বাংলাদেশে গত পাঁচই অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে দেশজুড়ে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ‘হিমশিম’ খাচ্ছে বিএনপি
“সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েও নেতাকর্মী নিয়ন্ত্রণে ‘হিমশিম’ খাচ্ছে বিএনপি” শিরোনামে বিবিসি বাংলা প্রকাশিত এক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
বাংলাদেশে গত পাঁচই অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে দেশজুড়ে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ‘হিমশিম’ খাচ্ছে বিএনপি এবং গত দুই মাসে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম স্থায়ী কমিটি সদস্য থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এক হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে দলটিকে।
এর বাইরে দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ‘বেআইনি কর্মকাণ্ডে’ জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আসার পর দলের পক্ষ থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্রগুলো বলছে।
মূলত চাঁদাবাজি, দখল, হামলা, এমনকি হত্যার অভিযোগ পর্যন্ত এসেছে কারও কারও বিরুদ্ধে। সবশেষ হাতিরঝিল এলাকায় বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় দলের এক নেতার নাম গণমাধ্যমে আসার পর চব্বিশ ঘণ্টার সময় দিয়ে তাকে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছে বিএনপি।
এ ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে দলটির অভ্যন্তরে। আবার ঢাকার তেজগাঁওয়ে একজন শিল্পপতির একটি স্থাপনা যুবদলের সাথে জড়িত একদল ব্যক্তির দখলমুক্ত করতে শেষ পর্যন্ত দলের শীর্ষ নেতৃত্বকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে বলে দলের মধ্যে আলোচনা আছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম বলছেন, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের যে সংস্কৃতি দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আছে সেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবারের পট পরিবর্তনের পর।
“এতদিন সব আওয়ামী লীগের লোকজনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিএনপির লোকজন পনের বছর নিপীড়ন বঞ্চনা সহ্য করেছে। এ কারণেই হয়তো ক্ষমতায় না আসলেও আওয়ামী লীগের বিদায়ের সাথে সাথে তাদের কর্তৃত্ব চলে এসেছে। তবে দলটির হাইকমান্ডকে দেখছি শুরু থেকেই কিছু ঘটনায় ব্যবস্থা নিচ্ছে, যা ইতিবাচক,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন, দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে এবং কোনো ঘটনার সাথে কারও নাম আসলেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
“আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড এগুলোকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু বিএনপি হাইকমান্ড কোনো অন্যায়ের সাথে জড়িত কাউকে ছাড়ছে না। কাজেই আমাদের মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বললে বিএনপির প্রতি অবিচার করা হবে। দল ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং এর মাধ্যমে সব স্তরের নেতাকর্মীদের কাছে শক্ত বার্তা গেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর চট্টগ্রামে বিএনপির দক্ষিণ জেলা শাখার আহবায়কসহ স্থানীয় তিন নেতা আলোচনায় এসেছিলেন বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী এস আলমের বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নেয়ার সাথে জড়িত থাকার ঘটনায়। পরে তাদের কমিটি বাতিল করে দেয় বিএনপি।
আবার ওই শিল্প গ্রুপের গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগে দলের শোকজ নোটিশ পেয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ।
দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু গত পনের অগাস্ট নাটোরে ‘দলীয় আদর্শের পরিপন্থী’ বক্তব্যের অভিযোগে দল থেকে শোকজ নোটিশ পান। তিনি জবাব দিলেও দলের পক্ষ থেকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সরিয়ে দিয়ে নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে।
আলোচনায় আছে বিএনপির ঢাকা উত্তরের কমিটি ভেঙ্গে দেয়া নিয়েও। এ কমিটির দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবসায়ীর সাথে যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছিলো দলীয় মহলে। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও তারা এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ফরিদপুরের নগরকান্দায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এক কর্মী হত্যার ঘটনা পর দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুলের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে।
আরেক অভিযোগে স্থগিত করা হয়েছে দলের বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের দলীয় পদ।
আবার বহিষ্কারের পর দলের পক্ষ থেকে মামলাও করা হয়েছে ময়মনসিংহের বিএনপি নেতা ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর বিরুদ্ধে।
দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী চাঁদাবাজি, দখলদারিত্বসহ বিভিন্ন অভিযোগে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের এক হাজারের বেশি নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে চারশর বেশি নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পদ স্থগিত করা হয়েছে কমপক্ষে বিশ জনের।
“প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একই প্রবণতা কাজ করে। ক্ষমতায় গেলে বা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। দেশে যে ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছে তাতে ভিন্ন কিছু আশা করাও কঠিন। কিন্তু এবার বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্ব ঘটনাগুলো এড়িয়ে গিয়ে প্রশ্রয় দেয়নি। কিছু ঘটনায় তারা ব্যবস্থা নিয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন অধ্যাপক মাসুম।
তবে ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে বিএনপি হিমশিম খাচ্ছে বলেই মনে করছেন এই বিশ্লেষক।
বেশ কয়েকটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির কিছু নেতাকর্মীর সাথে কথা বলে জানা গেছে আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর বিএনপির ২০১৮ সালের নির্বাচনে যারা প্রার্থী ছিলেন কিংবা স্থানীয় সাবেক এমপি তারাই মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এমনকি স্থানীয় প্রশাসনও উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে রাজনৈতিক নেতাদের ডাকতে হলে বিএনপি নেতাদেরই ডাকছেন।
তবে পাঁচই অগাস্টের পর কিছুদিন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বেশ কিছু এলাকাতেই ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ কিছু ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে দলের একটি অংশ, বলছিলেন দলের উত্তরাঞ্চলীয় একজন নেতা।
“আওয়ামী লীগের লোকজন চলে যাওয়ার পর এমনিতেও বাজারঘাট নিয়ন্ত্রণসহ স্থানীয় কিছু বিষয় বিএনপি নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এখন দলের সাবেক এমপিরা সক্রিয় হওয়ায় কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে,” নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলছিলেন তিনি।
আবার কোথাও কোথাও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছে। শেরপুরে নিজেদের মধ্যকার সংঘর্ষে গত দশই সেপ্টেম্বর মারা যান জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আরিফুল ইসলাম শ্রাবণ। ।
এর আগে একুশে অগাস্ট সংঘর্ষে একজন নিহত হয় ফরিদপুরের নগরকান্দায়।
তবে এখন নেতারা অনেকে মনে করছেন বেশ কিছু ঘটনায় শক্ত পদক্ষেপ নেয়ায় দলের সব স্তরে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে।
এছাড়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেও প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সাংগঠনিক ইউনিটের সাথে বৈঠক করে এ বিষয়ে সতর্ক করছেন এবং এটিও নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ বা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন তারা।
তথ্যসূত্র: বিবিসি নিউজ