বাংলা সাহিত্যের বহুল আলোচিত ও প্রতিভাবান দুই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)।বাংলা সাহিত্যের দুই মহান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে যে গভীর সুসম্পর্ক ছিল, তা আমাদের অনেকেরই অজানা। রবীন্দ্রনাথ যেমন অনুজ নজরুলের প্রতি আশীর্বাণী প্রদান করে প্রীত হয়েছেন, তেমনি নজরুলও অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে হয়েছেন ধন্য।
আলাপচারিতা
তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স আশি বছর পূর্তি হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে লিখেন, ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’। ১৯২০ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পূর্বকাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক স্নেহ ও শ্রদ্ধার।
৭ জানুয়ারি, ১৯২২। সকাল বেলা ‘বিজলী’ পত্রিকার চারটি কপি হাতে করে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সামনে হাজির কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তখন তার বয়স মাত্র ২৩। ‘গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি, গুরুজি’ বলে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিমায় চিৎকার করছেন নজরুল।
শান্ত ও ধ্যান গম্ভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি গিয়ে অমন করে চিৎকার করা বা বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে চেঁচানো যে কারও জন্য বেমানান ছিল, তবুও নজরুল স্বভাবসুলভ আচরণে সেদিন তা করে দেখিয়েছিলেন। অথচ জোড়াসাঁকো পুরো বাড়িটাই ছিল শান্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর আর রমণীয়। বাঘা বাঘা লোক, পণ্ডিত-মনীষী সংযতভাবে ওই বাড়িতে ঢুকতেন, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলার সময়। কেউ কখনো একটু সময়ের জন্যও অসংলগ্ন আচরণ করতেন না। চিৎকার চেঁচামেচি তো দূরের কথা।
নজরুল সেদিন ঠাকুর বাড়ির এই শান্ত সমাহিত নীরব পরিবেশ ভঙ্গ করে অকম্পিত কণ্ঠে চিৎকার করে গুরুজি, আপনাকে হত্যা করব, ইত্যাকার দম্ভোক্তি করে মহা হুলুস্থূল কাণ্ড বাধিয়েছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ একটু বিরক্ত বা বিব্রতবোধ করেননি, বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হননি।
রবীন্দ্রনাথ উপর থেকে বললেন, ‘কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন? এসো, উপরে এসে বসো?’ এবার ‘বিজলী’ হাতে উপরে উঠলেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় বিদ্রোহী কবিতাটি শুনিয়ে দিলেন- যা আগের দিন ছাপা হয়েছে বিজলী পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে এতক্ষণ শুনছিলেন, স্তব্ধ হয়ে নজরুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
কবিতা পড়া শেষ হলে তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত প্রসারিত করে তরুণ কবিকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ কাজী, তুমি আমাকে সত্যিই হত্যা করবে। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কবিতার জগৎ আলোকিত হোক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।’
১৯২২ সালের ২৫ জুন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুতে কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরি হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে স্মরণসভা হয়। সেখানেও নজরুলকে পাশে বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এদিন সভায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ধূমকেতুর ম্যানেজার শান্তিপদ সিংহ লিখেছেন, ‘বিশ্বকবি মঞ্চে প্রবেশ করলেন এবং প্রায় পিছু পিছু কবি নজরুলও একেবারে মঞ্চের উপর। কবি গুরুর ইঙ্গিতে তাঁর পাশের আসনেই বসলেন। নিচে সেই গুনগুনানি। তাদের হিসাব মতে, কবি গুরুর পাশে বসবার যোগ্যতা নজরুলের নেই। অথচ ঘটনাচক্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে বসবার সুযোগ পাচ্ছেন বড় বড় সভায়। কি দুর্দৈব!’
মন চাইলেই নজরুল চলে যেতেন শান্তিনিকেতনে। উদ্দেশ্য গুরুদেবের সাক্ষাৎ। মাঝে মাঝে পাগলামীও করতেন খুব বেশি। রবীন্দ্রনাথের স্নেহাধিক্যে অদ্ভূত সব কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেলতেন নজরুল। একদিনের ঘটনা সম্পর্কে নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীকে নজরুল বলেন, ‘একবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম এবং ছিলুমও দিন কয়েক। একদিন দুপুরের পরে কবি বসেছিলেন একা দেহলীর বারান্দায়। বেতের একখানা পিঠ উঁচু চেয়ারে। পায়ের কাছে বসে ওঁর একখানা পা টেনে নিয়েছিলাম কোলের উপর। ইচ্ছে ছিল, একটু টিপে দেব। তারস্বরে কবি চেঁচিয়ে উঠলেন, ওরে, ছাড় ছাড় হাড়গোড় আমার ভেঙে গেল। অপ্রস্তুতের একশেষ। আমি সরে বসেছিলুম। আমার দিকে ফিরে চেয়েছিলেন কবি। চোখ তাঁর পিটপিট করছিল। মুখে মৃদৃ হাসি। বলেছিলেন, ক’খানা গান লিখলে আজ? নাকি খালি চ্যাঁচালেই? মুখ ভাড় করে, মাথা নিচু করে আমি বলেছিলুম, মাঝে মাঝে কী মনে হয়, জানেন?—কী? একটা লাঠির বাড়ি মাথায় মেরে আপনাকে শেষ করে দি?— কেন?—কেন? তাহলে আপনার পাশাপাশি চিরকাল লোকে আমার নাম করবে। আর আমার ছবিও আপনার ছবির পাশে ছাপা হবে।– কী সর্বনাশ! ওরে কে আছিস, শিগগিরিই আয়। এ পাগলের অসাধ্য কিছু নেই। কবির কণ্ঠ একটু উঁচুই হয়েছিল, কয়েকজন এসেও পড়েছিল। তাদেরকে সবিস্তারে কবি আমার কথার ফিরিস্তিও শুনিয়ে দিলন।’
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল যে গভীরভাবে শোকাভিভূত হয়েছিলেন তার পরিচয় রবীন্দ্রনাথের পরলোকগমনে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত নজরুলের বিভিন্ন কবিতা ও গানে পাওয়া যায়। এই দিন (২২ শ্রাবণ’ ১৩৪৮) কাজী নজরুল ইসলাম আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন। তিনি আবৃত্তি করেন ‘রবিহারা’ কবিতা এবং রচনা করেন ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’। এ ছাড়া ‘সালাম অস্তরবি’ এবং ‘মৃত্যুহীন রবীন্দ্র’ নামে দুটি কবিতা রচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পরেই নজরুল চিরতরে অসুস্থ এবং ক্রমান্বয়ে সম্বিতহারা ও নির্বাক হয়ে যান। বাংলার দুই মহান কবির কণ্ঠ প্রায় একই সময়ে নীরব হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এর মধ্যে সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা ও ভালবাসার তা নিয়ে লেখা। নজরুলের “তীর্থ পথিক” কবিতা থেকে অংশ বিশেষ। যা রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন নজরুল।
কবিতাটির অংশ বিশেষ:
“তুমি স্রষ্টার শ্রেষ্ট সৃষ্টি বিশ্বের বিস্ময়,-
তব গুণ-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।
তুমি স্মরিয়াছ ভক্তের তব, এই গৌরবখানি
রাখিব কোথায় ভেবে নাহি পাই, আনন্দে মূক বাণী।
কাব্যলোকের বাণী-বিতানের আমি কেহ নহি আর,
বিদায়ের পথে তুমি দিলে তবু কেন এ আশিস-হার?
প্রার্থনা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে-
আসি যেন গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে!!”
১৯২২ সালের ১১ আগষ্ট কলকাতা থেকে নজরুলের পরিচালনায় প্রকাশিত হয় অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধুমকেতু’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধুমকেতর আর্শীবাণীতে লিখেন:
“কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু ,
আয় চলে আয়, রে ধুমকেত
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে’
আছে য়ারা অর্ধ চেতন!
২৪ শে শ্রাবণ ১৩২৯
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”
এই আর্শীবাণী থেকে বুঝা যায়, নজরুল-প্রতিভার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি।
১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধুমকেত’ প্রএিকায় ১২শ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নজরুলের প্রতীকধর্মী রাজনৈতিক কবিতা। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। এই কবিতার জন্য বাজেয়াপ্ত হয় ‘ধুমকেত’র সেই সংখ্যা এবং কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে নজরুলের বিরূদ্ধে মামলা দায়ের এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়।
বিচারাধীন বন্দি হিসাবে নজরুল ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে, বিচার শেষে ১৭ জানুয়ারি নজরুলকে স্হানান্তর করা হয় আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে। পরাধীন জাতির সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণের চিএ তুলে ধরে বন্দী নজরুল সমগ্র দেশবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন।
১৯২৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য নজরুলকে উৎসর্গ করে দেশবাসীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।
রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ উৎসর্গের পর, নজরুল আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বসে রচনা করেন -‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ অর্থাৎ ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতা।
নজরুল তার ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে উৎসর্গ করেন। নজরুলের অগ্নি-বীণা, দোলন-চাঁপা, ছায়ানট, সর্বহারা, ফণি-মনসা, সিন্ধু-হিন্দোল, চিত্তনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের বাছাই করা কবিতা নিয়ে ১৯২৮ সালে ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশ হয়। নজরুল ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ পএে লিখেছেন:
“বিশ্বকবি সম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রী শ্রী চরণারবিন্দেষু”
১৯২৩ সালে ১৪ এপ্রিল নজরুলকে হুগলী জেলে স্হানান্তর করা হয়। হুগলী জেলের সুপার মি. আর্সটান রাজবন্দীদের সাথে অত্যন্ত দূর্ব্যবহার ও অত্যাচার করতেন, রাজবন্দীদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল জেলে ৪০ দিন অনশন করেছিলেন।
১৯২৩ সালের ১৭ মে শরৎচন্দ্র বাজে-শিবপুর হাবড়া থেকে লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে লিখেছেন: “হুগলী জেলে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপুষ করিয়া মরমর হইয়াছে।বেলা ১টার গাড়ীতে যাইতেছি, দেখি যদি দেখা করিতে দেয় ও দিলে আমার আনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজি হয়। না হইলে তার কোন আশা দেখি না।একজন সত্যিকার কবি। রবী বাবু ছাড়া আর বোধ হয় এমন কেহ আর এত বড় কবি নাই”। কিন্ত শরৎচন্দ্র দেখা করেত পারেন নি
জেলের ভিতরে অনশনরত নজরুলের উপর অত্যাচার বেড়ে যায়। ডান্ডাবেড়ী, হ্যান্ডকাপ, সেল কয়েদ, ফোর্সড ফিডিং-এর চেষ্টা চলে, ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়েন নজরুল। মুমূর্ষ কবিকে বাঁচানোর জন্য শিলিং-এ চিঠি লেখা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, তিনি যেন নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করতে অনুরোধ জানিয়ে পএ লিখেন।
রবীন্দ্রনাথ পএের উত্তরে বিদ্রোহী-বিপ্লবী সৈনিক নজরুলের দৃঢ়তাকে সমর্থন জানিয়ে লিখেন: “আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা তাকে হত্যা করারই সামিল। অনশনে যদি কাজীর মূত্যুঘটে তা হলেও তার অন্তরে সত্য আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে।”
শেষ পর্যন্ত, স্নেহভাজন নজরুলের অনশনে বিচলিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে টেলিগ্রাম করেন: “Give up hunger strike, our literature claims you”.অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয়, জেল কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথের টেলিগ্রাম নজরুলকে না দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে লিখে পাঠালেন- “Addressee not found.” রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম ফেরত পেয়েই বুঝলেন এটি সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত ও হীনম্মন্যতা। অনশনের চল্লিশ দিনে বিরজাসুন্দরী দেবীর হাতের লেবুর রস পান করে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নজরুল কয়েকটি কবিতা লিখেছেন। এসব কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুলের ‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী’ ও ‘কৈশোর রবি’ কবিতা দুটি রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লেখা।
‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী’ কবিতাটির রবীন্দ্রনাথের আশিতম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে রচিত-
চরণারবিন্দে লহ অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী,
হে রবীন্দ্র, তব দীন ভক্ত এ কবির।
অশীতি-বার্ষিকী তব জনম-উৎসবে
আসিয়াছি নিবেদিতে নীরব প্রণাম।
হে কবি-সম্রাট, ওগো সৃষ্টির বিস্ময়,
হয়তো হহনি আজো করুণা-বঞ্চিত!
সঞ্চিত যে আছে আজো সৃষ্টির দেউলে
তব স্নেহ করুণা তোমার, মহাকবি!….
(নতুন চাঁদ, অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলী)
‘কিশোর রবি’ রবীন্দ্র প্রশস্তিমূলক কবিতা –
হে চির-কিশোর রবীন্দ্র, কোন রসলোক হতে
আনন্দ-বেণু হাতে হাতে লয়ে এলে খেলিতে ধুলির পথে?
কোন সে রাখাল রাজার লক্ষ ধেনু তুমি চুরি করে
বিলাইয়া দিলে রস-তৃষা তুরা পৃথিবীর ঘরে ঘরে ।
কত যে কথায় কাহিনীতে গানে সুরে কবিতায় তব
সে আনন্দ-গোলেকের ধেণু রূপ নিল অভিনব।
ভুলাইলে জরা, ভুলালে মৃত্যু, অসুন্দরের ভয়
শিখাইলে পরম সুন্দর চির-কিশোর সে প্রেমময়।
নিত্য কিশোর আত্মার তুমি অন্ধ তুমি বিবর হতে
হে অভয়-দাতা টানিয়া আনিলে দিব্য আলোর পথে।
(নতুন চাঁদ, কিশোর রবি)
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও জীবন নজরুল উপলদ্ধি করেছেন প্রসারতায়। তাইতো রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি নিয়ে তিনি লিখলেন, ‘রবির জন্মতিথি’-
নিরক্ষর ও নিস্তেজ বাংলায়
অক্ষর-জ্ঞান যদি সকলেই পায়,
অ-ক্ষর অ-ব্যয় রবি সেই দিন
সহস্র করে বাজাবেন তাঁর বীণ।
সেদিন নিত্য রবির পুণ্য তিথি
হইবে।মানুষ দিকে তাঁকে প্রেম-প্রীতি।
(শেষ সওগাত, রবির জন্মতিথি)
রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক সৌহার্দ্যের; রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে কি স্নেহ করতেন তার একটি উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের “গোরা” উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ছায়াছবিতে নজরুলকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে মনোনীত করেন নরেশচন্দ্র মিএ। তখন সুরকার হিসাবে নজরুলের জনপ্রিয়তা সবার উপরে। চলচ্চিএটি যখন মুক্তি পেতে যাচ্ছে, তখন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড থেকে আপত্তি ওঠে যে বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত (৭টি রবীন্দ্রসঙ্গীত) ব্যবহার করা হয়েছে এবং সুরও যথাযথ নয়; অতএব ছবিটি মুক্তি পেতে পারে না। প্রযোজকের মাথায় হাত। নজরুল কালক্ষেপন না করে ফিল্মের পিন্ট ও প্রজেক্টার নিয়ে ট্যাক্সি করে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে চলে গেলেন। সবশুনে রবীন্দ্রনাথ বললেন ‘কি কান্ড বলতো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান, আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরে? তোমার চেয়েও আমার গান কী তারা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কী ওরা বেশী দিতে পারবে’? একথা বলে আগের থেকে লিখে রাখা অনুমতিপএ নিয়ে তাতে সই ও তারিখ দিয়ে দিলেন।
নজরুল রবীন্দ্র-স্নেহ থেকে কোনদিন বঞ্চিত হননি। এটি তার একটি বড় প্রমাণ।
বস্তুত, শনিবারের চিঠি’র সজনীকান্ত দাশ এবং মোহিতলাল মজুমদারের ঈর্ষান্বিত প্রয়াসে আধুনিক সাহিত্য নিয়ে বির্তক আর বঙ্গসাহিত্যে খুনের মামলা নিয়ে ভূল বুঝাবুঝি ছাড়া ১৯২০ থেকে ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পূর্ব কাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল স্নেহ ও শ্রদ্ধার।
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবণ বেলা বারোটা এগারো মিনিটে রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটলো। কবিগুরুর আত্মা মর্ত থেকে উর্ধ্বে উঠে গেল-দেশ শূন্য, কাল শূন্য-মহাশূন্য পরে।বৈশাখের শঙ্খ স্তব্ধ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের মূত্যু সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল লেখনী হাতে তুলে নিলেন।রচনা করেন শোক কবিতা ‘রবি হারা’-
দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত পথের কোলে
শ্রাবণ মেঘ ছুটে’ এল দলে দলে
উদাস গগন-তলে।
বিশ্বের রবি ভারতের কবি,
শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি।
তুমি চলে যাবে বলে।…
বিদায়ের বেলা চুম্বন লয়ে যায় তব শ্রীচরণে,
যে লোকেই থাক হতভাগ্য এ জাতিরে রাখিও মনে।
(রবি হারা, সওগাত, ভাদ্র ১৩৪৮)
কলকাতা বেতার কেন্দ্রে এই কবিতাটি নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন। রবীন্দ্র-প্রয়াণ নজরুলের মানসিক অবস্থা এ কবিতার মাধ্যমে বুঝা যায়। রবীন্দ্রনাথের মূত্যুর পর নজরুল ‘সালাম অস্ত-রবি’ নামে আরও একটি কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতাটি ও কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।
শত রূপে রঙে লীলা-নিকেতন আল্লার দুনিয়াকে
রাঙায় যে জন, আল্লার কৃপা সদা তাঁরে ঘিরে থাকে।
তুমি যেন সেই খোদার রহম এসেছিলে রূপ ধরে,
আশেরি ছায়া দেখাইয়াছিলে রূপের আর্শি ভরে।
কালাম ঝরেছে তোমার কলমে, সালাম লইয়া যাও
উর্ধ্বে থাকি’ এ পাষাণ জাতিরে রসে গলাইয়া দাও!
(সালাম অস্ত-রবি, মাসিক মোহাম্মদী, ভাদ্র ১৩৪৮)
রবীন্দ্রনাথের মূত্যুতে শোকাহত দেশবাসীর উদ্দেশ্যে নজরুল গানও রচনা করেছিলেন:
“ঘুমাইতে দাও, শান্ত রবিরে জাগায়োনা।
সারা জীবন যে আলো দিল ডেকে তার ঘুম ভাঙ্গায়োনা।”….
গানটি অত্যন্ত বেদনাময় আবহের। নজরুল এই গানটি সুনীল ঘোষ, ইলা ঘোষ প্রমুখ শিল্পীকে দিযে রেকর্ড করেছিলেন। গানটি কলকাতা বেতারেও প্রচারিত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথে গোরা উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়নের সময় নরেশ্চন্দ্র মিত্র সংগীত পরিচালকরূপে নজরুলকে মনোনীত করেন, তখন সুরকার হিসেবে নজরুলের জনপ্রিয়তা সবার উপরে। চলচ্চিত্রটি যখন মুক্তি পেতে যাচ্ছে, তখন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড থেকে আপত্তি ওঠে যে, বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে ছবিতে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হয়েছে এবং সুরও যথাযথ নয়; অতএব ছবিটি মুক্তি লাভ করতে পারে না।
প্রযোজকের মাথায় হাত! নজরুল কালক্ষেপণ না করে ফিল্মের প্রিন্ট ও প্রজেক্টার নিয়ে ট্যাক্সি করে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে চলে গেলেন। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বললেন, কী কাণ্ড বলো তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান, আর ওরা কোন আক্কেলে তোমার দোষ ধরে? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে? এ কথা বলে আগেই লিখে রাখা অনুমতি পত্রে স্বাক্ষর ও তারিখ দিয়ে দিলেন। নজরুল রবীন্দ্রনাথের স্নেহ থেকে কোনো দিন বঞ্চিত হননি।
নজরুল-রবীন্দ্রনাথের এই চিরায়ত মধুর সম্পর্ক সম্পর্কে বিন্দু-বিস্বর্গ না জেনেই অর্ধশিক্ষিত বাঙালি সমাজ নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালায়, তাদেরকে নিয়ে রাজনীতি করে, উভয়কে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার নিক্তিতে মেপে দ্বিখণ্ডিত করে। কখনো বা সম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভাজনে তাদের দু’জনকে শত্রু বানিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে যারা সত্যিকার অর্থেই জেনেছে, বুঝেছেন, ধারণ করতে পেরেছেন, তারা স্বীকার করবেন প্রকৃত অর্থেই তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ছিল অপরিমেয়, অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের ছিল অতল শ্রদ্ধা। তাদের মধ্যে শত্রুতা তো দূরে থাকুক, মনোমালিন্যও কোনো দিন হয়নি। দানবীয় প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ নিজের সারা জীবনের সুপ্ত শক্তির সাকাররূপ নজরুলের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। সে কারণে তিনি নজরুলকে বুকে টেনে নিয়েছেন, পাশে বসিয়েছেন, স্নেহ-শাসনে নজরুলের জীবন পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন কানায় কানায়।
অপরদিকে অনেকেই রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থান নিয়ে নিজেদের কাব্যপ্রতিভার ঢোল আপনা-আপনি বাজিয়ে বাংলা সাহিত্যাকাশে উল্কাবাজি ফোটানোর ব্যর্থ চেষ্টায় আত্ম নিয়োগ করলেও নজরুল সেই অপরিণামদর্শী পথ বেছে নেননি।
রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ আসনে রেখে তিনি নিজের সৃষ্টিতে ডুবে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চিন্তা তিনি করেননি বরং স্বতন্ত্র একটি ধারা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাংলাসাহিত্যে নিজের আসনটি পাকা করেছেন, রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েও বাংলা সাহিত্যে মৌলিক প্রতিভার কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।