ্যা। যা সত্য নয় তাই মিথ্যা। এমন কিছু বলা, যা প্রকৃত পক্ষে ঠিক নয় বা সত্য নয় তাই মিথ্যা।
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে বেশ আবেগপ্রবণ প্রাণী। ফলে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াও আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ২০০১ সালে সাইকোলজিক্যাল রিভিউয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জোনাথন হাইড সেখানে বলেছিলেন, মানুষ যখন নৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আবেগ দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। হয়তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর একজন ব্যক্তি তার পেছনে অসংখ্য যুক্তি দেখাতে পারে। কিন্তু আদতে ওই সব যুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় না। সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় চোখের পলকে, আর তাতে মূল ভূমিকা রাখে ব্যক্তিগত আবেগ বা চেতনা।
আমাদের এক-তৃতীয়াংশ রোজ মিথ্যা বলে
“প্রতিদিনই জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ গুরুতর মিথ্যা বলে”-মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়াইজম্যান বলেছেন।
এবং যদিও সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে, পাঁচ শতাংশ মানুষ দাবি করেছে যে তারা কখনোই মিথ্যা বলেনি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে আমাদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করে চালানো জরিপেও সত্যি বলতে অপারগ…
রাজনীতিবিদেরা মিথ্যায় পটু হয়ে উঠেছেন
২০০১ সালে সাইকোলজিক্যাল রিভিউয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জোনাথন হাইড সেখানে বলেছিলেন, মানুষ যখন নৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আবেগ দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। হয়তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর একজন ব্যক্তি তার পেছনে অসংখ্য যুক্তি দেখাতে পারে। কিন্তু আদতে ওই সব যুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় না। সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় চোখের পলকে, আর তাতে মূল ভূমিকা রাখে ব্যক্তিগত আবেগ বা চেতনা।
জোনাথন হাইডের এই গবেষণা এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ বর্তমানে এমন এক দুনিয়া সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে রাজনীতিবিদেরা মিথ্যায় পটু হয়ে উঠেছেন। মিথ্যা বলার সেই চিত্র বুঝতে হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মতো নেতাদের দেখতে হবে। একনায়ক শাসকেরা সব সময়ই মিথ্যা বলে এসেছেন। উত্তর কোরিয়ার কিম জং–উন বা রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের ‘সত্যরূপী মিথ্যা’ তাই আর বিস্ময় জাগায় না। কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর নেতাদের অবলীলায় একের পর এক মিথ্যা বলা এবং তা সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা চোখ কপালে তোলে বৈকি। এই বৈশ্বিক প্রবণতাই পরে সংক্রমিত হয় আঞ্চলিক রাজনীতিতে এবং একসময় তা ঢুকে পড়ে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনেও।
ট্রাম্প-জনসন-মোদিদের মিথ্যার রূপ
ট্রাম্প-জনসন-মোদিদের মিথ্যার রূপ ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’–এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সংবাদমাধ্যমে চাকরি করতে গিয়ে বরখাস্ত হয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ ছিল, একটি উক্তি নিজে বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি! আদতে ওই উক্তি কেউ করেনি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করে আসছেন, পাকিস্তানের একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান নাকি ভারতীয় বিমানবাহিনী ভূপাতিত করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তে দেখা গেছে, পাকিস্তানের সব এফ-১৬ যুদ্ধবিমান অক্ষতই আছে। অবশ্য মোদি ওই দাবি থেকে সরে আসেননি। বরং গেল লোকসভা নির্বাচনে এই ‘বীরত্বের খবর’ বেশ ভালো ভোট টেনেছে।
‘ওয়াশিংটন পোস্ট’–এর হিসাব বলছে, মার্কিন মুলুকে মিথ্যার নহর বইয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে আসার পর থেকে গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১৩ হাজার ৪৩৫টি মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছেন ট্রাম্প। এত মিথ্যার তোড়েই হয়তো সম্প্রতি রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে টুইটার কর্তৃপক্ষ। ফেসবুক অবশ্য এখনো সেই রাস্তায় হাঁটেনি।
এত এত মিথ্যা বলেও মিথ্যুকদের কিছু আসছে–যাচ্ছে না।
কিন্তু এত মিথ্যার কোনো বাজে প্রভাব কেন পড়ছে না? বিশ্লেষকদের মতে, একটি কারণ হতে পারে যে এত মিথ্যার তোড়ে সবার বুদ্ধি-বিবেচনা ভেসে গেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে উচ্চমাত্রায় মিথ্যা বলেন, তা অনেকে হয়তো ভাবতেই পারেননি। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অত্যধিক হারে মিথ্যা বলার কারণে অনেকে হয়তো ভাবতেই পারছেন না, কেউ কি এত মিথ্যা বলতে পারে?
আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও কিন্তু মিথ্যার প্রভাব অনেক। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সিংহভাগ মানুষ আসলে মিথ্যা ধরতেই পারে না। বার্মিংহামের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামার গবেষক টিম লেভিন এই বিষয়ে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করেছেন। মোট ৩০০টি পরীক্ষা চালিয়ে তিনি দেখেছেন, প্রায় অর্ধেক সময়ই মানুষ মিথ্যা ধরতেই পারেনি। খুব অল্পসংখ্যক মানুষ মিথ্যা চিহ্নিত করতে পারে। এমনকি পুলিশ বা গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও আমজনতার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। মিথ্যা ধরতে তারাও খুব একটা পটু নন।
আমাদের চারপাশে অনেকেই আছেন ডাহা মিথ্যাবাদী। তাঁদের তাৎক্ষণিক মিথ্যা বলার অসম্ভব ক্ষমতা দেখে অবাক হতে হয়। রীতিমতো দিনকে রাত, রাতকে দিন বানিয়ে ছাড়েন তাঁরা। নিজেকে অন্যের কাছে বড় করে দেখাতে এমন সব মিথ্যা গল্প ফাঁদেন, শুনলে শ্রোতার নিজেকেই বরং অসহায় মনে হয়। আবার রাস্তায়-গাড়িতে, ফুটপাতে পণ্য বিক্রি করেন যে হকার-ক্যানভাসাররা, তাঁদের ‘কোম্পানির প্রচারের স্বার্থে’, ‘বিফলে মূল্য ফেরত’ কিংবা ‘তেলেসমাতি সমাধান’-এর দ্রুত কথনে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না! কৌতুক অভিনেতাদের অতিরঞ্জিত মিথ্যা কথনও আমাদের হাসির খোরাক জোগায়।অনেক সময় ব্যবসায়ীরা মিথ্যা বলেন। মুনাফা অর্জনের জন্য তারা কৌশল হিসেবে গ্রাহকের সঙ্গে হেসে হেসে মিথ্যা বলেন। তারা প্রায়ই বলেন, এই দরে তারা কিনতেও পারেননি বা তাদের মুনাফা হচ্ছে না। বিনা মুনাফায় বেচে দিতে হচ্ছে। তার পণ্যের চেয়ে ভালো মান আর কোথাও নেই ইত্যাদি।
মিথ্যা অনেকের জীবন পর্যন্ত শেষ করে দেয়। যেমন মামলা-মোকদ্দমা কিংবা বিচার-আচারে গিয়েও কেউ কেউ মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। অথচ এই মিথ্যা কিছুদিন চাপা পড়ে থাকলেও চিরদিন চাপা থাকে না। একদিন না একদিন মিথ্যা প্রকাশ হয়ে পড়ে। আর মিথ্যাবাদীর মুখোশ খুলে পড়ে। মিথ্যাবাদীকে কেউ ভালোবাসা দূরে থাক আসলে মনেপ্রাণে সবাই মিথ্যাবাদী থেকে দূরে থাকতে চায়। মিথ্যাবাদীর ওপর বিশ্বাস কখনোই ফিরে আসে না। এ কারণে মিথ্যাবাদীকে প্রায়ই বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। কারণ বিপদে পড়লেও মানুষ তাকে বিশ্বাস করতে চায় না।
ধর্ম কি বলে
মিথ্যা সমস্ত পাপের মূল। যেমন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«َإِنَّ الكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الفُجُورِ، وَإِنَّ الفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ»
“আর মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়, পাপ তাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।”
মিথ্যা প্রথম যখন অন্তর থেকে মুখে সংক্রমিত হয় তখন তা জবানকে নষ্ট করে দেয়, অতঃপর যখন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সংক্রমিত হয় তখন তা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ ধ্বংস করে দেয় যেভাবে জবানের কথা ধ্বংস করে দেয়। তখন মিথ্যা তার কথাবার্তায়, কাজে-কর্মে, চলা-ফেরায় সর্বত্র বিরাজ করে এবং তার ওপর ধ্বংস আধিপত্য লাভ করে। তখন এ ব্যাধি তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ যদি সত্যের ঔষধ দ্বারা তাকে সুস্থ না করেন তাহলে এ ব্যাধি তার মূল সত্ত্বাকে গ্রাস করে নেয় যা তাকে ধ্বংস করে দেয়।
এ জন্যই অন্তরের সব কাজের মূল হলো সত্যবাদীতা। সত্যবাদীতার বিপরীত হলো লৌকিকতা, আত্মভিমান, অহংকার, দম্ভ, ঔদ্ধত্য, অন্যায়, অক্ষমতা, অলসতা, ভীরুতা, লাঞ্ছনা ইত্যাদির মূল হলো মিথ্যাচার। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব ভালো কাজের উৎস হলো সত্যবাদীতা এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব খারাপ কাজের উৎস হলো মিথ্যাবাদীতা। আল্লাহ মিথ্যাবাদীকে কল্যাণ ও উপকারী কাজ থেকে সরিয়ে রেখে তাকে শাস্তি প্রদান করবেন। অন্যদিকে সত্যবাদীকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণকর কাজের তাওফীক দান করে পুরস্কৃত করবেন। সত্যবাদীতার ন্যায় দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণকর গুণ নেই, আবার মিথ্যাবাদীতার মতো জঘন্য খারাপ ও ক্ষতিকর দোষও আর নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَكُونُواْ مَعَ ٱلصَّٰدِقِينَ ١١٩ ﴾ [التوبة: ١١٩]
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১১৯] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন,
﴿هَٰذَا يَوۡمُ يَنفَعُ ٱلصَّٰدِقِينَ صِدۡقُهُمۡ١١٩﴾ [المائدة: ١١٩]
“এটা হল সেই দিন যেদিন সত্যবাদীগণকে তাদের সততা উপকার করবে।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ১১৯]
মিথ্যাবাদী শাসক : হাদিসে মিথ্যাবাদী শাসকের শাস্তি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ শাসকের যেহেতু অন্যদের কাছে জবাবদিহি থাকে না এবং সে সত্য বললে শাসিতের মতো বিপদগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই, তাই তার মিথ্যা বলা বেশি দোষের। আধুনিক যুগের মুহাদ্দিসরা বলেন, কর্মী ঠকানোর জন্য নিয়োগদাতা যদি মিথ্যা বলে, তবে সে-ও এই হাদিসের অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা কর্মীর কাছে তার কোনো জবাবদিহি নেই।
মিথ্যা শপথকারী পণ্য বিক্রেতা : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কিয়ামতের দিন আল্লাহ কথা বলবেন না এবং তাদের দিকে তাকাবেন না। এক. যে লোক তার মালের ওপর এ মিথ্যা কসম করে যে একে এখন যে মূল্যে বিক্রি করা হলো, এর চেয়ে বেশি মূল্যে তা বিক্রয় করা যাচ্ছিল, দুই. যেকোনো মুসলিমের সম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য আছরের সালাতের পর মিথ্যা শপথ করে, তিন. যে প্রয়োজনের বেশি পানি আটকিয়ে রাখে। আল্লাহ তাকে উদ্দেশ করে কিয়ামতের দিন বলবেন, আজ আমি আমার অনুগ্রহ থেকে তোমাকে বঞ্চিত করব, যেমনি তুমি সে অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করতে, যা তোমার হাতে অর্জিত নয়। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৪৪৬)
উল্লিখিত হাদিসে কসম করে পণ্য বিক্রেতা প্রতারণা, অন্যায়ভাবে অর্থ আত্মসাৎ ও বাজারের স্বাভাবিক মূল্যপ্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।