বাবরির মাথায় প্রথম শাবলের ঘা দেওয়ার পর সব খুইয়েছিলেন বলবীর ।। ইতিহাসের পাতা থেকে
আলাপচারিতা
‘আর তার চেয়ে বড় জালেম কে হবে, যে আল্লাহর ঘরে তাঁর নাম স্মরণ করা থেকে মানুষকে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালায়, এই ধরনের লোকেরা এসব ইবাদাত গৃহে প্রবেশের যোগ্যতা রাখে না। আর যদি কখনো প্রবেশ করে, তাহলে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় প্রবেশ করতে পারে। তাদের জন্য রয়েছে এ দুনিয়ার লাঞ্ছনা এবং আখিরাতের বিরাট শাস্তি। (সুরা বাক্বারা : আয়াত ১১৪)
ভারতের অযোধ্যায় যেখানে প্রায় ৫০০ বছর পুরনো বাবরি মসজিদ ছিল ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত, সেই জায়গাতেই রামমন্দির প্রাতষ্ঠা পেল।বাবরি মসজিদের সেই কাঠামোটি ১৯৯২ সালে ভেঙে ফেলে উন্মত্ত করসেবকরা।
মন্দিরটি যেখানে তৈরি হয়েছে, সেটা ভারতের সব থেকে বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানগুলির অন্যতম। ওখানেই একসময়ে ছিল ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি বাবরি মসজিদ।
বলবির সিং নওমুসলিম মোহাম্মদ আমির পণ করেছেন ১০০টি মসজিদ নতুন করে নির্মাণ ও সংস্কার করবেন। সুতীব্র এক অনুশোচনা থেকে তিনি এই কাজে নেমেছেন। এটাই তাঁর বাকি জীবনের লক্ষ্য। কী সেই অনুশোচনা? তিনি বাবরি মসজিদ ভাঙায় অংশ নেওয়া শিবসেনা কর্মী। তখন তিনি ছিলেন বলবীর সিং। আর এখন মোহাম্মদ আমির। হ্যাঁ, মুসলিম হয়েছেন তিনি।
এক সময় শিবসেনার সক্রিয় কর্মী বলবীর সিংহ এখন হয়ে গিয়েছেন মহম্মদ আমির। আল্লার নাম জপেন সব সময়। ভোরে আজান করেন। নিয়মিত।
এখন লম্বা দাড়ি রেখে তিনি মৌলবি। ভেঙে পড়া শ’খানেক মসজিদ সারাতে চান তিনি।
যেন প্রায়শ্চিত্ত!
এক সময় শিবসেনার সক্রিয় কর্মী বলবীর সিংহ এখন হয়ে গিয়েছেন মহম্মদ আমির। আল্লার নাম জপেন সব সময়। ভোরে আজান করেন। নিয়মিত।
বাবরির মাথায় শাবলের ঘা দেওয়ার পর সব খুইয়েছিলেন বলবীর। বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। না, স্ত্রীও সেই সময় তাঁর হাত ধরে বেরিয়ে আসেননি। বাবার মৃত্যুর পর বাড়ি ফিরে শুনেছিলেন, বাবা নাকি বলে গিয়েছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় সন্তানের (বলবীর) মুখ যেন বাড়ির কেউ আর না দেখেন। এমনকী, বলবীরকে যেন তাঁর বাবার মুখাগ্নিও করতে না দেওয়া হয়।
বদলের আরেক নাম যোগেন্দ্র পাল। বলবীরের বন্ধু। প্রায় ৩০ বছর আগে যিনি বলবীরের সঙ্গেই উঠেছিলেন বাবরির মাথায়। শাবলের ঘায়ে ভেঙেছিলেন মসজিদ। বহু দিন আগেই যিনি হয়ে গিয়েছেন পুরোদস্তুর মুসলিম।
এই বদলে যাওয়াটা সম্ভব হল কী ভাবে?
বলবীর বলছেন, সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, তাঁর পরিবার কোনও দিনই উগ্র হিন্দু ছিলেন না। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর ইংরেজি, এই তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি পাওয়া বলবীর তাঁর মা, বাবা, ভাই, বোনদের নিয়ে ছোটবেলায় থাকতেন পানিপথের কাছে খুব ছোট্ট একটা গ্রামে। বলবীরের বয়স যখন ১০, তখন তিনি ও তাঁর ভাইদের পড়াশোনার জন্য বলবীরের বাবা দৌলতরাম তাঁদের নিয়ে চলে যান পানিপথে।
বলবীর ‘মুম্বই মিরর’ কে বলেছেন, ‘‘আমার বাবা বরাবরই গাঁধীবাদে (মহাত্মা গাঁধী) বিশ্বাসী। তিনি দেশভাগ দেখেছিলেন। তার যন্ত্রণা বুঝেছিলেন। তাই আমাদের আশপাশে যে মুসলিমরা থাকতেন, উনি তাঁদের আগলে রাখতেন সব সময়। কিন্তু পানিপথের পরিবেশটা ছিল অন্য রকম। হরিয়ানার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা লোকজনরা তেমন মর্যাদা পেতেন না পানিপথে।’’
ফলে একটা গভীর দুঃখবোধ সব সময় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত বলবীরকে। সেই পানিপথেই একেবারে অচেনা, অজানা আরএসএসের একটি শাখার কর্মীরা বলবীরকে দেখা হলেই ‘আপ’ ‘আপ’ (আপনি, আপনি) বলে সম্বোধন করতেন।
বলবীর বলছেন, ‘‘সেটাই আমার খুব ভালো লেগেছিল। সেই থেকেই ওদের (আরএসএস) সঙ্গে আমার ওঠবোস শুরু হয়। শিবসেনা করতে করতেই বিয়ে করি। এমএ করি রোহতকের মহর্ষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওই সময় প্রতিবেশীরা ভাবতেন আমি কট্টর হিন্দু। কিন্তু বাবা কোনও দিনই মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করতেন না। আমরা কোনও দিনই যেতাম না মন্দিরে। বাড়িতে একটা গীতা ছিল ঠিকই, কিন্তু আমি বা আমার ভাইয়েরা কেউই সেটা কখনও পড়িনি। পানিপথে কেউ বাঁ হাতে রুটি খেলেও তখন তাঁকে ‘মুসলিম’ বলে হেয় করা হয়।’’
শিবসেনার লোকজনদের কাছ থেকে ‘সম্মান’ পেয়ে তাঁদের ভালো লেগে যায় বলবীরের। শিবসেনাই তাঁকে অযোধ্যায় পাঠিয়েছিল বাবরি ভাঙতে। পাঠিয়েছিল বলবীরের বন্ধু যোগেন্দ্র পালকেও। তাঁরা হয়ে যান করসেবক।
বলবীর জানিয়েছেন, বাবরি ভেঙে পানিপথে ফিরে যাওয়ার পর সেখানে তাঁকে ও যোগেন্দ্রকে তুমুল সংবর্ধনা জানানো হয়। তাঁরা যে দু’টি ইট এনেছিলেন বাবরির মাথায় শাবল চালিয়ে, সেগুলি পানিপথে শিবসেনার স্থানীয় অফিসে সাজিয়ে রাখা হয়।
কিন্তু বাড়িতে ঢুকতেই রে রে করে ওঠেন বলবীরের বাবা দৌলতরাম। বলবীরের কথায়, ‘‘বাবা আমাকে বললেন, হয় তুমি এই বাড়িতে থাকবে, না হলে আমি। তো আমিই বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। আমার স্ত্রীও বেরিয়ে এল না। থেকে গেল বাড়িতেই।’’
ওই সময় ভবঘুরের মতো জীবন কাটিয়েছেন বলবীর। জানিয়েছেন, লম্বা দাড়িওলা লোক দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠতেন তখন। বেশ কিছু দিন পর বাড়িতে ফিরে জানতে পারেন, বাবা মারা গিয়েছেন। তিনি বাবরি ভাঙায় যে দুঃখ পেয়েছিলেন বাবা, তাতেই নাকি তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
এর পর পুরনো বন্ধু যোগেন্দ্রের খোঁজখবর নিতে গিয়ে আরও মুষড়ে পড়েন বলবীর। জানতে পারেন, যোগেন্দ্র মুসলিম হয়ে গিয়েছেন। যোগেন্দ্র নাকি তখন বলবীরকে বলেছিলেন, বাবরি ভাঙার পর থেকেই তাঁর মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। যোগেন্দ্রর মনে হয়েছিল পাপ করেছিলেন বলেই সেটা হয়েছে। প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে তাই মুসলিম হয়ে যান যোগেন্দ্র।
এর পরেই আর দেরি না করে সোনেপতে গিয়ে মৌলানা কালিম সিদ্দিকির কাছে মুসলিম ধর্মে দীক্ষা নেন বলবীর। হয়ে যান মহম্মদ আমির।
‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে কী কী করতে চান বলবীর সিংহ ওরফে মহম্মদ আমির?
বলবীরের কথায়, ‘‘কম করে ভেঙে পড়া শ’খানেক মসজিদকে মেরামত করতে চাই।’’
বলবীরের দাবি, ১৯৯৩ থেকে ২০১৭, এই ২৪ বছরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে মেওয়াটে বেশ কিছু ভেঙে পড়া মসজিদ খুঁজে বের করে সেগুলির মেরামত করেছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশের হাথরাসের কাছে মেন্ডুর মসজিদও নাকি সারিয়েছেন বলবীরই। সেই কাজে মুসলিমরাই তাঁকে এগিয়ে এসে সাহায্য করেছেন, দাবি বলবীরের।
বলবির সিং নওমুসলিম মুহাম্মদ আমির সন্দেহজনক মৃত্যু
বাবরি মসজিদ ভাঙায় অংশ নেওয়া নওমুসলিম মুহাম্মদ আমির (বলবির সিং) মারা যান। শুক্রবার (২৩ জুলাই ২০২১) হায়দারাবাদ প্রদেশের তেলাঙ্গানার ভাড়া বাসায় তাঁর সন্দেহজনক মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম দ্য সিয়াসাত ডেইলি থেকে জানা যায়, হাফিজ বাবা নগরে আমিরের ভাড়া বাসা থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ার পর স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেয়। পরে কাঞ্চনবাগ থেকে পুলিশ এসে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত শুরু করে।
কাঞ্চনবাগ থানার পুলিশ ইন্সপেক্টর জে ভেঙ্কট রেড্ডি বলেন, এই সময় মৃত্যুর সঠিক কারণ সম্পর্কে জানা যায় না। আমরা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তাঁর মৃত্যুর বিষয়ে সন্দেহের কোনও অভিযোগ পেলে পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য কাজ করবে এবং মামলা করবে।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর সাবেক শিবসেনা বলবীর সিং বাবরি মসজিদ ভাঙায় অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে প্রখ্যাত ভারতীয় আলেম মাওলানা কলিম সিদ্দিকির দাওয়াতে সাাড়া দিয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
তথ্রসূত্র: মুম্বাই মিরর ও আনন্দবাজার পত্রিকা০১ জানুয়ারি ২০১৮, কালের কণ্ঠ