বাংলাদেশে শৈত্যপ্রবাহ ।। শৈত্যপ্রবাহে সতর্কতা
বাংলাদেশে সাধারণত শীত পড়ে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে। এসময় হিমালয়ের পাদদেশ থেকে ঠাণ্ডা বাতাস উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসময় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়। ফলে শীত অনুভূত হয়।
যদি এই তাপমাত্রা কমতে কমতে নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছায় তখন শৈত্যপ্রবাহ চলছে বলে ধরে নেয়া হয়।
“আমাদের দেশে শীতকালে অর্থাৎ ডিসেম্বর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে যখন তাপমাত্রা ১০ডিগ্রীর নিচে নেমে আসে, আমরা তাকে শৈত্যপ্রবাহ বলি”, বলেন আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক।
তাপমাত্রাভেদে শৈত্যপ্রবাহকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।
তাপমাত্রা যদি আট থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয় তবে সেটাকে ধরা হয় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। তাপমাত্রা এরচেয়ে কমে ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামলে হয় মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ আর চার থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়।
তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে সেটা হয় অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ।
তবে শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে ধরতে হলে এই তাপমাত্রার স্থায়িত্বকাল অন্তত তিনদিন হতে হবে। অর্থাৎ তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলেও তা যদি কমপক্ষে তিনদিন না থাকে তবে তা শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে ধরা যাবে না।
বাংলাদেশের মূলত উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এলাকা শৈত্যপ্রবাহ প্রবণ। শীতকালে বাংলাদেশে যে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহিত হয় তা ভারতের দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
“বিশেষ করে রাজশাহী, রংপুর অথবা খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া অঞ্চল দিয়ে এই হাওয়া ঢোকে এবং কখনো কখনো তাপমাত্রা কমিয়ে ১০ ডিগ্রির অবনমন করে ফেলে”, বলেন মিস্টার মল্লিক।
মূলত রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, সিলেট, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডু, রাঙ্গামাটি শৈত্যপ্রবাহপ্রবণ অঞ্চল।
এছাড়াও কোন কোন ক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগের পশ্চিমাঞ্চল, যেমন- গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল অঞ্চলেও শৈত্যপ্রবাহ হয়ে থাকে।
পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাগঞ্জ, রাজশাহী বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী, পাবনা, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ, সিলেট, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সীতাকুন্ডু, গোপালগঞ্জ, সৈয়দপুর, মাদারীপুর অঞ্চলও শৈত্যপ্রবাহে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
“আমাদের দেশে উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকাগুলো বিগত বছরগুলোতে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে এসে শৈত্যপ্রবাহের সৃষ্টি করেছে”, বলেন মিস্টার মল্লিক।
গত বছর বরিশাল, ময়মনসিংহ অঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে। এ বছরও বিচ্ছিন্নভাবে এই জেলাগুলোর ওপর দিয়ে মৃদু এবং মাঝারি এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান এই আবহাওয়াবিদ।
তবে এবার এল নিনো সক্রিয় থাকায় ডিসেম্বর মাসের গড় তাপমাত্রা যেখানে ১৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে, সেখান হয়তো একটু বেশি থাকবে বলে জানান তিনি।
শীতকালের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো কুয়াশা। এসময় কুয়াশায় চারপাশ ঢেকে যাওয়ার একটি প্রবণতা দেখা যায়।
তবে কুয়াশার সঙ্গে শৈত্যপ্রবাহের সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই বলে জানান আবহাওয়াবিদ ড. সমরেন্দ্র কর্মকার।
বরং কুয়াশা পড়লে তাপমাত্রা সাধারণত ১০ডিগ্রির ওপরে থাকে বলে জানান তিনি।
“দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমে আসলে কুয়াশা সৃষ্টি হয় আর মানুষের শীত লাগে। কিন্তু সংজ্ঞানুসারে সেটাকে শৈত্যপ্রবাহ বলা যায় না”।
বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ, রংপুর এবং রাজশাহীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যথাক্রমে ১১.৭, ১২.৩ এবং ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে এসময় অঞ্চলগুলোতে কুয়াশা দেখা গেলেও সেখানে শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে, তেমনটা বলা যাবে না।
শৈত্যপ্রবাহে সতর্কতা
শৈত্যপ্রবাহের সময় ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। ফলে হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত বিভিন্ন রোগ নিয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
এদের মধ্যে বেশিরভাগই থাকে বয়স্ক আর শিশু। এসময় শীতের কারণে কিছু কিছু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
তাই ঠাণ্ডার হাত থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। অনেক সময় শীতের হাত থেকে বাঁচতে আগুন পোহানোর সময়ও দুর্ঘটনা ঘটে। সেক্ষেত্রে আগুন পোহালেও বিশেষ সতর্কতা নেয়া জরুরি।
এছাড়াও গরু, ছাগলের মতো গবাদি পশু এসময় ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। সেক্ষেত্রে অসুস্থতার হাত থেকে বাঁচাতে চট দিয়ে তাদের গা মুড়িয়ে রাখা যেতে পারে।
শীতের সময় সবজির উৎপাদন ভালো হলেও শৈত্যপ্রবাহের ফলে ফলনে প্রভাব পড়তে পারে। সেক্ষত্রে কৃষিকাজের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা নেয়া প্রয়োজন।
এছাড়াও এসময়ে ঘন কুয়াশার কারণে পরিবহন চলাচলে প্রভাব পড়ে এবং অনেক দুর্ঘটনাও ঘটে। তাই চলাচলের সময় কিছুটা বাড়তি সতর্কতা নেয়া দরকার।