আবুল বাশার একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক
তিনি পশ্চিমবঙ্গের, মুর্শিদাবাদ জেলার হামারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাশার বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য পরিচিত। সাধারণ মানুষের জীবনকে তিনি তাঁর সাহিত্যে বিশেষ ভাবে স্থান দিয়েছেন।
জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৫১
তার বই ”ভোরের প্রসূতি ”অবলম্বনে ২০১৯ সালে সিতারা চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।তার রচিত গ্রন্থগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হল:ফুল বউ,ভোরের প্রসূতি,সুরের সম্পান,জল মাটি আগুনের উপাখ্যান,ধর্মের গ্রহণ,ভোর পেটি তারা,অগ্নিবলাকা,স্পর্শের বাইরে।
আবুল বাশারকে নিয়ে লিখলেন মেহেরপুরের সন্তান কাজী হাফিজ
আবুল বাশারকে দূরের মানুষ মনে হয় না
আমি অবাক হয়ে আবুল বাশারকে নয়, জীবনের প্রথম একজন নাস্তিক দর্শন করলাম
কাজী হাফিজ
কথাশিল্পী আবুল বাশারের বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে ধর্মত্যাগের অভিযোগ উঠেছিল।
‘আজকাল’ পত্রিকার এক সংবাদে জানানো হয়েছিল, তিনি তাঁর নামের আগে মোহাম্মদ শব্দটি বাদ দিয়েছেন। উনিশ শ চুরাশি সালের শেষদিকের ঘটনা এটি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর তখন ভারতব্যাপী লোকসভা নির্বাচন। ডায়েরির পাতায় তারিখটি উল্লেখ নেই। তবে স্মরণ আছে একটি শীতার্ত বিকেলের কথা।
নদীর ওপারে ম্লান অস্তগামী সূর্য সারা গায়ে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে দিগন্তে ডুবে যাচ্ছে। আমরা তিনজন। আমি, শেখ আনিস ও সব্যসাচী সমাজদার। নদীর পার ঘেঁষে মেঠো রাস্তা পেরিয়ে বাইসাইকেলে আবুল বাশারের গ্রামে যাচ্ছিলাম।
যেতে যেতে কথা হচ্ছিল বিষয়টি নিয়ে। শেখ আনিস তাঁর ধর্মদ্রোহিতার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে একটি গল্প বললেন। বাশার ভাই তাঁর এক গল্পে আরবি ‘কাফ’ অক্ষরটিকে কুকুরের বাঁকা লেজের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এই নিয়ে স্থানীয় মোল্লারা খেপেছিল খুব। এসব পথচলতি আলাপ। একসময় গ্রামে যখন পৌঁছেছি তখন সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসছে।
ইচ্ছা ছিল যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসব। রাত কাটাব ডোমকুলে। সকালে সেখান থেকে রওনা হব স্বদেশ- বাংলাদেশের উদ্দেশে। সে ইচ্ছার কথা সঙ্গী দুজনও জানতেন। কিন্তু তাঁরা সন্দিহান। বিশেষ করে শেখ আনিস আমাকে নিরাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, যদি বাশার ভাই ছাড়ে! শেষ পর্যন্ত সে সন্দেহই সত্যি হলো। বাশার ভাই ছাড়লেন না।
আমরা তাঁর বাড়ির দরজায় হাজির হয়ে উপস্থিতি জানান দিতেই বেরিয়ে এলেন তিনি। পরনে লুঙ্গি আর খালি গায়ে; বাংলাদেশের প্রয়াত কৌতুক অভিনেতা রবিউলের মতোই স্বাস্থ্যহীন মানুষ মনে হচ্ছিল তাঁকে। বাইরে এসেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আপনার আসার কথা তো কদিন আগেই শুনেছি। আপনি আমার কাছে আসবেন এ অপেক্ষায় প্রতিদিনই সময় কাটছে।
এমনিতে আমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। তারপর এ আন্তরিক আচরণ আমাকে বিমূঢ় করে দিল। সে বিমূঢ়তার মাঝে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত ফিরে গেলেন। গায়ে শার্ট চাপিয়ে ফিরে এলেন ততোধিক দ্রুততায়। এসে সব্যসাচীর সাইকেল নিয়ে ‘একটু আসছি’ বলেই উধাও। ফিরলেন মিনিট পনেরো পর সারা রাত আড্ডার আয়োজন নিয়ে। কয়েক তাড়া পাতার বিড়ি, প্যাকেট দুই চারমিনার সিগারেট, মুড়ি-চানাচুর এবং সেই সঙ্গে চা-পাতা আর চিনি। সাইকেল থেকে নামতে নামতে বললেন, চলবে তো এতে সারা রাত? পাশ থেকে শেখ আনিস টিপ্পনি কাটলেন। বলবেন ফিরে যাওয়ার কথা।
আবুল বাশারের সঙ্গে এটি ছিল আমার দ্বিতীয়বারের মতো দেখা হওয়া। এর আগে তাঁকে দেখেছিলাম তিরাশির প্রথমার্ধে। তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন শেখ আনিস। আবুল বাশারের নিকটতম বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক কারণে মুক্তিযুদ্ধের পর বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশ প্রবাসী শেখ আনিস থাকতেন আমাদের জেলা শহর মেহেরপুরে। তাঁর পরামর্শে মেহেরপুর থেকে ‘কাগজ’ নামে একটি ছোট পত্রিকা বের করতাম একসময়।
সে পত্রিকায় আবুল বাশার কয়েকটি লেখাও পাঠিয়েছিলেন। কবিতা। গল্প লেখা হয়তো তখনো তিনি শুরু করেননি। কবিতাগুলো খুব বেশি শিল্পোত্তীর্ণ মনে হয়নি তখন। একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে। শিরোনাম ‘ভাই একটু আগুন হবে’। ধূমপানের নিমিত্তে নয়, কবির এ অগ্নিপ্রত্যাশা ছিল সমাজ-বিপ্লবের প্রয়োজনে।
পরে শেখ আনিস স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পর আবুল বাশারের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল উনিশ শ তিরাশি সালে। সেবারও তাঁর বাসায় রাত কাটে। সারা রাত বিনিদ্র শুনেছিলাম তাঁর লেখা একের পর এক গল্প। একজন মুসলমান, চোর, চাবি, ঘর করা, ফুটকি, এক টুকরো চিঠি—এসব গল্প এখনো স্মৃতিতে বহাল।
শুধু গল্প নয়, গল্পকারের পঠন ভঙ্গিটিও মনে পড়ে।
স্পষ্ট উচ্চারণ ও অভিব্যক্তি একজন শ্রোতার ঘুম হারাম করে দেওয়ার জন্য ছিল যথেষ্ট। মনে আছে মধ্য রাতে মূত্রথলিতে অস্বস্তিকর চাপ নিয়ে ঘরের বাইরে পা রাখতেই ‘কে-এ-এ’ এই প্রশ্নে বিব্রতকর পরিস্থিতি রচনা করেছিলাম। বাইরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিলেন আবুল বাশারের জনক।
লুকিয়ে ছেলের গল্প পাঠ শুনছিলেন। ধরা পড়ে বারবার কাশতে লাগলেন তিনি। পরে আবুল বাশারের কাছে শুনেছিলাম পুত্রের সাহিত্য রচনায় তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ এবং সহযোগিতার কথা। আবুল বাশারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ তিনি নাকি প্রেস থেকে মাথায় করে বয়ে এনেছিলেন।
মনে আছে সে রাতে, রাত যখন শেষ প্রহরে, তখন পাশের একটি ঘর থেকে সেতারের সুর ভেসে আসছিল। মিশে যাচ্ছিল গল্প পাঠের অনুসঙ্গ হয়ে। ওই সেতারবাদক ছিলেন আবুল বাশারের অনুজ।
আবুল বাশার তখনো প্রতিষ্ঠান পরামানিকের কাছে মাথামোথা মোড়াননি। কোনো বিগ হাউস ম্যাগাজিনে প্রকাশনা বলতে—ছোট কাগজ সাহিত্য প্রসঙ্গে, যত দূর মনে আছে ‘বারো মাস’-এ তাঁর ‘চোর’ গল্পটি উদাহরণ হিসেবে ছাপা হয়েছিল। তিনি তাঁর গল্পগুলো প্রকাশের জন্য তখন একজন প্রকাশক খুঁজছিলেন।
বাংলাদেশে চলে আসার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন সে সময়। তাঁর ‘একজন মুসলমান’ গল্পটি যা পরে ‘দুই অক্ষরের গল্প’ নামে প্রকাশ হয়। সে গল্পটি পাঠের পর পশ্চিমবঙ্গে সংখালঘু সমস্যা নিয়ে কথাও হয়েছিল বিস্তর। কিন্তু উনিশ শ চুরাশি সালের শেষদিকে আবুল বাশারের সঙ্গে যখন আমার দ্বিতীয় সাক্ষাত্, তখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন।
যদিও তখন তিনি মফস্বলনিবাসী, তবু নিজের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তিনি তখন নিশ্চিত। ওই সময় তাঁর কলকতাকেন্দ্রিক পৃষ্ঠপোষক জুটে গেছে। চিঠিতে নিয়মিত যোগাযোগও করছেন তাঁরা। একজনের কথা মনে পড়ছে—তিনি লিখেছিলেন, ‘বাশার, টিভিতে সেদিন তোমাকে নিয়ে আলোচনা শুনলাম। খুব ভালো লাগল। সেই সঙ্গে কষ্ট পেলাম এই ভেবে যে তোমার টিভি নেই। অনুষ্ঠানটি তুমি দেখতে পেলে না।’ এসব কারণে আবুল বাশারের কথাবার্তাতেও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস।
আমরা তাঁর ঘমর ঢোকার পর পরই সব্যসাচী সমাজদার আবুল বাশারকে বললেন, ‘বাশারদা, আপনার জন্য একটা সুখবর আছে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, কী ধরনের সুুসংবাদ আপনি প্রত্যাশা করছেন? এ প্রশ্নে আবুল বাশারের উত্তরটা ছিল খানিকটা দাম্ভিকতাপূর্ণ। বললেন, ‘দুই বছর আগে আনন্দ বা ‘দেজ’ এ ধরনের কোনো প্রকাশনী থেকে আমার গ্রন্থ প্রকাশের প্রস্তাব এলে সুসংবাদ ভাবতাম।
কিন্তু এখন আর তা মনে করি না। সেটা আমার দায়িত্ব না। আমার দায়িত্ব লেখার। প্রকাশকরা নিজ দায়িত্বেই তা প্রকাশ করবেন।’ বললেন, ‘যদি সত্যজিৎ বা গৌতমের মতো কোনো ক্রিয়েটিভ ফিল্ম ডিরেক্টর আমার কোনো গল্প নিয়ে ছবি করার প্রস্তাব দেন, তাহলে সেটাকে সুসংবাদ ভাবা যেতে পারে।’
‘তাহলে বিষয়টি সুসংবাদের কাছাকাছি।’ কলকাতায় নিজের এক অভিনেত্রী মাসির বরাতে সব্যসাচী সমাজদার বললেন, সত্যজিৎ রায় আপনার নাস্তিক গল্পটি পাঠ করছেন।
আবুল বাশারের ‘নাস্তিক’ তখন সদ্য প্রকাশিত এবং সম্ভবত বিগ হাউসে ওটাই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশ। শেখ আনিস ও সব্যসাচীর গল্পটি পড়া থাকলেও আমাকে শেনানোর জন্য সে রাতের আড্ডায় ওই গল্পটিই প্রথম পাঠ হিসেবে নির্বাচিত হলো। পাঠের পর প্রথমে সব্যসাচীর কাছে সমালোচনা চাইলেন আবুল বাশার। কিন্তু সমালোচনার বদলে সবেমাত্র দু-একটা কিশোরোপযোগী কবিতার কবি সব্যসাচীর বিনয় প্রকাশ ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। তাঁর বিব্রত বক্তব্য ছিল, আশারদা, মানে আপনার লেখা, আমি কী বলব, খুব ভালো হয়েছে, দারুণ হয়েছে—এই সব।
আর সে মুহূর্তে আমি ভাবছিলাম আবুল বাশারের বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে ধর্মত্যাগের অভিযোগের বিষয়টি। দৈনিক আজকাল-এ প্রকাশিত ওই সংবাদে আবুল বাশারকে নিয়ে তাঁর পরিচিত মহলে তখন সমালোচনার ঝড়। সংবাদটিতে আবুল বাশারের রচনাশৈলীর প্রশংসা করে তাঁর সাম্প্রাদায়িকতাবিরোধী মানসিকতার পরিচয় দিতে লেখা হয়েছিল, “তাই তিনি তাঁর নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ শব্দটি না লিখে কেবল ‘আবুল বাশার’ লেখেন।” আবুল বাশারের স্থানীয় বন্ধুদের কাছে এটি ছিল আপত্তিকর। তাঁরা বলছিলেন, আবুল বাশার আত্মবিক্রির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেতে চাচ্ছেন।
কেউ বলছিলেন, ‘মোহাম্মদ’ শব্দটিকে এর মাধ্যমে একই সঙ্গে গুরুত্ববহ এবং পরিত্যাজ্য করার স্পর্ধা দেখানো হয়েছে। আবুল বাশার তাঁর ধর্মপরিচয় ত্যাগ কমরছেন, তা এই সংবাদে স্পষ্ট। তাই সব্যসাচীর পর যখন আবুল বাশার আমার দিকে ফিরলেন, তখন গল্পের সমালোচনা নয়, তাঁর অনুমতি নিয়ে একটি প্রশ্ন করলাম।
‘আপনার গল্প পড়ার বা শোনার পর একজন পাঠক বা শ্রোতা যদি আপনার বিরুদ্ধে এই অবিযোগ উত্থাপন করে যে আপনি প্রচলিত ধর্ম-বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানতে চাচ্ছেন। তাহলে কি আপনি সে অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করবেন? উত্তরে একটুও সময় না নিয়ে আবুল বাশার মাথা উঁচু করে বললেন, ‘অবকোর্স, আমি স্বীকার করব।’ তারপর কেন স্বীকার করবেন, কেন ধর্ম-বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানতে চাচ্ছেন, তার মার্কসীয় ব্যাখ্যায় কথার স্ফুলিঙ্গ ছোটালেন।
কিন্তু তা ছিল তখন আমার ধারণক্ষমতার বাইরে। প্রথাগত বিশ্বাসের নিরাপদ বিবর থেকে একটি সরীসৃপ সংস্কার যেন হঠাত্ জেগে উঠে তীব্র দংশনে আমার চেতনায় বিষ ছড়িয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে আবুল বাশারকে নয়, জীবনের প্রথম একজন নাস্তিক দর্শন করলাম।
সে রাতে আবারও গল্পের আড্ডা জমেছিল। বাশার ভাই পাঠ করছিলেন, সীমার, ব্যাঙ এবং শুক্রবার নামের অসাধারণ সব গল্প। সব শেষে শুনিয়েছিলেন, ‘খালাশ’ নামের একটি অসমাপ্ত উপন্যাস।
কিন্তু আমার চেতনায় ছড়িয়ে পড়া বিষ কিংবা প্রতিষেধক অথবা রাত জাগা ক্লান্তিতে মাথা ধরা ছাড়ছিল না কিছুতেই। অথবা ক্ষিধেও হতে পারে। পশ্চিম বাংলায় আবুল বাশারদের তত্কালীন পরিমণ্ডলে যতবারই গিয়েছি ততবারই ঠিকমতো না খেতে পাওয়ার অতৃপ্তি বহন করতে হয়েছে।
তবে আবুল বাশার যখন বলতেন, লেখক হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে কম খাওয়া এবং কম ঘুমানো, তখন ক্ষিদের প্রকাশকেই অপরাধ মনে হতো। ক্ষিধে ও দরিদ্রতা নিয়ে আবুল বাশারের এক ধরনের অহংকারবোধও দেখেছি। তাঁর ‘যদিও স্বপ্ন স্বপ্নহীন’ নামে নিজের সম্পর্কে একটি লেখায় তারই প্রকাশ লক্ষণীয়। এ লেখাটিতে আবুল বাশার বলেন, ‘আমার খাওয়া দেখে আমার এক শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক স্বস্নেহে একটি সিদ্ধান্ত করেছিলেন, বাশার, তুমি বেসিক্যালি খেতে জানো না। এই খেতে না জানা যে খেতে না পাওয়া থেকে এতটা জেনেই তিনি সিদ্ধান্তটি করেছিলেন।’ দ্বিতীয় সাক্ষাতের রাতেও আধাভুক্ত জঠর ক্ষিধের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল বারবার। ওই রাতে বাশারপত্নী শাহানা ছিলেন না। সম্ভবত আবুল বাশারের বোন নমুনা কয়েকটি রুটি বেলে দিয়েছিলেন। সেই রুটি আর খেজুরের ঝোলাগুড় ছিল সে রাতের খাবার। তাও চারজনের প্রয়োজনের চেয়ে ঢের কম। ভোর রাতের দিকে শোবার আয়োজনও ছিল স্মরণে রাখার মতো। একমাত্র লেপটি নিয়ে শেখ আনিস আর সব্যসাচী ফ্লোরিং করলেন, আর আমি ও বাশার ভাই খাটের তোষকটাকেই লেপ বানিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
পরের দিন সকাল থেকে রাত প্রায় ১০টা অবধি কাটল মুর্শীদাবাদের ডোমকুল বাজারে। রসরাজ মিষ্টান্নভাণ্ডার নামের একটি দেকানেও অনেকক্ষণ সময় কাটে। ‘মোহাম্মদ’ পরিত্যাগের বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনা হয়। আবুল বাশার বললেন, ‘আমি তো কখনোই আমার নামের আগে মোহাম্মদ শব্দটি লিখি না। অনেকেই লেখেন না।
-কিন্তু ওই সংবাদে তো বোঝানো হয়েছে আপনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে স্বেচ্ছায় ‘মোহাম্মদ’ ত্যাগ করেছেন।
-তা ঠিক।
স্বীকার করলেন আবুল বাশার।
-কিন্তু এর জন্য তো আমি দায়ী নই।
-তবে কি আপনি এর প্রতিবাদ করবেন?
এ প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তার কি কোনো প্রয়োজন আছে? প্রতিবাদের অর্থ তো মোহাম্মদকে ঘোষণা দিয়ে গ্রহণ করা। আমি গ্রহণ অথবা পরিত্যাগ দুটোরই বাইরে থাকতে চাই।
আড্ডা চলাকালে আবুল বাশার একটা সিদ্ধান্ত জানালেন। বললেন, এরপর থেকে দাড়ি রেখে দেব। কিন্তু কেন এবং কী প্রয়োজনে, তা জানাননি। প্রসঙ্গান্তরে আবুল বাশার একটি প্রস্তাব দিলেন। দুই বাংলার শিল্প-সাহিত্যের বন্ধন হিসেবে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা যেতে পারে। নামও নির্ধারণ হলো। প্রস্তুতি নামের একটি পাক্ষিক পত্রিকা মাসে একবার বাংলাদেশ থেকে অন্যবার পশ্চিম বাংলা থেকে প্রকাশিত হবে। দুই বাংলাতেই থাকবে আলাদা সম্পাদনা পরিষদ। পশ্চিম বাংলার দায়িত্ব নিতেও রাজি হলেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে সম্ভাব্য লেখকদের মধ্যে বদরুদ্দীন উমরের বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখালেন। রাত প্রায় ১০টায় আড্ডা ভেঙে যাওয়ার আগমুহূর্তে আবুল বাশার বললেন, হাফিজ, আপনি চিঠি লিখবেন। আপনার চিঠির আমি উত্তর দেব।
এরপর ফিরে এসে অমনক দিন নিষ্ক্রিয় কেটেছে। প্রস্তুতির প্রস্তাবনা ফাইলেই বিবর্ণ হয়েছে। লিখি লিখি করে কোনো চিঠিই লেখা হয়নি আবুল বাশারকে। পরে সাতাশির দিকে আমার এক বন্ধুপ্রতিম অনুজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক চিঠিতে লিখলেন, ‘দেশ শারদীয় সংখ্যায় আবুল বাশারের একটি লেখা ছাপা হয়েছে। লেখাটি আপনার মুখে শোনা সেই অসমাপ্ত উপন্যাস।’ ভবলাম ‘খালাশ’। কিন্তু পরে সংখ্যাটি হাতে পেয়ে দেখলাম নাম পাল্টিয়ে ‘ফুল বৌ’ রাখা হয়েছে। সেই প্রথম উপন্যাসেই তাঁর আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্তি।
তারপর একটার পর একটা প্রকাশনা। ভোরের প্রসূতি, মরুস্বর্গ, সুরের সাম্পান—এসব বই তখন বাংলাদেশের অগ্রসর পাঠকদের হাতে হাতে। সে সময় তসলিমা নাসরিনের উত্থান ও তাঁকে নিয়ে বিতর্কের আগে আবুল বাশারকে নিয়ে এ দেশের সাহিত্যাঙ্গন থেকে মুসলিম মৌলবাদীদের মাহফিল পর্যন্ত গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল। আবুল বাশার লিখছিলেনও খুব দ্রুত। লক্ষ করছিলাম, প্রকাশকদের চাহিদা মেটাতে তাঁর বেশকিছু গল্প উপন্যাসে অনুপ্রবেশ ঘটছে। ‘চাবি’ গল্পটি সরাসরি চলে এসেছে ভোরের প্রসূতিতে। আবুল বাশার সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাচ্ছিলেন তাঁর গদ্য নির্মাণের জন্য। সে সময় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার পক্ষ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তারা শংকর, মানিক-পরবর্তী কার গদ্য আপনাকে স্পর্শ করে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, আবুল বাশার। এভাবে প্রশংসা ও প্রতিষ্ঠার এত শীর্ষে আবুল বাশার পৌঁছে গেলেন যে তাঁর সঙ্গে ন্যূনতম পরিচয় ছিল এ দাবি করতে দ্বিধা হতো। লক্ষ করছিলাম, আবুল বাশার অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তাঁর বইগুলো উত্সর্গ করলেও যাঁর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় সেই শেখ আনিস ও তাঁর মফস্বলীয় বন্ধুদের তিনি স্মরণ করছেন না। মনে হতো টেকা গ্রামের স্কুলমাস্টার আবুল বাশারের সঙ্গে কলকাতা প্রবাসী সাহিত্যিক আবুল বাশারের ব্যবধান তৈরি হয়েছে ব্যাপক। অবশ্য পরে একসময় নজরে আসে তাঁর ‘পানি কয়েদ’ গল্পগ্রন্থটি তিনি তিন বন্ধু গোলাম হাদি, পিনাকী রায় ও শেখ আনিসকে উত্সর্গ করেছেন। তাঁর দুটি গল্প ‘অন্যনকশি’ এবং ‘বড়জোর দুই মাইল’-এ এমনকি ‘মেহেরপুর’ নামটিও খুঁজে পেলাম।
অতঃপর এই ভাবনায় আমি ক্রমেই স্থির যে আবুল বাশার নিশ্চয়ই আমাদের মনে রেখেছেন। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময় যোগাযোগ না রেখেও জানি তিনি এখনো সেই আগের আবুল বাশার। অন্তত সংখ্যালঘু অস্তিত্বে ও বিপন্নতাবোধে। ‘স্পর্শের বাইরে’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ঈশানের জবানীতে আবুল বাশার যখন নিজের অবস্থা জানাতে লেখেন, ‘… ‘সোনাতলা কলকাতা নয়। ও মুসলমান বলে যাদবপুরে বাসা না পেয়ে সোনাপুর চলে যায়। বাড়ি করেছে কাজে কাজেই। …কী শুনব ভাই। মুচি-মেথর মুসলমান এ দেশে তিন সমান।’ তখন আবুল বাশারকে মোটেই দূরের মানুষ মনে হয় না।
মনে হয়, তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মত্যাগের অভিযোগ উঠলেও ধর্ম তাঁকে ছাড়েনি। জন্মের এ দায় জন্মদাগের মতোই হয়তো তাঁকে বহন করতে হবে আজীবন।
পুনশ্চঃ ‘স্পর্শের বাইরে’ উপন্যাসটি পড়ার পর দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ আবুল বাশারের সাহিত্যকর্মের বিষয়ে আমার আর কিছু জানা নেই। সম্প্রতি জেনেছি তাঁর ‘ভোরের প্রসূতি’ উপন্যাসটি নিয়ে অশীষ রায়ের পরিচালনায় ‘সিতারা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ভারতীয় অভিনেতা, সঙ্গে বাংলাদেশের জাহিদ হাসান, ফজলুর রহমান বাবু ও শাহেদ আলী সুজন অভিনয় করেছেন। ‘সিতারা’ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘এটা সিনেমা নয়, বাংলা বই।’
লেখক: সাংবাদিক, কালের কণ্ঠ
লেখাটি কালের কণ্ঠ পত্রিকা থেকে সংগৃহীত