বাঙ্গালির ভোজন-পটুতা ও খাদ্য-রসিকতার পরিচয় প্রাচীন বাংলা সাহিত্যগুলোতে পাওয়া যায়
আলাপচারিতা
বাঙালির প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত। অর্থাৎ চাল থেকে প্রস্তুতকৃত ভাত ও ভাতজাতীয় খাদ্য বাঙালির খাদ্যতালিকায় মৌলিক চাহিদার স্থান দখল করেছে বলা যায়। চালকে সিদ্ধ করে তৈরি করা ভাত বাঙালি দৈনিক দুই কি তিনবেলা খেয়ে থাকে।
দৈনন্দিন আহারের ক্ষেত্রে ভাত, ডাল, ভর্তা, ভাজা, বাটা, শাক, শুক্তো, চচ্চোরি, পাাপোড়, মাছ ভাজা, মাছের তরকারি, সবজি, মাংস, ভূনা খিচুরি, পোলাও ,লুুুচি , রুটি, পরোটা, দই , মিষ্টি , পায়েস ইত্যাদি প্রধান পদ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।
বিধবা মহিলাদের শুধুমাত্র নিরামিষ আহারের উপর নির্ভর করে নিরামিষ খাবার রান্নার এক বৃহৎ খাদ্য রেসিপি গড়ে উঠেছে
বঙ্গ অঞ্চলে বিধবা মহিলাদের উপর সবসময়ই কঠোর নীতি চালু ছিলো । যদিও ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা রোধ ও ১৮৫৬ সালে হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন এর মাধ্যমে এর অনেকটাই রোধ করা গেছে, তবুও কিছু কিছু সামাজিক আচার এখনও চালু রয়েছে । বাল্য বিবাহ এবং কম গড় আয়ুর ফলস্বরূপ অনেক মহিলাই বিধবাতে পরিণত হয়- প্রায় ৩০ শতাংশ পরিবারে একজন বিধবা মহিলা রয়েছে, যারা বাড়ির ভিতরেই আবদ্ধ থাকে এবং রান্নাবান্নার কাজেই অধিক সময় ব্যয় করে থাকে ।যদিও অধিকাংশ বাঙালি সম্প্রদায়ই মাছ মাংস খেতে পারত, বিধবা মহিলাদের জন্য এটা ছিল নিষিদ্ধ ।এ কারণেই বিধবা মহিলাদের শুধুমাত্র নিরামিষ আহারের উপর নির্ভর করে নিরামিষ খাবার রান্নার এক বৃহৎ খাদ্য রেসিপি গড়ে উঠেছে । এ সম্পর্কে একজন বাঙালি লেখিকা চিত্রিতা ব্যানার্জী তার বইতে উল্লেখ করেন ।
নিরামিষাশী ভারতীয় রেসিপি
মাংসহীন ভারতীয় আলু খাবারের:
- মুরগির ভাজা ভারতীয় আটা দিয়ে চিমটি
- আলু ডম – ভারতীয় মশলা আলু
- আনারস এবং আলু কুরি
- নিরামিষভোজী ভারতীয় স্যুপ রান্না করুন
- আলু গোবি – মসৃণ ফুলকপি এবং আলু
- আলু ডাম – মসলাযুক্ত আলু জন্য ভারতীয় রেসিপি
- ভেজে আলু গোবি (আলু এবং ফুলকপি)
- আলু মাতার (ভারতীয় আলু এবং মটর)
- ক্রক পট Vegetable কারি
- রিকোটা পনির সঙ্গে নিরামিষ Palak পিনিজ
পনির সঙ্গে ভারতীয় খাবারের:
- পালক প্যানের (নিরামিষভোজন এবং পনির)
- ভারতীয় তন্দুরি মশলা মধ্যে গ্রিল পেঁয়াজ পনির
- রিকোটা পনির সঙ্গে নিরামিষ Palak পিনিজ
- ভাজা পনের পাখি
- ভুবন নুন রেসিপি
ভারতীয় সবজি এবং টফু খাবারের জন্য:
- ভাজা তোফু টিক্কা মাসলা
- সহজ Eggplant স্নেহ-ভাজা রেসিপি
বাঙ্গালির ভোজন-পটুতা ও খাদ্য-রসিকতার পরিচয় প্রাচীন বাংলা সাহিত্যগুলোতে পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতকের নৈষধ চরিত, চতুর্দশ শতকের প্রাকৃত পৈঙ্গল এবং বৌদ্ধ সহজীয়া গান চর্যাপদ বাঙ্গালির রন্ধন শৈলীর কিছু কিছু বিবরণ রয়েছে।
মনসামঙ্গলে বরিশালের বিজয়গুপ্ত লিখেছে—
রান্ধি নিরামিষ ব্যঞ্জন হলো হরষিত।মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে হয়ে সচকিত
মৎস্য মাংস কুটিয়া থুইল ভাগ ভাগ। রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলকাতার আগ মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ ভিতরে মরিচ-গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সূত। তৈলে পাক করি রান্ধে চিঙড়ির মাথা ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল। কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল ডুম ডুম করিয়া ছেঁচিয়া দিল টই। ছাইল খসাইয়া রান্ধে বাইন মেস্যর কৈ… বারমাসি বেগুনেতে শৌল-মেস্যর মাথা।… |
” |
ময়মনসিংহের দ্বিজ বংশীদাস তার মনসামঙ্গল-এ লিখেছেন,
“ | নিরামিষ রান্ধে সব ঘৃতে সম্ভারিয়া।মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে তৈল পাক দিয়া
বড় বড় কই মৎস্য, ঘন ঘন আঞ্জি জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলিল তৈলে ভাজি। কাতলের কোল ভাজে, মাগুরের চাকি। চিতলের কোল ভাজে রসবাস মাখি ইলিশ তলিত করে, বাচা ও ভাঙ্গনা। শউলের খণ্ড ভাজে আর শউল পোনা বড় বড় ইচা মৎস্য করিল তলিত। রিঠা পুঠা ভাজিলেক তৈলের সহিত বেত আগ পলিয়া চুঁচরা মৎস্য দিয়া। শক্ত ব্যঞ্জন রান্ধে আদা বাটিয়া পাবদা মৎস্য দিয়া রান্ধে নালিতার ঝোল। পুরান কুমড়া দিয়া রোহিতের কোল… |
” |
ভারতচন্দ্র তার অন্নদামঙ্গল-এ ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী পদ্মমুখীর ব্রাহ্মণ ভোজনের নিমিত্তে রান্নার বিবরণ দিয়েছেন এইভাবে—
“ | নিরামিষ তেইশ রাঁধিলা অনায়াসেআরম্ভিলা বিবিধ রন্ধন মৎস্য মাসে।
কাতলা ভেটুক কই কাল ভাজা কে শিক-পোড়া ঝুরি কাঁঠালের বীজে ঝোল। ঝাল ঝোল ভাজা রান্ধে চিতল ফলুই কই মাগুরের ঝোল ভিন্ন ভাজে কই। ময়া সোনা খড়কীর ঝোল ভাজা সার চিঙ্গড়ির ঝোল ভাজা অমৃতের তার। কণ্ঠা দিয়া রান্ধে কই কাতলার মুড়া তিত দিয়া পচা মাছ রান্ধিলেক গুঁড়া। আম দিয়া ষোল মাসে ঝোল চড়চড়ি আড়ি রান্ধে আদারসে দিয়া ফুলবড়ি। রুই কাতলার তৈলে রান্ধে তৈল শাক মাছের ডিমের বড়া মৃতে দেয় ডাক। বাচার করিল ঝোল খয়রার ভাজা অমৃত অধিক বলে অমৃতের রাজা সুমাছ বাছের বাছ আর মাস যত ঝাল ঝোল চড়চড়ি ভাজা কৈল কত। বড়া কিছু সিদ্ধ কিছু কাছিমের ডিম গঙ্গাফল তার নাম অমৃত অসীম। |
” |
চৈতন্যচরিতামৃতের লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীক্ষেত্রে সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে চৈতন্যদেবের নিরামিষ আহারের বিবরণ যে দিয়েছেন—
“ | বর্তিসা কলার এক আঙ্গেটিয়া পাত,ঊণ্ডারিত তিন মান তণ্ডুলের ভাত।
পীত সুগন্ধি ঘৃতে অন্ন সিক্ত কৈল, চারিদিকে পাতে ঘৃত বাহিয়া চলিল। কেয়া পাতের খোলা ডোঙ্গা সারি সারি, চারিদিকে ধরিয়াছে নানা ব্যঞ্জন ভরি। দশবিধ শাক নিম্ব তিক্ত শুক্তার ঝোল, মরিচের ঝালে ছেড়াবড়ি বড়া ঘোল। দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড, বেশারী নাফরা, মোচা ঘণ্ট, মোচা ভাজা, বিবিধ শাকেরা। ফুল বড়ি ফল মূলে বিবিধ প্রকার, বৃদ্ধ কুষ্মাণ্ড বড়ির ব্যঞ্জন অপার। নব নিম্ব পত্র সহ ভ্রষ্ট বার্তকি, ফুল বড়ি, পটোল ভাজা কুষ্মাণ্ড মানচাকী। |
” |
বিভিন্ন সময়ে বঙ্গদেশ মুসলিম নবাব ও সুলতানদের অধীনে শাসিত হয়েছে । ১৭১৭ সালে মোগল শাসন আমলে এ অঞ্চলের শাসনভার নবাব মুর্শিদ কুলী জাফর খান এর হাতে ন্যস্ত করা হয় । মোগলদের শাসন আমলে স্বাভাবিকভাবেই মোগল সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের পাশাপাশি রন্ধণপ্রণালী এবং খাদ্যাভাসের প্রভাব এ অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের উপর পড়ে । বর্তমান সময়েও বিভিন্ন মোগলাই খাবার যেমন: বাকরখানি, মোগলাই পরোটা, কাবাব, হালুয়া, বিরিয়ানী ইত্যাদি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় স্থানেই ব্যাপক জনপ্রিয় ।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া