১৯শ শতকের শেষভাগ থেকে আল থানি গোত্রের লোকেরা কাতার অঞ্চলটিকে একটি আমিরাত হিসেবে শাসন করে আসছেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দেশটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। ১৯৭১ সালে এটি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও এটি একটি তুলনামূলকভাবে দরিদ্র দেশ ছিল।
বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব ২০১০ সালে পায় কাতার। প্রস্তুতি খাতে কাতার খরচ করেছে ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কাতারে বিশ্বকাপ হবে মোট আটটি স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়ামগুলি কাছাকাছি হওয়ায় ফুটবলপ্রেমীরা একই দিনে দুটি ম্যাচও দেখতে পারবেন মাঠে বসেই। ৬টি নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ ও দুটির সংস্কার এবং দলগুলির অনুশীলনের মাঠ প্রস্তুত করতে প্রাথমিকভাবে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু সেই গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
আধুনিক কাতার
কাতার ও ব্রিটিশ চুক্তি ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশ – আল থানি চুক্তির মাধ্যমে জন্ম লাভ করে আধুনিক কাতারের। ১৮৬৮ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে লুইস পেলি আল ওয়াকরায় মুহাম্মাদ আল থানি ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে মিলিত হন। ১২ সেপ্টেম্বর ১৮৬৮ সালে মুহাম্মদ বিন থানি চুক্তিবদ্ধ হতে সম্মত হন। বিষয় গুলো ছিলোঃ ১। দোহায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান করা। ২। সমুদ্রে অশান্তি সৃষ্টি হতে বিরত থাকা। ৩। যে নিজেদের ও প্রতিবেশীর মাঝে সৃষ্ট যে কোন ধরনের সমস্যায় ব্রিটিশদের ফয়সালা গ্রহণ করা। ৪। বাহরাইনের তৎকালীন আমীর আলি বিন খলিফার সাথে সুসম্পর্ক রাখা। ৫। বাহরাইনের পূর্ববর্তী আমির মোহাম্মদ বিন খলিফাকে কাতারে পাওয়া গেলে তাকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া।
তেল আবিষ্কারের আগে কাতারি অঞ্চলের অর্থনীতিটি মাছ ধরা এবং মুক্তো শিকারের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। ১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে জাপানি চাষ করা মুক্তো বিশ্ব বাজারে প্রবর্তনের পরে, কাতারের মুক্তো শিল্প ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪০ সালে কাতারের দুখনে তেলআবিষ্কৃত হয়েছিল। এই আবিষ্কার রাজ্যের অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করে। এদেশে বৈধ নাগরিকদের জীবনযাত্রার উচ্চমান রয়েছে। আয়কর না নেয়াতে কাতার বিশ্বের অন্যতম নিম্ন হারের দেশ। জুন ২০১৩-তে বেকারত্বের হার ছিল ০.১%। কর্পোরেট আইন হুকুম দেয় যে, কাতারি নাগরিকদের যে কোনও উদ্যোগের ৫১% থাকতে হবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অনুসারে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কাতারের মাথাপিছু চতুর্থ সর্বোচ্চ জিডিপিতে রয়েছে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি করতে বিদেশী শ্রমের উপর প্রচুর নির্ভর করতে হয়। অভিবাসী শ্রমিকরা জনসংখ্যার ৮৬% এবং শ্রমশক্তির ৯৪% রচনা করেছেন। ১৯৪০ সালে শুরু হওয়া পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্পের উপর ভিত্তি করে কাতারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় একচেটিয়াভাবে করা হয়েছে। তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের শীর্ষ রফতানিকারী দেশ কাতার। ২০১২ সালে, অনুমান করা হয়েছিল যে কাতার আগামী দশ বছরে জ্বালানি খাতে $ ১২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করবে। দেশটি পেট্রোলিয়াম রফতানিকারী সংস্থাগুলির (ওপেক) সদস্য রাষ্ট্র ছিল, ১৯৬১ সালে যোগদান করে এবং ২০১৯ এর জানুয়ারী মাসে বের হয়ে যায়।
২০১২ সালে, কাতার বিশ্বের তৃতীয়বারের জন্য (মাথাপিছু আয় অনুসারে) শীর্ষে থাকা দেশটির খেতাব অর্জন করে। ২০১০ সালে প্রথম লুক্সেমবার্গকে পেছনে ফেলেছে। ২০১২ সালে কাতারের জিডিপি ১৮২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে এবং জানা যায় যে গ্যাস রফতানি ও তেলের উচ্চমূল্যের কারণে এটি সর্বকালের উচ্চতায় পৌঁছেছিল।
২০১৭ সাল পর্যন্ত কাতারের মোট জনসংখ্যা ২৬ লক্ষ ৪১ হাজার ৬৬৯ জন। কাতারের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ কাতারের বাসিন্দা। আর বাকি ৮৬ শতাংশ লোকই বিদেশী। তারা বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য সেখানে বসবাস করে। পৃথিবীর মধ্যে কাতারই এক মাত্র দেশ যেখানে প্রায় ১৫০টি দেশের বেশি লোক বসবাস করে। আরবি ভাষা কাতারের সরকারি ভাষা। এখানকার প্রায় ৫৬% লোক আরবি ভাষাতে কথা বলেন। প্রায় এক-চতুর্থাংশ লোক ফার্সি ভাষায় কথা বলেন। বাকীরা ভারতীয় উপমহাদেশের ও ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য ভাষাতে কথা বলেন। আন্তর্জাতিক কাজকর্মে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়।
ইসলামের দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয়ে কাতারের সংস্কৃতি পূর্ব আরবের অন্যান্য দেশের মতোই। কাতার জাতীয় দিবস, ১৮ ডিসেম্বর প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়, জাতীয় পরিচয়ের অনুভূতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি জসিম বিন মোহাম্মদ আল থানির সিংহাসনে উত্তরাধিকার এবং তার পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন উপজাতির একীকরণের স্মরণে দেখা যায়। ২০০৮ সালের ১ জুলাই থেকে হামাদ বিন আবদুল আজিজ আল কাওয়ারি কাতারের সংস্কৃতি, কলা ও ঐতিহ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
কাতারে বাংলাদেশি কিছু সংগঠন আছে। যেমন, বাংলাদেশ কুরআন সুন্নাহ পরিষদ, আল হেরা শিল্পীগোষ্ঠী ইত্যাদি।
কাতার পারস্য উপসাগরের একটি দেশ। এ দেশটি আরব উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল থেকে উত্তর দিকে প্রসারিত কাতার উপদ্বীপে অবস্থিত। কাতারের দক্ষিণে সৌদি আরব আর এর পশ্চিমে দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইন অবস্থিত। আরব উপদ্বীপের মত কাতারও একটি উত্তপ্ত এবং শুষ্ক মরু এলাকা। এখানে ভূ পৃষ্ঠস্থ কোন জলাশয় নেই । প্রাণী ও উদ্ভিদের সংখ্যাও যৎসামান্য। বেশির ভাগ লোক শহরে বিশেষত রাজধানী দোহা শহরে বাস করেন। দেশটিতে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় মজুদ আছে। সেই প্রাকৃতিক সম্পদের কারণেই দেশটির অর্থনীতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ১৯শ শতকের শেষভাগ থেকে আল থানি গোত্রের লোকেরা কাতার অঞ্চলটিকে একটি আমিরাত হিসেবে শাসন করে আসছেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দেশটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। ১৯৭১ সালে এটি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও এটি একটি তুলনামূলকভাবে দরিদ্র দেশ ছিল। সে সময় দেশটিতে পেট্রোলিয়ামের মজুদ আবিষ্কৃত হয় এবং সেগুলি উত্তোলন শুরু হয়। বর্তমানে মাথাপিছু আয়ের হিসেবে কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলির একটি।
প্রাগৌতিহাসিক কাতারে স্থায়ী জনবসতির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে প্রাগৌতিহাসিক কালথেকে কাতারে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। প্রত্নতত্তবিদ ডে কার্ডির মত অনুযায়ী কাতারে প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো। সেখানের আবহাওয়া ছিলো বৃষ্টিবহুল জলপ্রপাত, উচু ঘাস এবং স্বচ্ছ পানির নালা ছিলো বলে প্রমাণও পাওয়া যায়। আধুনিক ইতিহাসের জনক হেরাডোটাসের মত অনুযায়ী কাতারে কান্নানিয়ান নামক জেলে সম্প্রদায়ের বসবাস ছিলো। তারা মাছ ধরার মৌসুমে অস্থায়ী ক্যাম্পেইন করে মাছ শিকার করতেন।প্রাচীনকালে কাতারের বিভিন্ন প্রত্নতত্ত যেমনঃ মাটির বাসন, চকমকি পাথর, পাথর কাটার যন্ত্র বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায়।
কাতারের পূর্ব উপকূল রাস আব্রুখের সাথে মেসোপটেমিয়ান আল উবায়েদ গোত্রের ব্যবসা ছিলো। পরবর্তিতে টলেমির মানচিত্রে কাতারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেখানে একে কাথারা ও এর একটি শহর কাদারা নামে দেখানো হয়।ইসলাম পূর্ব যুগে কাতার আরব উপ দ্বীপের অন্যান্য দেশের মতোই পারস্যের শাসানী রাজবংশের অধীনস্থ ছিলো। পরবর্তিতে সপ্তম শতকে সমগ্র আরব উপ দ্বীপে ইসলাম প্রসার লাভ করলে সে অঞ্চলও ইসলামের ছায়ায় চলে আসে। সে সময় বনু আমের বিন আবদ উল কায়েস বনু সাদ বিন যায়েদ মিনাহ বিন তামি্ম নামক বিভিন্ন গোত্রের বসবাস ছিলো। বর্তমান শাসক গোষ্ঠী আল সানি, আ্ল তামিমিরই একটি শাখা। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম দক্ষিণ আরবীয় অঞ্চলে ইসলাম প্রসারে আলা আল হাদরামি কে প্রেরণ করেন ৬২৮ সালে। তখন কাতার অঞ্চলে শাসন করছিলো স্থানীয় বনু তামিম গোত্র। বনু তামিমের গোত্র প্রধান মুনযির বিন সাওয়া আল তামিমি ইসলাম গ্রহণে সম্মত হন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য গোত্রে ইসলাম প্রসারে ভূমিকা রাখেন।
ইসলাম পূর্ব যুগে কাতার আরব উপ দ্বীপের অন্যান্য দেশের মতোই পারস্যের ‘শাসানী’ রাজবংশের অধীনস্থ ছিলো। পরবর্তিতে সপ্তম শতকে সমগ্র আরব উপ দ্বীপে ইসলাম প্রসার লাভ করলে এ অঞ্চলও ইসলামের ছায়ায় চলে আসে। এ সময় বনু আমের বিন আবদ উল কায়েস, বনু সা’দ বিন যায়েদ মিনাহ বিন তামি্ম নামক বিভিন্ন গোত্রের বসবাস ছিলো। বর্তমান শাসক গোষ্ঠী আল-থানি, আ্ল তামিমিরই একটি শাখা। ৬২৮ সালে। তখন কাতার অঞ্চলে শাসন করছিলো স্থানীয় বনু তামিম গোত্র। বনু তামিমের গোত্র প্রধান মুনযির বি্ন সাওয়া আল তামিমি ইসলাম গ্রহণে সম্মত হন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য গোত্রে ইসলাম প্রসারে ভূমিকা রাখেন।
ইসলামের প্রথম যুগে, কাতারে স্থায়ী বসবাস ছিলো। এছাড়া ‘মুরওয়াব’ নামক স্থানে একটি দুর্গ ও একশটির মতো পাথুরে বাড়ীর সন্ধান মিলে। এ সময় কাতারের মূল ব্যবসা মাছ এর পাশাপাশি উট ও ঘোড়া পালন ও বিক্রয় ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। হাদীস থেকে জানা যায়, কাতারে এক ধরনের কাপড় তৈরি হতো উটের পশম থেকে। এটিও কাতারের অন্যতম ব্যবসায়িক আকর্ষণ ছিলো। উমাইয়া (৬৬১-৭৫০ খ্রী) ও আব্বাসীয় (৭৫০-১২৫৮ খ্রী) আমলে দামেস্ক ও বাগদাদ কেন্দ্রিক ব্যবসা গড়ে ওঠে। উমাইয়া আমলে এ অঞ্চল বিখ্যাত উট ও ঘোড়া ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়। আব্বাসীয় আমলে মুক্তা ব্যবসার উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। কাতারি মুক্তার চাহিদা প্রাচ্যের দেশগুলোয় বেড়ে চলে, চীনেও কাতারি মুক্তার চাহিদা ছিলো।