গাংনীর উত্তরপাড়া থেকে পশ্চিম মালসাদহ— বিশাল এলাকা জুড়ে অভিজাত আবাসিক পল্লী। নাম: বসুন্ধরা। বাঁশবাড়িয়া, ঝিঙের পুল, শিশিরপাড়া, চৌগাছা, থানারপাড়ায় নতুন স্থাপত্য রীতির অগণিত দোতলা, তিনতলা, চারতলা পাকাবাড়ি।
পৌর ভবনের পশ্চিমে আধুনিক ধাঁচের সন্ধানী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, দক্ষিণে চৌধুরী টাওয়ার। হাসপাতালের পশ্চিমে সরকারি কলেজ, তার পাশে উকিল-মোক্তার, শিক্ষক ও উঠতি ব্যবসায়ীদের হাল ফ্যাশানের চকচকে বাসাবাড়ি। মালসাদহ থেকে হাটবোয়ালিয়া হয়ে মাথাভাঙা ব্রিজ পেরিয়ে আলমডাঙ্গা পর্যন্ত ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ভাঙাচোরা যে-রাস্তাটি, তা দু দশক আগেই পাকা হয়ে গেছে। রাস্তার দু ধারে পাকা দালান, আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে ‘হরপ্পা কনস্ট্রাকশনে’র সুরম্য প্রাসাদ।
বাড়ির সামনে সরু উঠোন, উঠোন জুড়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন। ঘরগুলো দেখে মনে হয় কোনো এক ‘নতুন দেশে এলেম’। গোপালনগর পেরুলেই ফিলিং স্টেশন, বিপণিকেন্দ্রে, সুরম্য ইশকুল বাড়ি, ডেইরি-পোলট্রি ফার্মে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির কোলাহল। আমাদের অর্থনীতির দুই পাওয়ার হাউস: রেমিট্যান্স আর আধুনিক কৃষি ও খামারের দৌলতে গাংনীর পুব অঞ্চলের গ্রামগুলো এক দশক আগেই বদলে গেছে। ভাট-পুটুস,বন শিউলি-ঘেরা কাদায় থিকথিকে গ্রাম আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। বামন্দী থেকে করমদি হয়ে সীমান্তবর্তী সহড়াতলা পর্যন্ত পাওয়া যাবে শহুরে রুজ লিপিস্টিকের কটুগন্ধ।
বামন্দী, সাহারবাটী, ধানখোলা যেন কোনো এক নতুন মেট্রোপলিটনের উঠতি মধ্যবিত্তদের উপনিবেশ। এখানে গ্রাম কোথায়! গ্রাম নেই।
নেই হিজলের ছায়া, নেই নলখাগড়ার দাম, নেই বুনো হাঁস-শামকুলের ভিড়। দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ চিরে জেগে উঠছে কেবলই চোখ-ধাঁধানো অট্টালিকা, ব্রিজ, বিপণিবিতান, ইকোপার্ক, মডেল মার্কেট আরও কত কী! আমাদের চারপাশটা কেমন যেন অন্য রকম হয়ে উঠছে! গ্রামের বাড়িতেও এখন প্রসাধনকক্ষ, সান-বাঁধানো পুকুরঘাট, ড্রয়িং রুমে ঝাড়বাতি আর বারান্দা-লাগোয়া বাগানবিলাসের ঝাড়। পথের ধারে মায়াবী ভেজা-শরীরের ‘কবরী’দের আর দেখা মেলে না! ঘুঙুর-নূপুর পায়ে কলস হাতে পুকুরঘাটে আর কেউ স্নান করে না। বাড়িতেই ওদের স্নানঘর!
মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া থেকে আসা বসন্তের উতল হাওয়া আর বাংলার সোঁদা মাটি থেকে উৎপাদিত সবজি-ফল, শস্যদানা ওদের সবকিছু বদলে দিয়েছে। মহামারির মধ্যেও এই বদলে যাওয়ার খেলা বা রূপান্তর প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি।
সারাদেশে গ্রামগুলিতেই লেগেছে এই পালা বদল ও রূপান্তরের ঢেউ। এই রূপান্তরের দোলায় গড়ে উঠেছে একটি নব্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণি। গাংনী কিংবা মেহেরপুরের মতো মফস্বল শহর তো বটেই, মেট্রোপলিটন হতে চাওয়া ঢাকাও এখন এই উঠতি নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির দখলে। এরাই এখন গ্রাম-মফস্বল শহরের স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রক; ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজার-বিপণীর মালিক। এদের প্রবল উপস্থিতিতে সরগরম থাকে শহরতলির হোটেল রেস্তোরাঁ, চা স্টল কফি হাউস। এদের দাপটে বনেদি মধ্যবিত্তরা এখন দারুণভাবে কোনঠাসা। ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে যে-মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে, তারা ছিলেন মূলত পেশাজীবী তথা চাকরিজীবী। এদের মধ্যে ছিলেন লেখক, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক। এরা ছিলেন শিল্প-সাহিত্য, সংগীত-নাটক-থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক এবং সুশাসন-গণতন্ত্রের অনুগামী। সমাজের মধ্যমণি। এরা যাদের ভালো বলতেন, তারা সমাজে ‘ভালো লোক’ হিসেবে গণ্য হতেন। এরা যাকে নেতা বানাতেন, তারাই নেতা হতেন।
শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমেদও মূলত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির-ই নেতা ছিলেন। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামাজিক দায়বদ্ধতা ছিল; ছিল গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবিক সমাজ নির্মাণের আকাঙ্খা।
বনেদি মধ্যবিত্ত বিশেষত প্রকৌশলী, চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদরা একুশ শতকের প্রারম্ভেই পশ্চিমা দেশগুলোয় পাড়ি জমাতে শুরু করেন। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও পুরোধারাও চলে গেছেন ইতোমধ্যে। চলে গেছেন মেধাবী শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা। যারা অন্য কোনো ভূভাগের ইশারায় তাড়িত না হয়ে থেকে গেছেন, তাদের একটা বিশাল অংশ দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নে যুক্ত হয়ে ভোগবিলাসে মত্ত হয়েছেন। ফলে পুরনো মধ্যবিত্তের প্রাসঙ্গিকতা ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। অন্যদিকে উঠতি মধ্যবিত্তের প্রভাব বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এবং এদের প্রবল ধাক্কায় জীবনের চিরায়ত মূল্যবোধ বদলে যাচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হারিয়ে যাচ্ছে। এদের কৃপা ও অর্থায়নে-ই গ্রামীণ জনপদে ধর্মীয় ভাবাবেগপুষ্ট ইসালে সওয়াব, ধর্মভিত্তিক গ্রামীণ আন্দোলন, এমনকি হেফাজতের আন্দোলনও শক্তিশালী ও জোরদার হচ্ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্মীয় নেতা ও কথিত আলেম-আল্লামাদের দাপট।
কমছে শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব। বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র এবং নব্য বড়লোক ও উঠতি মধ্যবিত্তরা নাগরিক বুদ্ধিজীবীদের আর পাত্তা দিতেই চায় না। ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়া, টক শো আর কিছু প্রিন্ট ছাড়া এদের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সমকাল যেন এদের প্রত্যাখ্যান করেছে! আর এটাই আমাদের জাতির জন্য দুর্ভাগ্য! সত্যি বলতে কী,
পুরোনো মধ্যবিত্তদের বেশির ভাগ পরিবার ছিল কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এরা অধিকাংশই যৌথ পরিবারের সন্তান। এদের মধ্যে একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা কাজ করতো। সেই কারণে সম্ভবত ড. মোখলেসুর রহমান, পলাশীপাড়ার মোশাররফ হোসেন রফিকুর রশীদ, কর্নেল মাকসুদ, আলকামা সিদ্দিকী, আশরাফুল ইসলাম (অতি. সচিব) ড. আব্দুর রশীদ, সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক আব্দুর রশিদ, শফি উকিল, রবিউল আলম (জেলা জজ), প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, গ্রুপ ক্যাপ্টেন তৌহিদ বাবলু, বার্জারের ম্যানেজার মকলেচুর রহমান, ডা. দেলদার হোসেন, ডা. পারভিয়াস হোসেন রাজা, মোরাদ হোসেন, প্রকৌশলী আবু হেনা, ডা. নাজমুল হক সাগর, ডা. সজিব উদ্দিন স্বাধীনরা (আরও অনেকেই আছেন, কিন্তু সবার নাম আমি মনে করতে পারছি না) এলাকার মাটি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ও যোগাযোগ রেখে চলেছেন। কিন্তু প্রবাসী আয়, ফটকা কারবার, মহাজনি পুঁজি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আর নগরায়ণের মাধ্যমে গড়ে ওঠা উঠতি মধ্যবিত্তরা দারুণ আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। এরা দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি —কিছুই বোঝে না। এরা কেবল নিজেদের ধনসম্পদ আর জীবনমান বাড়াতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকে। এরা প্রগতিবিমুখ এবং সর্বোতভাবে স্যাডিস্ট। তাই অন্যদের অপদস্ত ও হেয় প্রতিপন্ন করে আনন্দ পেতে চায়। এদের কাছ থেকে উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি আশা করা বৃথা। তবে উঠতি মধ্যবিত্তদেরও দরকার আছে।
এদের আকার শক্তিশালী হলে সামাজ স্থিতিশীল হবে, জনজীবনে স্বস্তি-শান্তি ফিরে আসবে। উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিগঠণ প্রক্রিয়া জোরদার হবে। ইদানিং বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতো গাংনীর উঠতি মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণরাও ইতিবাচক ভূমিকা পালনে এগিয়ে এসেছেন। তারাও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে আত্মপ্রকাশ করছে। আশা করা যায়, আগামী দিনে এই তরুণরাই সেই উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে, যা তাদের পূর্বসূরিরা পালন করেছেন। অন্ধ-মূঢ় সমাজের গর্ভেই তো নতুন সমাজের জন্ম হয়। এখানে হয়তো খুব বিস্ময়কর কিছু হবে না, তবে সন্ধানী, পলাশীপাড়া, বি আর লাইসিয়াম অথবা জোড়পুকুরিয়া হাইস্কুল একটা নতুন কিছু করলেও করতে পারে। গাংনীর ‘গণিত উৎসব’ও আমাদের বড় অর্জন যার স্রষ্টা গাংনী উপজেলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বিজ্ঞানমনস্ক তরুণরা।