বাংলার নীল বিদ্রোহ ও মেহেরপুরের ভাটপাড়া নীলকুঠি
আবদুল্লাহ আল আমিন
ছবি:ভাটপাড়া নীলকুঠির সামনে লেখক
১৮৬০ সাল ছুঁই ছুঁই। নীলকর সাহেব ও তাঁদের নায়েব-গোমস্তা, পাইক-বরকন্দাজদের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক সমাজ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। চাষিরা জোটবদ্ধ হয়ে সাফ জানিয়ে দেন, তাঁরা জান উৎসর্গ করবেন, তবু নীল বুনবেন না। নীলকুঠিসংলগ্ন গ্রামগুলোয় দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। সেই আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে অবিভক্ত বঙ্গদেশের কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, রানাঘাট, মেহেরপুর, যশোর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, মাগুরার প্রত্যন্ত জনপদ থেকে মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, পাবনা হয়ে খুলনা পর্যন্ত। পুড়ে ছাই হয় অত্যাচারী, রক্তচোষা নীলকরদের নীলকুঠি, ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলো ও ইংরেজদের দালাল দেশীয় জমিদারদের কাছারিবাড়ি। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় দুর্দান্ত লেখার মাধ্যমে আগুনের ফুলকি ছড়ান সাংবাদিক হরিশচন্দ্র মুখার্জি। রেভারেন্ড জেমস লঙের সহযোগিতায় ইংরেজিতে অনূদিত হয় দীনবন্ধু মিত্রের কালজয়ী নাটক ‘নীল দর্পণ’। সরকারি ও বুদ্ধিজীবী মহলে বেঁধে যায় মহা হুলুস্থুল। অনুবাদ করার অপরাধে দণ্ডিত হন প্রজাপ্রেমী পাদরি জেমস লঙ।
তবু মৃত্যুভয়হীন চাষিদের বিদ্রোহ বন্ধ হয়নি। চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর কুঠিতে আক্রমণ চালান বিদ্রোহী চাষিরা। অগ্নিসংযোগ করা হয় চুয়াডাঙ্গা এলাকার বিভিন্ন কুঠিতে। ঝিনাইদহের খাড়াগোদা কুঠির পরিশোধিত নীল চিত্রা নদীর জলে ভাসিয়ে দেন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসী। স্থানীয় জমিদার, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এগিয়ে আসেন চাষিদের সমর্থনে। চুয়াডাঙ্গার নাটুদহের জমিদার নফরচন্দ্র পালচৌধুরী প্রজাদের সঙ্গে নিয়ে বাহুবলেই উদ্ধার করে নেন অধিকাংশ জমিদারি। মেহেরপুর অঞ্চলে নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন মথুরানাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী ও নীলকরবিরোধী আন্দোলন। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, সেই আন্দোলনের আঁচ একেবারেই স্পর্শ করতে পারে না মেহেরপুরের কাজলা নদীবর্তী ভাটপাড়া নীলকুঠি লাগোয়া সাহারবাটী, নওপাড়া, বাহাদুরপুরে। নীলকর সাহেব ও নায়েব-গোমস্তাদের সঙ্গে মিলেমিশেই চলতে থাকে এলাকার চাষি ও সচ্ছল কৃষকদের জীবন। ভাটপাড়া নীলকুঠিটি এখনোও টিকে আছে, কুঠি প্রাঙ্গণে একটি ইকোপার্ক এবং অনতিদূরে রয়েছে হাটবাজার, মডেল মার্কেট ও কলেজ।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত মেহেরপুরের ভাটপাড়া, কাথুলি ও আমঝুপি নীলকুঠিতে নীল তৈরির ভাটিখানা চলেছে। ১৮৬০-এর দশকে ভাটপাড়া ও আমঝুপি নীলকুঠিসংলগ্ন এলাকায় কোনো নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। মেহেরপুরের বল্লভপুর, রতনপুর ও ভবরপাড়া নীলকুঠি যখন স্থানীয় খ্রিস্টান চাষিরা ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন, তখনো ভাটপাড়া ও আমঝুপিতে চলেছে নীলের রমরমা কারবার। আলমডাঙ্গা ও দৌলতপুর এলাকায় নীল বিদ্রোহে মারমুখী ভূমিকা পালন করেন মুসলমান চাষিরা, তখন ভাটপাড়া যেন এক শান্ত স্নিগ্ধ নিস্তরঙ্গ জনপদ। ভবরপাড়া, বল্লভপুর, রতনপুরের চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন রেভারেন্ড ক্রিস্টিয়ান পাদরি বমভেশ এবং জে জে লিংকের নেতৃত্বে। তখন ভাটপাড়া কুঠি এলাকায় দুই–একটি বিক্ষিপ্ত লড়াই ছাড়া কোনো সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। রতনপুর নীলকুঠির ম্যানেজার গাউ স্মিথ ভবরপাড়া গ্রাম আক্রমণ করলে চাষিদের ঐক্যবদ্ধ করেন রেভারেন্ড জে জে লিংকে। কিন্তু ভাটপাড়ার চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে তেমন প্রতিরোধ গড়তে পারেননি।
নীল চাষ, নীলকুঠি ও নীল বিদ্রোহ–সম্পর্কিত প্রায় সব তথ্য-উপাত্ত কালের পরিক্রমায় লুপ্ত হয়ে গেছে। ভাটপাড়া নীলকুঠি–সম্পর্কিত সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া বেশ দুরূহ কাজ। তবে অনুসন্ধিৎসু মানুষের প্রশ্ন ভাটপাড়া, কাথুলি, আমঝুপি, কার্পাসডাঙ্গা এলাকায় কি কোনো নীল বিদ্রোহ হয়নি? কেন এমনটি হলো? কেন উল্লিখিত এলাকার চাষিরা নীলকর ও নীলচাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন না? শিক্ষাদীক্ষার অভাবই কি তাঁদের বিদ্রোহ-বিমুখ করে রেখেছিল? নাকি প্যারী সুন্দরীর মতো সাহসী নেতৃত্বের অভাব? অনেকেই এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চান। আমার সঙ্গে একমত পোষণ করে স্থানীয় ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের অনেকে বলেছেন, ‘১৮৬০ সাল পর্যন্ত সাহারবাটী, ভাটপাড়া, আমঝুপি ও এর আশপাশের গ্রামগুলো ছিল দুর্গম ও শ্বাপদসংকুল। কলকাতা কিংবা কৃষ্ণনগরের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যাঁরা নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন, তাঁদের সঙ্গে এ এলাকার ভুক্তভোগী রায়ত ও কৃষকদের তেমন যোগাযোগ ছিল না। কলকাতা, কৃষ্ণনগর বা মেদিনীপুর থেকে জলপথে সরাসরি আসা যেত না এ অঞ্চলে মেহেরপুরের কুঠিগুলোয়। হাঁটাপথে তো অনেক দূর! গ্রামবাসীর অভাব ছিল, তবে খালবিলে মৎস্যশিকার করে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা দিব্যি হয়ে যেত। অনেকে পেশা হিসেবে বেছে নেন হাঁড়ি-পাতিল তৈরি, তাঁত বোনানো ও গয়না বানানোর কাজ। সম্ভবত এসব কারণে নীলকরদের চাপে নীলচাষ করেও এ অঞ্চলের সাধারণ অধিবাসীদের জীবনপ্রবাহে তেমন প্রভাব পড়েনি। তাই কোনো ধরনের বিদ্রোহও দানা বাধেনি। বরং সাহেবদের সঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপন করেছে।’ তবে স্থানীয় গবেষকদের অনেকেই এই মতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, মেহেরপুরের ভাটপাড়া, সাহারবাটী, বাহাদুরপুর, কাথুলি, তেঁতুলবাড়িয়া, চরগোয়ালগ্রাম, বেতবাড়িয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে সীমিত মাত্রায় হলেও কৃষক-বিদ্রোহ হয়েছে। মেহেরপুর ও চাঁদবিলে বলরামী সম্প্রদায়, শ্যামপুর ও সাহারবাটীর সচ্ছল মাহিষ্যরা এবং নওপাড়ার মুসলমান চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।
ভাটপাড়া নীলকুঠির সাহেবরা ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। ভাটপাড়া নীল কনসার্নে প্রায় ১০০ নীলচাষ হয়েছে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কোম্পানি আইনের আওতায় মেহেরপুরসহ অবিভক্ত নদীয়া জেলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনভুক্ত হয়। কোম্পানি তার প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে উনিশ শতকের প্রথম দিকে মেহেরপুরের সাহারবাটী মৌজার কাজলাতীরের ভাটপাড়া নীলকুঠিটি নির্মিত হয়। ১৮২০ থেকে ১৮২৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নীলকুঠিটি নির্মিত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। অবিভক্ত নদীয়া জেলার কুঠিগুলোর মধ্যে ভাটপাড়া কুঠি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একপর্যায়ে বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি ও রবার্ট ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানি অত্র এলাকার অধিকাংশ জমির ইজারা নেয়। এরপর মালিকানা চলে যায় ব্রিটিশ রাজের নিয়ন্ত্রণাধীন মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির অধীনে। ১৮৬০ সালের পর ভাটপাড়ায় নির্মাণ করা হয় মেদিনীপুর জমিদারির বিশাল কাছারিবাড়ি। তৈরি করা হয় মেদিনীপুর কোম্পানির সাহেবদের থাকার জন্য বাংলো। ২০১৬ সালে মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের সহায়তায় নীলকুঠির প্রাঙ্গণে ইকোপার্ক গড়ে তোলা হয়। আমঝুপি নীলকুঠি প্রাঙ্গণেও অনুরূপ একটি ইকোপার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এর পর থেকে মেহেরপুর জেলার মানুষ ভাটপাড়াসহ জেলার অন্য নীলকুঠির ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এখন অনেকেই ভাটপাড়া নীলকুঠি, নীলচাষ, নীলকুঠি স্থাপন এবং উনিশ শতকের বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার ইতিহাস সম্পর্কে কৌতূহলী। তাঁরা জানতে চান, কখন ভাটপাড়া নীলকুঠিটি নির্মিত হয়েছে? ইংরেজদের আগমনের পূর্বে অর্থাৎ নবাবি আমলে ভাটপাড়া কিংবা আমঝুপিতে কি কোনো কুঠি বা কাছারিবাড়ি ছিল? অনুসন্ধিৎসু দর্শনার্থীদের কৌতূহল নিবারণের জন্য আবদুল্লাহ আল আমিন লিখেছেন ‘ভাটপাড়া নীলকুঠি ও উনিশ শতকের বাংলাদেশ’ নামক এক অসাধারণ আকরগ্রন্থ।
আবদুল্লাহ আল আমিনের বই থেকে জানা যায়, ১৮৬০ সালের ১৮ মে কৃষ্ণনগরে মি. সিটন কারের সভাপতিত্বে নীল কমিশনের প্রথম অধিবেশনে দীর্ঘ তদন্ত ও পর্যালোচনার পর কমিশন ‘নীল ব্যবসাকে পাপজনক, ক্ষতিকারক ও ভ্রমসংকুল’ হিসেবে মন্তব্য করে। রানাঘাটের প্রতাপশালী জমিদার জয়চাঁদ পালচৌধুরী কমিশনকে নীলচাষ বন্ধের সুপারিশ করেন। ১৮৬১ সালে নদীয়া জেলার সবচেয়ে প্রতাপশালী নীলকর জেমস হিল নীল ব্যবসা বন্ধ করে দেন। কারণ, চাষিদের দাবি মোতাবেক মূল্য প্রদান করলে নীল ব্যবসায় তেমন কোনো লাভ থাকে না। মুনাফার জন্য তিনি জমিদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নীলচাষে প্রজাদের বাধ্য করা যাবে না মর্মে আইন (১৮৬১) প্রণীত হলে নদীয়া ও যশোর জেলায় নীলচাষ কমতে থাকে। তারপরও ১৯১০ সাল পর্যন্ত মেহেরপুরের কোথাও কোথাও নীলচাষ অব্যাহত থাকে। ভাটপাড়া নীলকুঠির আওতাধীন এলাকায় বিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত নীলচাষ চালু ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ১৮৬০ সালের ভাটপাড়া নীলকুঠি কিনে নেয় মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানি। এই কোম্পানি প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য একটি কাছারিবাড়ি নির্মাণ করে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পরও মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির কর্মকর্তারা ভাটপাড়ায় অবস্থান করতেন। ১৯৫৩ সালে তাঁরা ভাটপাড়া ছেড়ে চলে যান। ১৯৫৩ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর ভাটপাড়া নীলকুঠির দায়িত্ব অর্পিত হয় কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের ওপর।
নীল চাষ, নীলকুঠি ও নীল বিদ্রোহ–সম্পর্কিত প্রায় সব তথ্য-উপাত্ত কালের পরিক্রমায় লুপ্ত হয়ে গেছে। ভাটপাড়া নীলকুঠি–সম্পর্কিত সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া বেশ দুরূহ কাজ। তবে অনুসন্ধিৎসু মানুষের প্রশ্ন ভাটপাড়া, কাথুলি, আমঝুপি, কার্পাসডাঙ্গা এলাকায় কি কোনো নীল বিদ্রোহ হয়নি? কেন এমনটি হলো? কেন উল্লিখিত এলাকার চাষিরা নীলকর ও নীলচাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন না? শিক্ষাদীক্ষার অভাবই কি তাঁদের বিদ্রোহ-বিমুখ করে রেখেছিল? নাকি প্যারী সুন্দরীর মতো সাহসী নেতৃত্বের অভাব? অনেকেই এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চান। আমার সঙ্গে একমত পোষণ করে স্থানীয় ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের অনেকে বলেছেন, ‘১৮৬০ সাল পর্যন্ত সাহারবাটী, ভাটপাড়া, আমঝুপি ও এর আশপাশের গ্রামগুলো ছিল দুর্গম ও শ্বাপদসংকুল। কলকাতা কিংবা কৃষ্ণনগরের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যাঁরা নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন, তাঁদের সঙ্গে এ এলাকার ভুক্তভোগী রায়ত ও কৃষকদের তেমন যোগাযোগ ছিল না। কলকাতা, কৃষ্ণনগর বা মেদিনীপুর থেকে জলপথে সরাসরি আসা যেত না এ অঞ্চলে মেহেরপুরের কুঠিগুলোয়। হাঁটাপথে তো অনেক দূর! গ্রামবাসীর অভাব ছিল, তবে খালবিলে মৎস্যশিকার করে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা দিব্যি হয়ে যেত। অনেকে পেশা হিসেবে বেছে নেন হাঁড়ি-পাতিল তৈরি, তাঁত বোনানো ও গয়না বানানোর কাজ। সম্ভবত এসব কারণে নীলকরদের চাপে নীলচাষ করেও এ অঞ্চলের সাধারণ অধিবাসীদের জীবনপ্রবাহে তেমন প্রভাব পড়েনি। তাই কোনো ধরনের বিদ্রোহও দানা বাধেনি। বরং সাহেবদের সঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপন করেছে।’ তবে স্থানীয় গবেষকদের অনেকেই এই মতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, মেহেরপুরের ভাটপাড়া, সাহারবাটী, বাহাদুরপুর, কাথুলি, তেঁতুলবাড়িয়া, চরগোয়ালগ্রাম, বেতবাড়িয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে সীমিত মাত্রায় হলেও কৃষক-বিদ্রোহ হয়েছে। মেহেরপুর ও চাঁদবিলে বলরামী সম্প্রদায়, শ্যামপুর ও সাহারবাটীর সচ্ছল মাহিষ্যরা এবং নওপাড়ার মুসলমান চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।
ভাটপাড়া নীলকুঠির সাহেবরা ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। ভাটপাড়া নীল কনসার্নে প্রায় ১০০ নীলচাষ হয়েছে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কোম্পানি আইনের আওতায় মেহেরপুরসহ অবিভক্ত নদীয়া জেলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনভুক্ত হয়। কোম্পানি তার প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে উনিশ শতকের প্রথম দিকে মেহেরপুরের সাহারবাটী মৌজার কাজলাতীরের ভাটপাড়া নীলকুঠিটি নির্মিত হয়। ১৮২০ থেকে ১৮২৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে নীলকুঠিটি নির্মিত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। অবিভক্ত নদীয়া জেলার কুঠিগুলোর মধ্যে ভাটপাড়া কুঠি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একপর্যায়ে বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি ও রবার্ট ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানি অত্র এলাকার অধিকাংশ জমির ইজারা নেয়। এরপর মালিকানা চলে যায় ব্রিটিশ রাজের নিয়ন্ত্রণাধীন মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির অধীনে। ১৮৬০ সালের পর ভাটপাড়ায় নির্মাণ করা হয় মেদিনীপুর জমিদারির বিশাল কাছারিবাড়ি। তৈরি করা হয় মেদিনীপুর কোম্পানির সাহেবদের থাকার জন্য বাংলো। ২০১৬ সালে মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের সহায়তায় নীলকুঠির প্রাঙ্গণে ইকোপার্ক গড়ে তোলা হয়। আমঝুপি নীলকুঠি প্রাঙ্গণেও অনুরূপ একটি ইকোপার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এর পর থেকে মেহেরপুর জেলার মানুষ ভাটপাড়াসহ জেলার অন্য নীলকুঠির ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এখন অনেকেই ভাটপাড়া নীলকুঠি, নীলচাষ, নীলকুঠি স্থাপন এবং উনিশ শতকের বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার ইতিহাস সম্পর্কে কৌতূহলী। তাঁরা জানতে চান, কখন ভাটপাড়া নীলকুঠিটি নির্মিত হয়েছে? ইংরেজদের আগমনের পূর্বে অর্থাৎ নবাবি আমলে ভাটপাড়া কিংবা আমঝুপিতে কি কোনো কুঠি বা কাছারিবাড়ি ছিল? অনুসন্ধিৎসু দর্শনার্থীদের কৌতূহল নিবারণের জন্য আবদুল্লাহ আল আমিন লিখেছেন ‘ভাটপাড়া নীলকুঠি ও উনিশ শতকের বাংলাদেশ’ নামক এক অসাধারণ আকরগ্রন্থ।