ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। প্যালেস্টাইনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দিল একাধিক দেশ
ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। প্যালেস্টাইনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দিল একাধিক দেশ।। এর জেরে আগামী দিনে ইজ়রায়েলের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে বলেই মনে করছেন দুনিয়ার দুঁদে কূটনীতিকদের একাংশ। একসময়ে ইহুদিদের প্রবল সমর্থক ব্রিটেন, ফ্রান্স বা কানাডার মতো রাষ্ট্রগুলির গলায় কেন হঠাৎ উল্টো সুর? বর্তমানে এই প্রশ্নেরই জবাব খুঁজছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসাবে পরিচিত একগুচ্ছ পশ্চিমি দেশের প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার পর থেকে নানা ইস্যুতে ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করেছেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হল শরণার্থী সমস্যা এবং শুল্ক। ফলে সুযোগ বুঝে ইজ়রায়েলকে নিশানা করার মাধ্যমে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলি আদপে ওয়াশিংটনকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে।
কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝে নেওয়া যেতে পারে। গত এপ্রিলে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি চালু করেন ট্রাম্প। ফলে পশ্চিম ইউরোপের ‘বন্ধু’ দেশগুলির পণ্যে মোটা হারে কর চাপিয়ে দেয় তাঁর প্রশাসন। এতে বাণিজ্যিক লোকসানের মুখে পড়ে সে সব দেশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে আমেরিকার শর্ত মেনে বাণিজ্যচুক্তি করতে বাধ্য হয় ওই সমস্ত রাষ্ট্র। এতে যে ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো পরমাণু শক্তিধর দেশগুলি বেজায় চটেছিল, তা বলাই বাহুল্য।

দ্বিতীয়ত, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শরণার্থী সমস্যা মেটাতে একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ করছেন ট্রাম্প। ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার বেআইনি অনুপ্রবেশকারীকে গ্রেফতার করে সামরিক বিমানে তাঁদের নিজের দেশে ফেরত পাঠিয়েছে তাঁর সেনা। ওই সময় ধৃতদের হাতে-পায়ে পরানো ছিল লোহার বেড়ি, যা নিয়ে ট্রাম্পকে সমালোচনায় বিদ্ধ করে বিশ্বের বহু দেশ। যদিও তাতে একেবারেই দমে যাননি তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যুক্তি, মুসলিম শরণার্থী সমস্যা ইউরোপ এবং আমেরিকার অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতি এবং রাজনীতির প্রবল ক্ষতি করছে। ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো দেশগুলি তা মানতে নারাজ। বর্তমানে আটলান্টিকের পারের ওই দুই ইউরোপীয় রাষ্ট্রে যে রাজনৈতিক দলগুলির সরকার রয়েছে, তাদের ভোটব্যাঙ্কের একটি বড় অংশ হল ইসলাম ধর্মাবলম্বী শরণার্থী। আর তাই ঘরোয়া রাজনীতিতে নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে তারা প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দিলেন বলে মনে করা হচ্ছে।
গত বছরের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা বলেন ট্রাম্প। উত্তরের প্রতিবেশী দেশটিকে আমেরিকার ৫১তম রাজ্যে পরিণত করার প্রবল বাসনা রয়েছে তাঁর। সেই লক্ষ্যে অটোয়ার পণ্যে বিপুল পরিমাণে শুল্ক চাপিয়ে দেন তিনি। ট্রাম্পের চাপেই ইস্তফা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মার্ক কার্নি। আমেরিকার ‘আগ্রাসন’ কোনও অবস্থাতেই মানা হবে না বলে ঘোষণা করেছেন তিনি।
কানাডার পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার ইচ্ছাও রয়েছে ট্রাম্পের। সুমেরু সাগর সংলগ্ন এলাকাটির দূরত্ব যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের থেকে খুব বেশি নয়। যদিও এর মালিকানা রয়েছে ডেনমার্কের কাছে। সেই কারণে রাজনৈতিক ভাবে গ্রিনল্যান্ডকে ইউরোপের অংশ বলে মনে করা হয়। দুনিয়ার সর্ববৃহৎ দ্বীপটিকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ-হেন সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবে সেখানকার দেশগুলি যে খুশি হয়নি, তা বলাই বাহুল্য।
তৃতীয়ত, গত শতাব্দীর ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’র সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) আগ্রাসন রুখতে ইউরোপীয় ‘বন্ধু’ দেশগুলির মধ্যে একটি সামরিক জোট তৈরি করে আমেরিকা। সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটির নাম ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন)। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ৩২। এদের মূল নিরাপত্তার দায়িত্ব এত দিন নিজের কাঁধে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে বদলাতে শুরু করে পরিস্থিতি। নেটো-ভুক্ত দেশগুলিকে প্রতিরক্ষা ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির নির্দেশ দেন তিনি। আমেরিকার পক্ষে সকলকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয় বলে স্পষ্ট বিবৃতি দিতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। ফলে সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের আতঙ্কে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মধ্যে কাঁপুনি ধরে গিয়েছে। কূটনীতিকদের কেউ কেউ মনে করেন, প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ট্রাম্পের উপরে পাল্টা চাপ তৈরি করতে চাইছেন তাঁরা।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, হামাসকে সমূলে ধ্বংস করতে প্যালেস্টাইনের গাজ়ায় লাগাতার ‘এয়ারস্ট্রাইক’ করে চলেছে ইহুদি বায়ুসেনা। সেই সঙ্গে প্রতি ইঞ্চি জমি দখল করতে সেখানে ‘গ্রাউন্ড অপারেশন’ চালাচ্ছে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ। শুধু তা-ই নয়, ওই এলাকায় কোনও খাবার, পানীয় জল বা ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ঢুকতে দিচ্ছে না তারা। এর জেরে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে গাজ়ায়।
পশ্চিম ইউরোপের রাজনীতি এবং সমাজজীবনে মানবাধিকার সংগঠনগুলির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছে তারা। সংশ্লিষ্ট দেশগুলির প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ার নেপথ্যে সেই চাপও কাজ করেছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
এ বারই প্রথম পশ্চিমি দেশগুলি প্যালেস্টাইনকে দেশের মর্যাদা দিতে রাজি হয়েছে, এমনটা নয়। কয়েক বছর আগে প্রথম এই পদক্ষেপ করে স্পেন। পরে মাদ্রিদের দেখাদেখি একই সিদ্ধান্ত নেয় নরওয়ে এবং আয়ারল্যান্ড। এ ছাড়া সাম্প্রতিক অতীতে ক্যারিবিয়ান সাগরের বার্বাডোজ়, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, জামাইকা এবং বাহামাও প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েলের জন্মের সময় থেকেই ইহুদি রাষ্ট্রটির অস্তিত্বকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় সমস্যা। তেল আভিভ দ্বিরাষ্ট্রের ভাবনাকে মেনে নিলেও তাতে আপত্তি ছিল প্যালেস্টাইনি জনতা এবং অন্যান্য আরব দেশগুলির। এই বিবাদের জেরে গত ৭৭ বছরে একাধিক যুদ্ধ হয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রে ইহুদিদের পাশে ছিল পশ্চিমি দুনিয়া। যদিও তাতে যে সংঘাত থেমেছে এমনটা নয়। দ্বিরাষ্ট্র তত্ত্বকে সামনে রেখে এ বার তাই সংঘর্ষ বন্ধ করতে চাইছেন তারা।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছেন রাশিয়া। ওই যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি মস্কোর উপর ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়। কিন্তু তাতে নিজের জালেই জড়িয়ে পড়ে তারা। কারণ, ওই এলাকার সমস্ত রাষ্ট্র অপরিশোধিত খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য ক্রেমলিনের উপর নির্ভরশীল ছিল।
গত দু’বছর ধরে প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ লড়ছে ইজ়রায়েল। এই লড়াইয়ের গোড়ার দিকে ইহুদিদের নিশানা করে লেবাননের সহিংস সংগঠন হিজ়বুল্লা। সঙ্গে সঙ্গে তেল আভিভ প্রত্যাঘাত শানালে জটিল হয় পরিস্থিতি। সংঘর্ষ পরিস্থিতিতে ইজ়রায়েলকে হাতিয়ার দেওয়া বন্ধ করে ফ্রান্স। এর পরই বেইরুটের ফরাসি তেল সংস্থায় বোমাবর্ষণ করে ইহুদি বিমানবাহিনী। ফলে দু’তরফে আরও খারাপ হয় সম্পর্ক।

নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্তমানে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলিকে ইজ়রায়েলের কট্টর শত্রু হিসাবে পরিচিত আরব রাষ্ট্রগুলির থেকে উচ্চ মূল্যে ‘তরল সোনা’ আমদানি করতে হচ্ছে। কূটনীতিকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বার্থে প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দিয়েছে তারা। এর জেরে খনিজ তেলের দামে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার আশা রয়েছে তাদের।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন, পশ্চিমি দেশগুলির প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনও অর্থ নেই। কারণ, এই পদক্ষেপের জেরে ওই এলাকায় শান্তি ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ইতিমধ্যেই ‘বৃহত্তর ইজ়রায়েল’ তৈরির ঘোষণা করেছেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সেই লক্ষ্যে সম্পূর্ণ গাজ়া দখলে ক্রমাগত আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াচ্ছে তাঁর বাহিনী।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো পশ্চিমি দেশগুলিতে আগামী দিনে দূতাবাস খোলার সুযোগ পাবে প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষ। দেশটির ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের শাসনক্ষমতা রয়েছে তাদের হাতে। কূটনৈতিক দিক থেকে সেটা ইজ়রায়েলের জন্য মোটেই ভাল নয়।
এ সব কিছুকে পাত্তাই দিচ্ছেন না যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পুরোপুরি ভাবে ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় দেওয়া বক্তৃতায় পশ্চিমি দেশগুলিকে নিশানা করতে দেখা যায় তাঁকে। শরণার্থী সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আপনারা নরকের দিকে এগোচ্ছেন।’’ পাশাপাশি, প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ায় হামাসের হাত শক্ত হল বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলে ঢুকে মারাত্মক হামলা চালায় হামাস। বহু ইহুদিকে পণবন্দি করে গাজ়ায় নিয়ে যায় তারা। সেই অপহৃতদের একাংশকে এখনও ছাড়েনি ওই প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র সংগঠন। এই পরিস্থিতিতে গাজ়ার নিরাপত্তায় ইসলামীয় দেশগুলিকে বাহিনী মোতায়েনের পরামর্শ দিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে তুরস্ক বা পাকিস্তানের সেনা সেখানে থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা আদৌ নেতানিয়াহু সরকার মানবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা