ভারতবর্ষর স্বাধীনতা আন্দোলন ইতিহাস ।। কোম্পানি শাসনের অবসানে রয়েছে হিন্দু মুসলিমের অবদান
রুহুল কুদ্দুস টিটো
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন নরমপন্থী এবং চরমপন্থী, এই দু’টি বিপরীত ধারায় সম্পন্ন হয়েছিল। এই আন্দোলন ও ভারতের সর্ববস্তরের মানুষ এর মিলিত আন্দোলনের ফলে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত বিভাগের মাধ্যমে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দু’টি দেশ সৃষ্টি হয়।
১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা অধিনিয়ম ১৯৪৭ (১৯৪৭ সি. ৩০ (১০ এবং ১১ জিও. ৬.) হল যুক্তরাজ্যের সংসদের একটি আইন, যার ফলে বিভক্ত ব্রিটিশ ভারত দুটি নতুন অধিরাজ্য ভারত এবং পাকিস্তানে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৮ই জুলাই এই আইনটি রাজকীয় সম্মতি পেয়েছিল, এবং এইভাবে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান (তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান, এখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) অঞ্চল তৈরি হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রাম
বিদ্রোহের আগুন প্রথম জ্বলে উঠে পশ্চিম বঙ্গের ব্যারাকপুরে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ বন্দুকের গুলি ছুড়ে বিদ্রোহের সূচনা করেন
মঙ্গলপান্ডে নামে এক সিপাহী। দ্রুত এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে মিরাট,কানপুর পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার, বাংলাসহ ভারতেরপ্রায় সর্বত্র। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেট, কুমিল্লা,পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী এই বিদ্রোহে শামিল হয়।
বিদ্রোহীরা দিল্লি দখল করে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতবর্ষের বাদশা বলে ঘোষণা করে। ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড
ক্যানিং সিপাহী জনতার এই বিদ্রোহ নিষ্ঠুর এবং অত্যন্ত কঠোর হাতেদমন করে। এই সংগ্রামের সঙ্গে জড়িতদের বেশির ভাগ হয় যুদ্ধে শহিদ হন তাঁদের অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
বাহাদুর শাহ পার্ক, ঢাকামুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গুন, মায়ানমার) নির্বাসিত করা হয়। ঝাঁসির রাণী ল²ীবাঈ যুদ্ধে শহীদ হন। নানা সাহেব পরাজিত হয়ে অন্তর্ধান হন। সাধারণ সৈনিক বিদ্রোহীদের উপর নেমে আসে চরম অমানবিক নির্যাতন।
ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে ঝুলিয়ে রাখা হয় অনেক সৈনিকের লাশ। এভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ভারতের
প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সংগ্রামের ব্যর্থতার কারণ
১. সুনির্দিষ্ট, সমন্বিত পরিকল্পনা এবং একক নেতৃত্বের অভাব।
২. সাংগঠনিক দুর্বলতা, প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র ও রসদের অভাব।
৩. শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণি, অধিকাংশ দেশীয় রাজা, জমিদার, সৈন্যদের একটি অংশের অসহযোগিতা।
৪. অপর দিকে ইংরেজদের উন্নত সামরিক কৌশল, উন্নতমানের অস্ত্র, সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাদের
জয়ী করেছে।
প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্ব
১. স্বাধীনতা সংগ্রাম বিদ্রোহর ফলে ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান হয়। ব্রিটিশ সরকার ও পার্লামেন্টের হাতে ভারত
শাসনের দায়িত্ব অর্পিত হয়।
২. ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর মহারানী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্রে স্বত্ববিলোপ নীতি এবং এর সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য নিয়ম
বাতিল করা হয়। তাছাড়া এই ঘোষণা পত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী ভারতীয়দের চাকরি প্রদান এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার
নিশ্চয়তাসহ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।
এই বিদ্রোহের সুদূর প্রসারি গুরুত্ব হচ্ছে, বিদ্রোহের ক্ষোভ থেমে থাকেনি। এই সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ সচেতন হয়ে
উঠে এবং নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটায়।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল একটি পরিব্যাপ্ত, একত্রীভূত বিভিন্ন জাতীয় এবং আঞ্চলিক অভিযান বা আন্দোলন যা অহিংস ও বৈপ্লবিক উভয় দর্শনের প্রচেষ্টায় এবং ভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব এবং অন্যান্য ঔপনিবেশিক প্রশাসন শেষ হয়। সাধারণ ছিল।পর্তুগিজের দ্বারা কর্ণাটকে ঔপনিবেশিক বিস্তারের শুরুতে ষোড়শ শতকে প্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন হয়েছিল। সপ্তদশ শতকের মধ্য ও শেষ ভাগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা উত্তর ভারতে ঔপনিবেশিক বিস্তারের প্রতিরোধ আন্দোলন হয়েছিল।
মহারাষ্ট্রে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ বিদ্রোহের আগুন জ্বালেন বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে এই আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। তারা প্রার্থনা, আবেদন-নিবেদন এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে এক মধ্য পন্থা অবলম্বন করেছিল। ফলে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে লাল-বাল-পাল এবং শ্রী অরবিন্দ এর দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতার আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদ ইন্দো-জার্মানি ষড়যন্ত্রএবং গদর ষড়যন্ত্র প্রভাব বিস্তার করছিল। যুদ্ধের শেষ প্রান্তে কংগ্রেস অহিংস আন্দোলনের নীতিমালা অবলম্বন করেছিল এবং অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী নেতৃত্ব দিয়েছিল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু’র মত অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পরবর্তীকালে একটি বৈপ্লবিক দর্শন অবলম্বন করে আন্দোলনে করতে এসেছিলেন।
বিদেশী নিয়মের বিরুদ্ধে কতিপয় আঞ্চলিক আন্দোলন ১৮৫৭ সালের আগে ভারতের বিভিন্ন অংশে গড়ে উঠেছিল। উপরন্তু, তাদেরকে একত্র করা যায়নি এবং বিদেশী শাসকের দ্বারা সহজভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরুপ ১৫৫৫ থেকে ১৫৭০ থেকে কর্ণাটকে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে অব্বাক্কা রাণীর বিদ্রোহ, ১৭৭০ সালে বাংলায় সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, গোয়ায় পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ১৭৮৭ নৃ-তাত্ত্বিক বিদ্রোহ যা পিন্টোস ষড়যন্ত্র হিসেবে পরিচিত, ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহরূপে বাংলাতে তিতুমীরের ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ভারতে ভীরাপান্ডা কাট্টাবমান বিদ্রোহ, কর্ণাটকে রানী চেন্নামার কিট্টুর বিদ্রোহ, সৌরাষ্ট্রে কচ্ছ বিদ্রোহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ভারত ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজশক্তির স্বায়ত্বশাসনে ছিল। তারপর ভারত একটি প্রজাতন্ত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান ১৯৫৬ সালে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অধিকার লড়াইয়ের একটি গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছিল তার ফলে গণতন্ত্রের স্থগিতাবস্থা এসেছিল।
স্বাধীনতা আন্দোলন পরিণামস্বরুপ বিশ্বের নেতৃত্বদানের অন্যান্য অংশতে একই আন্দোলনের মাধ্যমে একটি প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল ও কমনওয়েলথ জাতির সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং এর বদলানোর ভেঙে। অহিংস প্রতিরোধের গান্ধীর দর্শন মার্কিন নাগরিক অধিকার আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল ও মার্টিন লুথার কিং (১৯৫৫-১৯৬৮) এর নেতৃত্ব দিয়েছিল।
মায়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য অং সান সু চি’র মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতে বর্ণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের লড়াই নেলসন ম্যান্ডেলা’র মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েছিল। উপরন্তু এই সমস্ত নেতারা অহিংস এবং অপ্রতিরোধ্যের গান্ধীর নিয়মনিষ্ঠ নীতিতে অনুগত থাকেননি।
১৮৫৭–৫৮ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উত্তর এবং মধ্য ভারতে বিদ্রোহের ভারতীয় মহাবিদ্রোহ (সিপাহী বিদ্রোহ), ১৮৫৭ ছিল একটি পর্যায়কাল। এই বিদ্রোহ ছিল কয়েক দশকের ভারতীয় সৈন্য এবং তাদের ব্রিটিশ অফিসারের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ফল। মুঘল এবং পেশয়ার মত ভারতীয় শাসকদের প্রতি ব্রিটিশের ভিন্ন নীতি এবং অযোধ্যার সংযুক্তি ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক মত পার্থক্য সূত্রপাত করছিল। লর্ড ডালহৌসীর স্বত্ত্ববিলোপ নীতি যা দিল্লীর মুঘল সাম্রাজ্যের অপসারণ, কিছু জনগণ রেগে গিয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহ সুনির্দিষ্ট কারণ যে ১৮৫৩ সালে তৈরি .৫৫৭ ক্যালিবার এনফিল্ড(পি/৫৩) রাইফেল কার্তুজ গরু ও শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরি হতো। সৈন্যেরা তাদের রাইফেলের কার্তুজ লোড করার সময় তাদের তা দাঁত দিয়ে ভাঙে লাগাতে হতো। যেহেতু গরু ও শুকরের চর্বি মুখে দেওয়া হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সৈন্যদের কাছে অধার্মিক কাজ ছিল। ফেব্রুয়ারি ১৮৫৭তে, সিপাহীরা (ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য) নতুন কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছিল। ব্রিটিশ নতুন কার্তুজ প্রতিস্থাপন করার দাবী করেছিল এবং যা মৌমাছির তেল ও শাকসব্জী তেল থেকে তৈরী হবে। কিন্তু সিপাহীদের কাছে গুজব টিকে থেকেছিল।
বাঙালিরা কখনই বিদেশি ইংরেজ শাসকদের মেনে নেয়নি। যার প্রমাণ পলাশীর যুদ্ধের পর পর একের পর এক কৃষক
বিদ্রোহ। পরাধীনতার একশ বছর পরেও স্বাধীনতা ঘোষণা করে এ দেশের সৈনিকরা ও দেশীয় রাজরাজারা। পরবর্তী
সময়ে স্বাধীকার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ সমাজ। বাঙালি তরুণরা সশস্ত্র সংগ্রামের
মাধ্যমে দলে দলে আত্মাহুতি দিয়ে কাঁপিয়ে তোলে ইংরেজ শাসনের ভিত। উপমহাদেশের স্বাধীকার স্বাধীনতা আন্দোলনে
সবচেয়ে গৌরবময় ভ‚মিকা ছিল বাঙালিদের। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামসহ পরবর্তী আন্দোলন
সমূহে বাঙালি তথা তৎকালীন ভারতবাসীর গৌরবের ও আত্মত্যাগের ইতিহাস ।
মঙ্গল পাণ্ডের নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরে শুরু হয় এবং শীঘ্রই তা মিরাট, দিল্লি এবং ভারতের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এটা সারা বাংলাদেশ জুড়ে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং সিলেট, যশোর, রংপুর, পাবনা ও দিনাজপুরের খণ্ডযুদ্ধসমূহ বাংলাদেশকে সর্তক ও উত্তেজনাকর করে তুলেছিল। ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী প্রকাশ্য বিদ্রোহে মেতে ওঠে এবং জেলখানা হতে সকল বন্দিদের মুক্তি দেয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ দখল করে নেয়, কোষাগার লুণ্ঠন করে এবং অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ত্রিপুরার দিকে অগ্রসর হয়।
চট্টগ্রামে সিপাহিদের মনোভাব ঢাকার রক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। সিপাহিদের আরও অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ ৫৪তম রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানি এবং একশত নৌ-সেনা ঢাকায় প্রেরণ করে। একই সাথে যশোর, রংপুর, দিনাজপুরসহ বাংলাদেশের আরও কয়েকটি জেলায় একটি নৌ-ব্রিগেড পাঠানো হয়। প্রধানত ইউরোপীয় বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠিত করে ঢাকা রক্ষা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নৌ-বিগ্রেড ঢাকা পৌঁছে সেখানে নিয়োজিত সিপাহিদের নিরস্ত্র করতে গেলে অবস্থা চরমে ওঠে। ২২ নভেম্বর লালবাগে নিয়োজিত সিপাহিগণকে নিরস্ত্র করতে গেলে তারা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। সংঘটিত খণ্ডযুদ্ধে বেশ কিছু সিপাহি নিহত ও বন্দি হয় এবং অনেকেই ময়মনসিংহের পথে পালিয়ে যায়। অধিকাংশ পলাতক সিপাহিই গ্রেপ্তার হয় এবং অতিদ্রুত গঠিত সামরিক আদালতে সংক্ষিপ্ত বিচারের জন্য তাদের সোপর্দ করা হয়। অভিযুক্ত সিপাহিদের মধ্যে ১১ জন মৃত্যুদণ্ড এবং বাকিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। এ রায় দ্রুত কার্যকর করা হয়।
বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর এবং যশোরে চাপা ও প্রকাশ্য উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। পলাতক সিপাহি ও ইউরোপীয় সৈন্যদের মধ্যে সিলেট এবং অপরাপর স্থানে কয়েকটি সংঘর্ষ ঘটে, যার ফলে উভয় পক্ষেই প্রাণহানি ঘটে। সিলেট এবং যশোরে বন্দি ও নিরস্ত্র সিপাহিদের স্থানীয় বিচারকদের দ্বারা সংক্ষিপ্ত বিচার করা হয়। ফাঁসি ও নির্বাসন ছিল এ সংক্ষিপ্ত বিচারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
সিপাহি যুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া একটি অনুজ্জ্বল চিত্র প্রতিফলিত করে। জমিদার-জোতদারগণ নিশ্চিতভাবে সিপাহিদের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ গরু ও ঘোড়ার গাড়ি এবং হাতি সরবরাহ; পলায়নরত সিপাহিদের গতিবিধির সন্ধান প্রদান এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে স্থানীয় স্বেচ্ছসেবক বাহিনী গড়ে কোম্পানির স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কৌশলগত সমর্থন প্রদান করেন। সরকার কৃতজ্ঞতার সাথে জমিদার-জোতদারগণের এ সকল সেবার স্বীকৃতি প্রদান করে এবং পরে তাদেরকে নওয়াব, খান বাহাদুর, খান সাহেব, রায় বাহাদুর, রায় সাহেব প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করে ও নানা পার্থিব সম্পদ দ্বারা পুরস্কৃত করে। জমিদার-জোতদারগণের প্রদর্শিত ভূমিকা অনুসরণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীও কোম্পানির সরকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। সাধারণ মানুষ ও কৃষককুল সার্বিকভাবে এ বিষয়ে উদাসীন ছিল এবং সিপাহি যুদ্ধের স্পর্শ থেকে দূরে ছিল। তবে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধির ফলে তারা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও এই মহাবিদ্রোহ আঠেরেশো শতকের পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণ অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে যা ইংরেজ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দেয়। জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক ও পন্ডিতেরা তাই একে সিপাহী বিদ্রোহের বদলে জাতীয় মহাবিদ্রোহ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
ভারত বর্ষর স্বাধীনতায়
‘দিল্লিতে, যেখানে নরেন্দ্র মোদি থাকেন প্রতিদিন। সেখানে আছে ইন্ডিয়া গেট। সেখানে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করা শহীদদের নাম লেখা আছে। মোট নামের সংখ্যা ৯৩৩৬৩ জন।যেখানে ৬২,৯৪৫ জন মুসলমান শহীদের নাম পাবেন, কিন্তু কোনো আরএসএস বিজেপি নেতার একটি নাম খুঁজে পাবেন না’- কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরীর বক্তব্যের এই ভিডিও ক্লিপটি ভারতে চলমান অস্থিতশীল পরিস্থিতির মাঝে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছিল।
১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজুদ্দৌলা, ১৭৯৯ সালে মহিশুরের সিংহ টিপু সুলতান হিন্দুস্তানের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাত বরণ করেন। মহাবীর টিপু সুলতানকে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি ভয় পেত। তাকেই দখলদারিত্বের পথে সবচেয়ে ভয়ংকর কাঁটা মনে করত।
টিপু সুলতান নিহত হওয়ার পর ইংরেজর শাসকরা বলেছিল, ‘আজ থেকে হিন্দুস্তান আমাদের’
এরপর সময়ের পরিক্রমায় ১৮৫৭ সালে আবার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। এই সময় হিন্দুস্তানের সমস্ত জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুসলমানরা এ সময় তুলনাহীন ও অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার করেন। হাজারো মুসলমান-উলামায়েকেরামকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। গ্রেফতার করে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হয়। ইতিহাসে সবচেয়ে নির্মম ও জঘন্যভাবে তাদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো হয়। হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুই লাখের বেশি মুসলমান শহিদ হয়েছিল!
ফিল্ড মার্শাল রবার্ট নিজের হিন্দুস্তান মে ৪১ সাল গ্রন্থে লিখেছেন, শুধু ১৮৫৭ সালেই ২৭ হাজার মুসলমানকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে! আর নির্বিচারে গণহত্যার শিকার হয়েছে অগণিত মুসলমান! ইতিহাস বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড থমাস লিখেছেন, ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত মাত্র তিন বছরে ১৪ হাজার মুসলমানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া,বিবিসি বাংলা, নয়াদিগন্ত