বৈদ্যনাথতলা
মেহেরপুর শহর থেকে ১৬ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মুজিবনগর পরিচয়ে ইতিহাসের অঙ্গীভূত বৈদ্যনাথতলা একটি প্রাচীন জায়গা। এ স্থানটি ছিল মেদিনিপুর জমিদারী কোম্পানীর। এই জমিদারীর এলাকা ছিল সোনাপুর, ভবরপাড়া, মাঝপাড়া, পাথুরি ও হৃদয়পুর গ্রাম। কোম্পানীর কর্মচারী নদীয়া জেলার চাপড়া থানার হৃদয়পুর নিবাসী বৈদ্যনাথ বাবু নিজবুদ্ধি বলে হৃদয়পুর অঞ্চলের জমিদারীর আট আনা অংশ কোম্পানীর কাছ থেকে পত্তনী বন্দোবস্ত গ্রহণ করেন।
বৈদ্যনাথ আট আনা অংশ পত্তনী নেওয়ার সাথে সাথেই রামনগর গ্রামের জমিদার কেদারনাথ রায় অবশিষ্ট আট আনা পত্তনী গ্রহণ করেন। কেদারনাথের বাগান করার সখ ও নেশা ছিল। নিজ নামে বন্দোবস্ত নেওয়া আট আনা অংশে তিনি ভবরপাড়া, সোনাপুর ও মাঝপাড়ার অংশবিশেষ লাভ করেন।
১৯০৫-১৯১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে জমিদার কেদারনাথ রায় ১০৫ বিঘা জমির ওপর সারিবদ্ধ আমের বাগান তৈরীর কাজ শুরু করেন। এই বাগানে প্রাথমিক পর্যায়ে ২২০০ আঁটি আমের গাছ লাগানো হয়। ১০/১৫ জন মালী রাতদিন এই বাগানের সার্বিক তত্বাবধানে নিযুক্ত থাকতেন। তাদের সর্দার ছিলেন গৌরীনগর গ্রামের পালান শেখ।
হৃদয়পুরের জমিদার বৈদ্যনাথ ১৮৯০ সালের দিকে নিজ উদ্যোগে ভবরপাড়া গ্রামের সন্নিকটে হাট বসানোর উদ্যোগ নেন। হাটটি নদীয়া জেলার অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং হাটের স্থানটি বৈদ্যনাথতলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। প্রতি মঙ্গলবারে বসা এই হাটে আশে পাশের ১২৮টি গ্রামের লোকজন কেনাবেচা করতে আসতেন।
হৃদয়পুরের জমিদার যেমন তার প্রতিষ্ঠিত বৈদ্যনাথতলা হাটের সমৃদ্ধি ঘটাতে থাকেন রামনগরের জমিদার কেদারনাথ রায় তেমনি তার সৃজিত বাগানের সৌকর্যে এলাকাবাসীকে মুগ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু এক সময়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য ও শত্রুভাবের সৃষ্টি হয়। হাট বসানো নিয়ে ১৯৪০ সালের দিকে তাদের মধ্যে বিরোধ বাধে।
এই বিরোধের ফলে বৈদ্যনাথতলার হাটটি নির্ধারিত স্থানে বসা বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকে সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবারে নির্ধারিত হাটটি কেদারনাথ রায়ের সৃজিত আমবাগানে বসতে থাকে। কিন্তু পরিস্থিতির কী পরিহাস, এই হাটটি কেদারনাথ রায়ের আমবাগানে বসলেও জনসাধারন্যে এর বৈদ্যনাথতলা হাট পরিচিতি অব্যাহত থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর আমবাগানের হাটটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় রয়ে যায় এর বৈদ্যনাথতলা নাম। যা কালের আবর্তনে ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশে মুজিবনগর নামে ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে।
সাত কোটি সংগ্রামী মানুষের প্রতীক মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ
১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের। স্মৃতিসৌধটি ২৩টি ত্রিভুজাকৃতির দেয়ালের সমন্বয়ে গঠিত। ২৩টি দেয়ালই পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনের প্রতীক। ৩৯ দশমিক ৩৭ একর জমির ওপর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় ১৯৭৮ সালে। আড়াই ফুট উচ্চতার গোলাকার বৃত্তে শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন স্থান পেয়েছে। সাত কোটি সংগ্রামী মানুষের প্রতীক প্রতিফলিত হয়েছে তিন ফুট উচ্চতায় নির্মিত অপর বেদিটিতে। মাঝখানে লালমঞ্চে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্মৃতিসৌধের ভেতরে মাঝখানে আয়তাকার সিরামিকের ইট দিয়ে তৈরি লালমঞ্চ যেখানে অস্থায়ী সরকার এখানে শপথ গ্রহণ হয়েছিল। মঞ্চের পিছনের ৯টি দেয়ালকে ক্রমান্বয়ে দৈর্ঘ্য ১ ফুট ও উচ্চতা ৯ ইঞ্চি করে বাড়ানো হয়েছে, যা দ্বারা বোঝানো হয়েছে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার জন্য ৯ মাস ধরে যুদ্ধ করেছিল। প্রতিটি দেয়ালের ফাঁকে অসংখ্য ছিদ্র আছে, যেগুলোকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের চিহ্ন হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধটির ভূমি থেকে দুই ফুট ছয় ইঞ্চি উঁচু বেদিতে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত রয়েছে, যা দ্বারা এক লাখ বুদ্ধিজীবীর খুলিকে বোঝানো হয়েছে। স্মৃতিসৌধের ভূমি থেকে তিন ফুট উচ্চতার বেদিতে অসংখ্য পাথর রয়েছে, যা দ্বারা ৩০ লাখ শহীদ ও মা-বোনের অত্যাচারের দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। পাথরগুলো মাঝখানে ১৯টি রেখা পূর্ব পাকিস্তানের ১৯টি জেলাকে বোঝানো হয়েছে। বেদিতে ওঠার জন্য ১১টি সিঁড়িকে মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১টি সেক্টরকে বোঝানো হয়েছে। স্মৃতিসৌধের পশ্চিম পাশে প্রথম দেয়ালের পাশ দিয়ে শহীদের রক্তের প্রবাহ তৈরি করা হয়েছে, যাকে রক্তসাগর বলে।